দুই উপাচার্যের আখ্যান ও বর্তমানের দশা

দুই উপাচার্য: মনীষী আবুল ফজল ও অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
দুই উপাচার্য: মনীষী আবুল ফজল ও অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

সম্মানিত উপাচার্যেরা বরাবরই আলোচনায় ছিলেন। আগে উপাচার্যেরা আলোচিত হতেন তাঁদের পাণ্ডিত্য, মননশীলতা ও ন্যায়নিষ্ঠার জন্য। এখন দিন পাল্টেছে। সাম্প্রতিক কালে সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বহুল আলোচিত উপাচার্য বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম আলোচনায় এসেছেন ছাত্র আবরার ফাহাদের মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে জানাজায় যোগ না দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী ছাত্রদের পৃষ্ঠপোষকতা, রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি ও ক্যাম্পাসে ভিন্নমত চর্চা লালনে ব্যর্থতা এবং অন্যজন অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম আলোচিত হয়েছেন ছাত্রনেতাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা ভাগাভাগির মতো দুর্নীতি ও ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করার অভিযোগে।

না, তাঁদের নিয়ে আমার এ আলোচনা নয়। বরং আগের সর্বজন (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন উপাচার্য, যাঁদের ব্যক্তিগতভাবে আমার জানার সৌভাগ্য হয়েছিল, তাঁদের একজনকে ভিন্নমত চর্চার পথিকৃৎ এবং অন্যজনকে ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচনা করব। যা থেকে তরুণ পাঠক এখনকার ও সে সময়কার উপাচার্যদের ফারাক বুঝতে পারবেন। না, দুজনের একজনের বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি পড়িনি। তবে একই বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি দুজনের সান্নিধ্যে আসি। সে কথায় পরে আসছি।

অধ্যাপক আবুল ফজল
অধ্যাপক আবুল ফজল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। একসময় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু মাসুদের বাবা কবি ফররুখ আহমদের অনাহারে করুণ মৃত্যুর পর আমি তাঁদের পরিবারের আর্থিক সহায়তার কাজে জড়িয়ে পড়ি। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদের পরিবার তখন চট্টগ্রামে, যেখানে আমার আব্বা কলেজে শিক্ষকতা করতেন। কবি ফররুখ আহমদ তখন ভিন্নমত অসহিষ্ণুতার শিকার। তাই ফররুখ-পরিবারকে সহায়তা করার জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে বাবার বন্ধু অধ্যাপক আহমদ শরীফের সঙ্গে আলাপ করি। এ ব্যাপারে চটগ্রামে কার সঙ্গে আলাপ করা যায় জিজ্ঞেস করলে তিনি অধ্যাপক আবুল ফজলের নাম বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেলে আমি চট্টগ্রামে চলে যাই। সেখানে গিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজলের নুর আহমদ সড়কের বাসায় দেখা করি। সেখানে আমরা ফররুখ স্মৃতি তহবিল গঠন করি এবং এই তহবিলের জন্য সাহায্য চেয়ে একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়।

বিবৃতিতে অধ্যাপক আবুল ফজল, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মাহবুবুল আলম, নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদসহ চট্টগ্রামের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা স্বাক্ষর করেন। এ ব্যাপারে অর্থসাহায্য সংগ্রহের জন্য অগ্রণী ব্যাংক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখায় একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। প্রথমে সংগৃহীত পাঁচ হাজার টাকা, অধ্যাপক আবুল ফজলের একটি চিঠি ও ডিমান্ড ড্রাফটসহ কবিপত্নীকে পাঠানো হয়। চিঠির অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত করা হলো:

‘বেগম কবি ফররুখ আহমদ, আপনার স্বামী মরহুম কবি ফররুখ আহমদের অকালমৃত্যুর জন্য দেশের আরও বহুজনের মতো আমরাও অত্যন্ত মর্মাহত। তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর প্রতি সুবিচার করা হয়নি—এ অপরাধে আমরাও অপরাধী। তাঁর জন্য এখন দুঃখ আর অনুশোচনা করে লাভ নেই। কবি আজ এসবের অতীত। আমাদের বর্তমান দুর্ভাবনা আমরা কীভাবে আপনার ও আপনার ছেলেমেয়ের কিছুটা অন্তত দুঃখ লাঘব করতে পারি। এ উদ্দেশ্যে আমরা চট্টগ্রামে “ফররুখ স্মৃতি তহবিল” নামে কিছু অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছি, আমরা কতখানি সফল হলাম বলতে পারছি না। আপাতত হাজার পাঁচেক টাকা আমাদের তহবিলে সংগৃহীত হয়েছে। সেই টাকাটার একটা ব্যাংক ড্রাফট এই সঙ্গে পাঠাচ্ছি। প্রাপ্তি স্বীকার করলে বাধিত হব। ব্যক্তিগতভাবে আমি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকেও আপনাদের জন্য কিছু সরকারি সাহায্য বরাদ্দের জন্য একখানা চিঠি লিখেছিলাম। তাঁরা কিছু করেছেন কি না, আজও জানতে পারি নাই। আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমরা এই সাহায্যের কথা কাগজে প্রকাশ করতে চাই। তাহলে আমাদের বিশ্বাস, এই অবহেলিত কবির অবদানের প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে।’

এ ছাড়া অধ্যাপক আবুল ফজল আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি ঢাকায় গিয়ে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলব।’ কথা অনুযায়ী তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গণভবনে দেখা করলে বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা, যত দূর মনে পড়ে মোস্তফা সারোয়ারকে বকা দিয়ে বলেন, ‘কবি ফররুখ আহমদ অর্থকষ্টে অনাহারে মারা গেলেন, তোরা তো কেউ আমাকে কিছু জানালি না।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ মহানুভবতায় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে কবি-পরিবারের সাহায্যের জন্য পাঁচ হাজার টাকা মঞ্জুর করেন এবং বলেন, তিনি স্বয়ং এটা কবি-পরিবারকে পৌঁছে দেবেন। আবুল ফজল সাহেব বলেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এটা কবি–পরিবারকে পৌঁছে দেবেন। তিনি কবিপত্নীর সঙ্গে দেখা করে চেকটা তাঁকে পৌঁছে দেন। এরপর আমরা কবির সাহিত্যকর্ম প্রচার ও এর সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগী হই। কবি-পরিবার থেকে জানতে পারি যে তাঁর বেশ কিছু অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি রয়েছে। ফররুখ স্মৃতি তহবিলের সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে ‘ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশ করা হবে এবং এর বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে কবি-পরিবারকে সাহায্য করা হবে। আবার অধ্যাপক আবুল ফজলের স্বাক্ষরে বইটি প্রকাশের জন্য অর্থসাহায্য চেয়ে আবেদন করা হয়। তদনুযায়ী ‘ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হয়। এটি সম্পাদনা করেন বিশিষ্ট কবি, সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ।

ফররুখ আহমদের বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার কারণ হলো, আদর্শিক দিক থেকে অধ্যাপক আবুল ফজল ও কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। অধ্যাপক আবুল ফজল নিজেও ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতার ‘প্রসঙ্গ কথায়’ লিখেছেন: ‘—তাই তাঁর তিরোধানে এমন একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, যার জন্য আমরা বিপরীত-মনারাও বেদনাবোধ না করে পারি না।’

এতৎসত্ত্বেও ভিন্নমতাবলম্বী একজন কবির পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও তাঁর সাহিত্যকর্ম প্রচার ও সংরক্ষণের জন্য তিনি কী না করেছেন! আজকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন কোনো নজির পাওয়া যাবে কি?

অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
১৯৭৬ বা ’৭৭ সালের কথা। অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ফার্মগেটসংলগ্ন ইন্দিরা রোডে তখন তাঁর একটি বাসা ও অফিস ছিল। আমি সেখানে যেতাম কবি ফররুখ আহমদের কাব্যগ্রন্থ ‘হে বন্য স্বপনেরা’ প্রকাশের জন্য। এটার ব্যয় নির্বাহের জন্য আমরা পাঞ্জেরী নামে একটি সাময়িক পত্র প্রকাশ করেছিলাম, যা তিনি সম্পাদনা করেছিলেন। কবি সম্পর্কে মূল প্রবন্ধ লিখেছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।

যা-ই হোক, একদিন আমি বাসায় যেতেই পিয়নকে তিনি বললেন ‘বাসার নাশতা’ অর্থাৎ আমি তাঁর ব্যক্তিগত অতিথি, আমার আপ্যায়নের ব্যয় তাঁর ব্যক্তিগত ব্যয়। আমি থাকতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ একজন এলেন। তাঁকে সামনের সোফায় বসতে বলে আবার পিয়নকে ডাকলেন, এবার বললেন ‘অফিসের নাশতা’, তার মানে উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে এসেছেন। এভাবেই অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল ও নিজের পকেটকে আলাদা করে রাখতেন।

ভাবতে অবাক লাগে, একসময় অধ্যাপক আবুল ফজল ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন! সেখান থেকে আমরা এখন কোথায় নেমেছি?

কোথায় পথ হারাল?
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনেট কর্তৃক সুপারিশকৃত তিনজনের প্যানেল থেকে উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। সিনেটগুলোতে দলীয় প্রাধান্যের কারণে রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই সুপারিশ পাচ্ছেন ও উপাচার্য হচ্ছেন। এ ধরনের ব্যক্তিরা সরকারকে বারবার বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছেন। ব্যক্তির রাজনৈতিক দর্শন উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নয়। অধ্যাপক আবুল ফজল ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীরও রাজনৈতিক আদর্শ ছিল। কিন্তু তাঁরা ছিলেন পণ্ডিত, ন্যায়পরায়ণ ও সংবেদনশীল মানুষ। তাই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তাঁদের ছাত্রসংগঠনের ওপর নির্ভর করতে হয়নি।

উত্তরণের পথ কী?
বিশ্বব্যাপী সার্চ কমিটি বা উন্মুক্ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দক্ষতা, নৈতিক বোধ, পাণ্ডিত্য, ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বোধ বিবেচনায় নেওয়া হয়। তাই উপাচার্য নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতিটির আশু সংস্কার করা প্রয়োজন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সহনশীলতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার কেন্দ্র হোক, আমাদের উপাচার্যেরা তাঁদের মননশীলতা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য আলোচিত হোন, এটাই আমাদের কামনা।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব