নাগরিক তালিকা নিয়ে গণ-আতঙ্ক

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

সীমান্তের গাঁ-গঞ্জে এখন চাক বাঁধছে এনআরসির আতঙ্ক। তুমুল উৎকণ্ঠা। পশ্চিমবঙ্গে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ চোখ রাঙাচ্ছেন দুই কোটি মানুষকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেবেন! কোথায়? কোন দেশে! কী হবে তাদের পরিচয়? সন্ত্রস্ত মানুষ। বাপ-ঠাকুরদার ভিটে হারানোর ভয়ে থিকথিকে ভিড় গঞ্জের মনোবিদ-ডাক্তারের চেম্বারে। এনআরসি (জাতীয় নাগরিক তালিকা) জুজুতে আক্রান্ত মানুষ। তবে কি নিজ ভূমে পরবাসী! ডিটেনশন ক্যাম্প? নাকি জেল! যেন গণ–হিস্টিরিয়ার চেহারা।

দিন কয়েক আগে ভোটার তালিকায় নাম সংশোধন করতে না পারার হতাশায় আত্মঘাতী হয়েছেন মুর্শিদাবাদের ডোমকলের যুবক মিলন মণ্ডল। এনআরসি-আতঙ্কে রাজ্যে মৃত্যু হয়েছে আরও ১১ জনের। ভিটে হারানোর ভয়ে কেউ আত্মঘাতী হয়েছেন। কেউ ঠা ঠা রোদে রেশন কার্ড ডিজিটাল করানোর কয়েক শ লোকের লাইনে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছেন, হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। গ্রামের চা-দোকান, সান্ধ্য মাচা থেকে চণ্ডীমণ্ডপে একই আলোচনা।

আসামের পরে বাকি দেশে এনআরসি হবেই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি নেতাদের এমন হুংকারে ভয়ে কাঁটা সীমান্তের গ্রাম।

মনোবিদদের ভাষায় ‘অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার’। তবে এর ছোঁয়াচ বড় সাংঘাতিক।

চার-পাঁচ পুরুষ ধরে রাজ্যে বসবাসকারী মানুষ এখন ৫০-১০০ বছরের পুরোনো কাগজের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জমির দলিল, দাগ নম্বর, খতিয়ান, পর্চা—সবকিছু। জন্মস্থান, পড়াশোনার সার্টিফিকেট। বন্যায় কারও ভেসে গেছে ঘরবাড়ি। সঙ্গে ভেসে গেছে দলিল। মানুষ প্রাণ বাঁচাবে, না নথিপত্র বাঁচাবে? দেশে ৩০ কোটি মানুষ ভূমিহীন। তারা দলিল কোথায় পাবে? গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ। রুটিরুজির টানে এক জায়গা থেকে যেতে হয় অন্যত্র। কেউ উচ্ছেদ হয়। কোথায় পাবে এসব!
কারও আবার ভোটার-আধার দুই কার্ডেই নাম ভুল। সবচেয়ে অসহায় গরিব, প্রান্তিক মানুষ। খেতমজুর থেকে দিনমজুর। যত গরিব, তত কাগজপত্রের অভাব। তত বিপদ।

প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে দুশ্চিন্তায় মুসলিম মহল্লা। আরএসএসের কাছে তারা ‘অনুপ্রবেশকারী’। কিন্তু অন্যরা কি নিরাপদে? উদাহরণ আসাম। এক সকালে কেউ নিজে হঠাৎ হয়ে গেছে ‘বিদেশি’। আবার কারও স্ত্রী, কারও মা, কারও সন্তান এখন ‘বিদেশি’। বিচিত্র অবস্থা। বাদ পড়া ব্যক্তিদের তালিকায় অধিকাংশই হিন্দু। বাদ পড়া ১৯ লাখের মধ্যে ১৭ লাখ বাংলাভাষী। দেড় লাখের বেশি গুর্খা। কমবেশি ছয় লাখ মুসলমান। সাড়ে ১১ লাখ হিন্দু। স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে তাম্রফলক পেয়েছেন। নাম বাদ। নাম আছে আলফাপ্রধান পরেশ বড়ুয়ার। তবু ‘রাষ্ট্রহীন’ রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত বায়ুসেনা আধিকারিক ছবীন্দ্র শর্মা আর স্ত্রী। এনআরসিতে এবারও জায়গা হয়নি কারগিলে জান কবুল লড়াই চালিয়ে আসা সেনা জওয়ান সানাউল্লার। চূড়ান্ত তালিকায় তাঁর পরিবারের কারও নাম নেই। সেনাবাহিনীর শৌর্য পুরস্কারপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন খান। আদালতে প্রমাণিত ভারতের নাগরিক। তবু ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী। গুয়াহাটি থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে মাটিয়ায় তৈরি হচ্ছে দেশের বৃহত্তম বন্দিশিবির। এ ছাড়া বরপেটা, ডিমা, হাসাও, নলবাড়ি, লখিমপুরেও বন্দিশিবির হচ্ছে।

বিচলিত সব অংশের মানুষ। দেশভাগের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে আসা লাখ লাখ মানুষ। তাদের সবার কাছে কি প্রয়োজনীয় নথিপত্র আছে? কোথায় খুঁজবে? শঙ্কিত তারাও। শুধু মুসলমান না, শুধু উদ্বাস্তু মানুষ না, বিপদটা সবার। চোখের সামনে শুধুই কাঁটাতার।

মানুষকে মানুষ হিসেবে নয়। দেখা হচ্ছে এক টুকরো কাগজ হিসেবে।

তিন দিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন রকম বয়ান। দিল্লিতে এক রকম। কলকাতায় আরেক রকম। দিল্লিতে প্রথম দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে বললেন ‘এনআরসি আসামের ব্যাপার।’ পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ উড়িয়েই দিলেন। দ্বিতীয় দিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে দেখা করে বললেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি নিয়ে কোনো কথা হয়নি। আলোচনা হয়েছে কেবল আসামের এনআরসি নিয়ে।’ তাহলে রাজ্য বিধানসভায় ‘এনআরসি চালু করা যাবে না’ বলে প্রস্তাব পাস করালেন কেন? বিধানসভায় তৃণমূল, বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস একমত হয়ে সেই প্রস্তাব পাস করায়। একমাত্র ব্যতিক্রম বিজেপি। এনআরসি যদি কেবল ‘আসামের ব্যাপার’ হয়, তবে কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী মিছিল করলেন কেন?

অথচ, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের শেষে মুখ্যমন্ত্রী যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন প্রায় একই সময় অমিত শাহ ভাষণ দিচ্ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ড সীমান্তের জামতারায়।

অমিত শাহ তখনো বলে চলেছেন, ‘আপনি যদি ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, আমেরিকায় গিয়ে স্থায়ীভাবে থেকে যেতে চান, কেউ আপনাকে ঢুকতে দেবে না। তাহলে ভারতে এসে কেউ কেন থেকে যাবেন? এভাবে দেশ চলে না। দেশের নাগরিকদের রেজিস্ট্রার থাকা সময়ের চাহিদা। আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার, আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, শুধু আসামে না, আমরা গোটা দেশের জন্য এনআরসি করব। ভারতীয় নাগরিকদের জন্য রেজিস্টার করব। বাকিদের জন্য, ব্যবস্থা নেওয়া হবে আইন অনুযায়ী!’

কলকাতায় ফিরে সেই মুখ্যমন্ত্রীই বললেন, ‘আমি তো দিল্লি গেলাম আলাদা করে কথা বলতে। এনআরসিটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পড়ে। এটা মাথায় রাখবেন। যার জন্য আমি নিজে গিয়ে কথা বলে এলাম। সবকিছু বলে আসছি।’

কোনটা ঠিক? দিল্লিতে যা বলেছেন, নাকি কলকাতায়?

দিলীপ ঘোষরা আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়ে যাচ্ছেন। রাজ্য সরকার চুপ। সিবিআইর হাত থেকে শাসক দলের নেতা–নেত্রীদের বাঁচাতে দরবার করে চলেছে।

স্বাভাবিক। যে ‘অনুপ্রবেশ’ তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে এনআরসি, পশ্চিমবঙ্গে সেই অনুপ্রবেশের প্রচারক বরাবরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম ফ্রন্ট সরকারের বদনাম করার উদ্দেশ্যে তিনি দেশময় প্রচার করেন, পশ্চিমবঙ্গ অনুপ্রবেশের স্বর্গরাজ্য। স্লোগান তোলেন ‘নো আইডেন্টিটি কার্ড, নো ভোট’। লালকৃষ্ণ আদভানি সংসদে দাবি করলেন, আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গ অনুপ্রবেশে ভরে গেছে। এর সূত্র ধরেই মমতা মাতিয়ে তুললেন সংসদ। দাবি তুললেন পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ডেপুটি স্পিকারের মুখে কাগজ ছুড়ে মারলেন। অনুপ্রবেশের সেই তত্ত্বের সুযোগ নিয়েই আজ এনআরসির ফসল তুলতে মরিয়া বিজেপি।

এনআরসির আগে এসে গেছে ইভিপি। ইলেকটোরাল ভেরিফিকেশন প্রোগ্রাম। ভোটার তালিকা এর আগেও সংশোধন হয়েছে। নতুন নয়। তবে নির্বাচন কমিশন নিজেই তা করত। কিন্তু এবার সংশোধনের কাজ তারা মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে। অনলাইনে সংশোধন। দেশের মাত্র ৩৭ শতাংশ মানুষের হাতে আছে ‘অ্যানড্রয়েড মোবাইল’। ভোটার তার চেয়ে অনেক বেশি। ডিজিটাল সক্ষমতা কতজন মানুষের আছে?

মানুষকে নিয়ে চলছে গিনিপিগের মতো পরীক্ষা–নিরীক্ষা।

শান্তনু দে: কলকাতার সাংবাদিক