শিশু হত্যা: সন্তানদের বাঁচাব কীভাবে?

শিশু তুহিন হত্যায় টনক নড়ুক, সমাজ–রাষ্ট্র সুস্থ হোক। ছবি: সংগৃহীত
শিশু তুহিন হত্যায় টনক নড়ুক, সমাজ–রাষ্ট্র সুস্থ হোক। ছবি: সংগৃহীত

‘মৃতদের স্মরণ করো, জীবিতদের জন্য লড়াই করো’—রানা প্লাজায় সংঘটিত কাঠামোবদ্ধ হত্যাকাণ্ডের পরে এই ডাক উঠেছিল। ডাকটা এখনো বহাল আছে। দুদিন আগে সুনামগঞ্জে তুহিন নামের ৫ বছর বয়সী একটি শিশুকে নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়। তুহিনের মরদেহ যখন খুঁজে পাওয়া যায়, তখন তার লাশ গাছে ঝুলছে। তার পেটে দুটি ছুরি গাঁথা, কান ও জননাঙ্গ কাটা। এ খবরটি  আমার মতো ‘অতিসংবেদনশীল’ অনেকেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, অবচেতনে অস্থিরতায় ছটফট করেছেন, নিজ সন্তানের মাঝে তুহিনকে খুঁজে পেয়েছেন, ফেসবুকে ক্ষোভ ও হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড অসহায়, হতাশ, বিধ্বস্ত বোধ করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিয়েছি। সোমবার রাতে আমি আমার সন্তানের কাছ থেকে দূরে অন্য ঘরে থেকেছি। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি, ছটফট করেছি।

বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে, ঘন অন্ধকার, আশাহীন, স্বপ্নহীন সময়ে যেখানে দূর দূর পর্যন্ত কোনো আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে না, এমন একটা সময়ে বেঁচে থেকে কী লাভ! পরদিন সকালে মন হলো, এই যে পুরো একটা জাতি গভীর হতাশা, অনিশ্চয়তা, হতাশায় ডুবে যাচ্ছে; এতে আসলে লাভটা কার হচ্ছে? একটার পর একটা নৃশংস হত্যা, ধর্ষণ, শিশু যৌন নির্যাতন, গুম, বিচারহীনতা, দুর্নীতি, প্রকৃতি ধ্বংস, অবাধ লুটপাট ও গুন্ডাতন্ত্রের একচেটিয়া আধিপত্য দেখতে দেখতে আমাদের অনুভূতি ক্রমেই অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, এত ভেবে লাভ নাই। নিজে নিজের সন্তান-পরিবারসহ কোনোভাবে টিকে থাকতে পারলেই হলো। কিচ্ছু হওয়ার নাই। এভাবেই বাঁচতে হবে।

সত্যিই কি কিছু হওয়ার নাই? অন্ধকারের কাল কি আজীবনের জন্য এমনভাবেই অমোঘ, স্থায়ী হয়ে যাবে? ইতিহাস কি তাই বলে? আমরা অনেকেই তুহিনের লাশের ছবি সহ্য করতে পারিনি। ভাবছিলাম রানা প্লাজার কথা। ওই সময় যাঁরা সরাসরি উদ্ধারকাজ করেছেন তাঁদের মনের অবস্থা কী ছিল? আমাদের মতো ‘অতিসংবেদনশীল’ হয়ে গুটিয়ে থাকলে কি তাঁরা কাজ চালিয়ে যেতে পারতেন? যে আহত মানুষগুলো প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছেন, তাঁদের তো ওই ধ্বংসস্তূপের ভেতর তিলে তিলে পচে মরতে হতো। ওই বীভৎসতার মধ্যেও তো জীবন বাঁচানোর জন্য লড়ে গেছেন অজস্র মানুষ।

এমন তো না যে হাত-পা কেটে যাঁরা জীবিত মানুষদের বাইরে বের করে নিয়ে এসেছেন তাঁদের মনের ওপর চাপ পড়েনি? পড়েছে। অনেকের মনেই গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে যা তাঁদের আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। কেউ কেউ সেটা নিতে পারেনি। যেমন হিমালয় হিমুর কথা আমরা অনেকেই জানি। ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল রানা প্লাজার বার্ষিকীর দিন নিজ শরীরে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যা করেছে ছেলেটা। তফাত হলো, ওরা সবাই নিজেদের কর্তব্য পালন করেছে কিন্তু আমরা কী করছি? তনু, নুসরাত, বিশ্বজিৎ, জুবায়ের, আবরার, সায়েমা, তাসলিমা রেনু, তুহিন...একের পর এক নতুন নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে তালিকায়। তালিকা কেবল দীর্ঘই হচ্ছে। জীবনের জন্য, শিশুদের নিরাপদ করবার পথ খোঁজার এখনই সময়।

মহিলা পরিষদের গবেষণার তথ্যমতে, গত ছয় মাসে ৫৭২টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৩টি শিশুকে। অনেকেই বলবেন, তুহিনকে তার বাবাসহ নিজ পরিবারের সদস্যরা খুন করেছেন। আইন অনুযায়ী বিচার প্রক্রিয়া চলবে। এখানে আমাদের কী করার আছে? আমার প্রশ্ন, এটাও কি কাঠামোবদ্ধ হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ নজির না? আমরা আমাদের সন্তানদের কোন সমাজে রেখে যাচ্ছি? সমাজটাকে ভবিষ্যতে তাদের বাসের উপযোগী করে রেখে যাওয়ার লড়াইটা চালিয়ে যাওয়ার কর্তব্য কি আমাদের না?

ডাক্তারি পেশার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের যেমন নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে রোগীকে সারিয়ে তুলতে হয়, তার জীবন বাঁচাতে হয়, তেমনি আমাদেরও এখন নিজের অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সময় এসেছে। এসেছে মনকে শক্ত করে লড়াই করার সাহস অর্জনের। ইতিহাসে আমাদের পূর্বসূরিরা যেমন করে তাঁদের কর্তব্য পালন করেছেন, এ কালেও অনেকে করে যাচ্ছেন—তেমনি আমরা যদি না করি, নিজের অতিসংবেদনশীলতার নিগড়ে বন্দী থাকি, ফেসবুকেই কেবল ক্ষোভ উদ্‌গিরণ করে আত্মশ্লাঘায় ভুগি, তাহলে ইতিহাসের পাতায় মীরজাফরদের তালিকায় আমাদের নামও যুক্ত হবে।

বাংলাদেশের যাঁরা নিজেকে সচেতন নাগরিক হিসেবে মনে করেন, যাঁরা দেশটাকে ভালোবাসেন, যাঁরা এই দেশেই নিজের ও নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ দেখতে পান—তাঁদের এখন উচিত হবে দলমত–নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, নাগরিক মঞ্চ গড়ে তোলা। রাজনীতির কাজ রাজনীতি করবে কি করবে না সে প্রশ্নে যাচ্ছি না। কিন্তু সমাজ বলতে কিছু যদি থাকে, পরিবার থাকে, সন্তানের জন্য ভালোবাসা থাকে, তাহলে বিকৃত অপরাধ আর মনোবিকার দুটির বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে হবে।

আর দশটা বিষয়ে কিছু না হলেও শিশু–কিশোর রক্ষায় আমাদের গাফলিত হবে আরো আত্মঘাতী।

কানিজ ফাতেমা: নারী আন্দোলনের কর্মী।