একটি নতুন 'মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট' দরকার

গত সোমবার অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র প্রথম পাতা কালো কালি দিয়ে ঢেকে প্রকাশ করে
গত সোমবার অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র প্রথম পাতা কালো কালি দিয়ে ঢেকে প্রকাশ করে

গত সোমবার সকালে অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দারা কালো কালিতে ঢেকে দেওয়া সংবাদপত্র হাতে পায়। একটি বা দুটি সংবাদপত্র নয়, বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র সেদিন এভাবে প্রথম পাতা কালো কালি দিয়ে ঢেকে দিয়ে প্রকাশ করে। তারা শুধু কালি দিয়ে ঢেকেই দেয়নি। পত্রিকার ওপরের দিকে ডান পাশে লাল রঙের একটি সিল মেরে দিয়েছিল। ওই সিলের মধ্যে সাদা হরফে লেখা ছিল ‘সিক্রেট’ বা ‘গোপনীয়’। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে হরণ করার সরকারি চেষ্টার প্রতিবাদে দেশটির শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো অভিনব এ উদ্যোগ নেয়। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত ‘ইয়োর রাইট টু নো’ নামের অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোর একটি জোটের প্রচারণায় উৎসাহী হয়ে শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলো এভাবে তাদের প্রতিবাদ জানায়।

এ ঘটনার পর কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের গবেষণা দলসহ বিভিন্ন সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট নামে একটি আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছেন। অতীতে এ জাতীয় আইন করার কোনো সুস্পষ্ট নজির নেই। এই আইন মানবাধিকার বা বৈষম্যবিরোধী আইন থেকে ভিন্ন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্টটি ঠিক কী ধরনের হবে এবং এটি কি কোনো ভালো ধারণা?

চলতি বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (এবিসি) দুই সাংবাদিক আফগানিস্তানে পশ্চিমা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করা অস্ট্রেলিয়ান বিশেষ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে সংবাদ প্রচার করে। এ ছাড়া ‘নিউজ কোরস অস্ট্রেলিয়া’র প্রতিবেদক আনিকা স্মেথার্স্ট তাঁর রিপোর্টে সরকার জনগণের ওপর নজরদারির পরিকল্পনা করছে বলে অভিযোগ করেন। এতে সরকার ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এ দুটি সংবাদকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের জুনে এবিসির প্রধান কার্যালয় এবং আনিকা স্মেথার্স্টের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়। অভিযানে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নাজুক পরিস্থিতিকেই তুলে ধরা হয়। অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট শিগগিরই এ প্রশ্নের মুখোমুখি হবে যে উদার গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ত্যাগ না করে আমরা কি জাতীয় নিরাপত্তাকে রক্ষা করতে পারি? যদি তা-ই হয়, তাহলে কীভাবে?

সাংবাদিকদের বাড়িতে ও কার্যালয়ে অভিযানের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডাটনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল যে ওই সাংবাদিকেরা যদি কোনো গোপন নথি পেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের বিচার করা হবে। এক মাস পরে, ডাটন মন্ত্রিপরিষদের একটি নির্দেশ জারি করেন, যাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গুরুত্ব এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংযত ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল ক্রিশ্চিয়ান পোর্টারের পরবর্তী নির্দেশটি ছিল আরেকটু উদার। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে সাংবাদিকেরা কাজটি সাংবাদিকতার পেশাদারি মেনে করেছেন কি না, সে ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্ত দেবেন। সরকারের এই পরিবর্তিত অবস্থানগুলো বাক্‌স্বাধীনতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সংবাদপত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে সরকারের উপলব্ধির বিষয়টিকে প্রতিফলিত করেছে।

যাহোক, অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটি আইন সাংবাদিকদের এবং তাঁদের সংবাদের উৎসগুলোকে টার্গেট করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তা আইন, যা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর। এই আইনে সরকারকে যে কাউকে আটকে রাখা এবং জিজ্ঞাসাবাদের অনন্য ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এএসআইও আইনের অধীনে বিশেষ গোয়েন্দা অভিযানের তথ্য প্রকাশের জন্য ৫ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে। ডিফেন্স অ্যাক্টে নৌবাহিনী, সামরিক বাহিনী ও বিমানবাহিনীর কোনো তথ্য অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আলাদা আইন দরকার।

প্রস্তাবিত মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট তিনটি মূল ভূমিকা পালন করতে পারে। এটিকে জাতীয় সুরক্ষা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র রক্ষায় একটি উপযুক্ত এবং সুবিধাজনক বিকল্প হিসেবে পরিণত করা যেতে পারে।

প্রথমত, একটি ‘মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট’ অস্ট্রেলিয়ায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেবে এবং নিশ্চিত করবে। এই স্বীকৃতি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমের ভূমিকাকে সমর্থন করবে এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহি এবং আইনের শাসনের প্রতি অস্ট্রেলিয়ার অঙ্গীকারের বিষয়টিকে সামনে আনবে। এভাবে একটি মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট জনগণের অধিকার এবং ক্ষমতা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট অঙ্গীকার উপস্থাপন করবে, যাতে জনগণ জানতে পারে কীভাবে তারা শাসিত হয় এবং ক্ষমতার চর্চা করা হয়। আইনটি এই বিষয়কেও স্বীকৃতি দেবে যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়, এটি প্রয়োজনীয় এবং আনুপাতিক সীমাবদ্ধতার বিষয় হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, এই আইন গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে প্রকাশের সংস্কৃতিকে সমর্থন দেবে এবং সরকার ও গণমাধ্যমের মধ্যে যে দূরত্ব বা আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, তা পর্যায়ক্রমে পুনর্নির্মাণে ভূমিকা রাখবে। একটি মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট বিতর্কিত এবং নতুন আইন কার্যকর করার সময় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর পার্লামেন্ট এবং সরকারি খাতের প্রভাব বিবেচনা করে এই দুই খাতের গুরুত্বকে আরও জোরদার করবে।

তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এ ধরনের মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট বৈধ সাংবাদিকতাকে ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্র থেকে বাইরে রাখবে এবং তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে। কারণ, সাংবাদিকতা করা কোনো অপরাধ নয়।

অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সুরক্ষা আইনগুলো অনন্যভাবে বিস্তৃত এবং জটিল। নানা রকম অসংগতির কারণে তা সাংবাদিকদের স্বাধীনতার ওপর প্রভাব ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ায় একটি মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট খুবই জরুরি। এখন সময় হয়েছে আইনটি তৈরি করার। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়টি খুবই জরুরি একটি বিষয়, এটা সবাইকে বুঝতে হবে।

তবে মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট সংকট মোচনের একমাত্র উপায় নয়। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় প্রভাব ফেলে—এমন যেসব আইন অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে, সেগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজনীয়তা এতে ফুরিয়ে যাবে না। বিশেষত, বেসরকারি খাত, সরকারি খাত এবং গোয়েন্দা হুইসিল ব্লোয়ারদের সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া দরকার।

এডিনিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত, সংক্ষেপিত
রেবেকা আনানিয়ান ওয়েলশ: অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির টিসি বার্নি স্কুল অব লর জ্যেষ্ঠ প্রভাষক