এত মানুষের মাথা গরম হলো কেন?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

পাগলকে কেউ শত্রু ভাবে না। পাগলই সবাইকে শত্রু ভাবে। চোরকে চোর বললে চোরের যতটা সম্ভ্রমহানি হয়, পাগলকে পাগল বললে তার চেয়ে পাগলের বেশি ইজ্জত যায়। এটাই চিরন্তন। এটাই হয়ে আসছে।

গত আগস্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুরো গ্রিনল্যান্ডকে কিনতে চেয়ে ডেনমার্ককে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। এই প্রস্তাবকে প্রেমের প্রস্তাবের মতো হালকা আবেগের কথা হিসেবে নিয়ে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন বলেছিলেন, ‘ট্রাম্প পাগল হয়ে গেছেন।’

এই কথা ট্রাম্পকে অবশ্য ফ্রেডেরিকসেনই যে প্রথম বলেছেন, তা নয়। কয়েক বছর ধরেই মার্কিন মুলুকের নামীদামি মনোবিজ্ঞানীরা (লোকাল 

বাংলায় যাঁদের বলে ‘পাগলের ডাক্তার’) ট্রাম্পকে পাগল বলে আসছেন। ট্রাম্প যে সত্যিই মানসিকভাবে সুস্থ নন, তা প্রমাণ করতে তাঁরা শত শত প্রমাণ হাজির করেছেন। সেই প্রমাণগুলোকে মনোবিজ্ঞানের ছাঁচে ফেলে বিচার করতে গেলে ট্রাম্পকে পাগল বলা ছাড়া উপায় থাকে না।

কিন্তু কথা হলো, পাগলের ডাক্তারদের এসব প্রামাণ্য কথায় ট্রাম্পের পাগলামি কমেনি বরং বেড়েছে। ট্রাম্প বুঝে গেছেন, বাজারে এখন পেঁয়াজের চেয়েও পাগলামির দাম বেশি। পাবলিক পাগলামিটাই বেশি খাচ্ছে। এ কারণেই তিনি ঠান্ডা মাথায় মাথা গরম করছেন।

 ‘মাথা গরম’ রোগ মূলত দুই পদের। একটা বারোমাসি, আরেকটা সিজোনাল। বারোমাসিরা রাউন্ড দ্য ইয়ার গরম থাকে। সিজোনালদের প্যারাডক্সিক্যাল মাথা সাধারণত শীতকালে গরম হয়।

এই শীত শীত মৌসুমে যেকোনো লোকের মাথা গরম করে দেওয়ার মতো খবর হলো, বাংলাদেশে বর্তমানে ‘মাথার দোষ’ আছে এমন লোকের সংখ্যা ১৬ শতাংশ বা ২ কোটি ১৫ লাখ। ডাক্তারি পরিভাষায়, কোনো না কোনোভাবে এই লোকগুলো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। এদের মধ্যে ‘বদ্ধপাগল’, ‘সেমি-বদ্ধপাগল’, ‘আধা পাগল’, ‘তার ছিঁড়া পাগল’ থেকে শুরু করে ফট করে হট হয়ে যাওয়া লোকজন আছে। আছে নীরব অবসাদগ্রস্ত ও হতাশাগ্রস্ত মানুষ। আছে রাতের পর রাত ঘুম না আসা উদ্বেগাক্রান্ত মানুষ। আছে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্যানিক ডিজঅর্ডারে ভোগা মানুষ।

‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ, বাংলাদেশ: ২০১৮-১৯’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এই তথ্য দিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সার্বিক সহযোগিতায় এই জরিপ হয়েছে। কাজেই এই তথ্যকে সিরিয়াসলি না নিয়ে উপায় নেই।

জরিপে দেখা গেছে, যাঁদের মানসিক রোগ আছে, তাঁদের শতকরা ৯৫ জনই ডাক্তারের কাছে যান না। কারণ, মানসিক রোগ যে একটা রোগ এবং এই রোগে যে তাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তা-ই তাঁরা স্বীকার করেন না। নিজেদের পাগল ভাবতে পাগলদের যেমন ইগোতে লাগে, তেমনি মানসিক ডাক্তারের কাছে যেতেও আত্মসম্মানে ঘাই লাগে। জরিপ আরও বলছে, অসুস্থ লোকগুলোর চিকিৎসার জন্য সারা দেশে মোটে ২০০ জন সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন। মানে, প্রতি ২ লাখ অসুস্থ লোকের জন্য একজন করে সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন। অর্থাৎ গোটা দেশেই এখন নীরব ও সরব পাগলদের ‘হাটবাজার’। এই জরিপ প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবছর যেসব ‘পাগলের মেলা’ বসে, ভবিষ্যতে সেসব মেলার জৌলুশ আরও বাড়ার বিরাট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

মানসিক রোগগ্রস্ত তথা ‘পাগল’দের এই ‘বাম্পার ফলন’-এর উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হতে পারে। তবে গবেষণা ছাড়াই মোটাদাগে বলা যায়, মানসিক সমস্যা ও পাগলামিকে অসুস্থতা হিসেবে না দেখে হাসির খোরাক হিসেবে দেখা এর মূল কারণ। মানসিক রোগ নিয়ে তীব্র তাচ্ছিল্য করাও যে এক গভীরচারী সামাজিক রোগ, পাগলামিকে পাত্তা না দেওয়াও একধরনের মানসিক রোগ, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

তবে মানসিকভাবে অসুস্থ না হয়েও ‘পাগল’ আখ্যা পাচ্ছেন—এ সমাজে এমন লোকের সংখ্যাও কম না। যেকোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থান নেওয়া লোকের এই ধরনের তকমায় আটকে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। দেশের চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ঘরোয়া আলোচনাতেও বিরুদ্ধবাদী বা ভিন্ন আচরণকারীরা যখন-তখন পাগল আখ্যা পেয়ে যেতে পারেন। এমনকি এই রোগ নিরাময়ের দায়িত্ব যাঁদের ওপর, সেই চিকিৎসককুলও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে বসতে পারেন। সুস্থ লোকেরা তাঁদের কাউকেও ‘পাগল’ তকমা দিয়ে উন্মাদাশ্রমে পাঠাতে পারেন।

যাঁরা নিয়মিত ‘কথা’ শোনেন এবং নিজেদের ‘অবিডিয়েন্ট পিউপিল’ এবং ‘ভয়েস হিয়ারিং পারসন’ হিসেবে তৈরি করতে পেরেছেন, তাঁরা কমবেশি এই রোগ থেকে মুক্ত। তাঁরা নিজেদের জীবন, সংসার, প্রেম, সন্তান, সরকার—সব ম্যানেজ করে চলতে পারেন। আর পারেন বলেই তাঁরা পাগল নন। তাঁরা সুস্থ।

মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু এটা কি ধরে নেওয়া যায় যে ‘ভয়েস হিয়ারিং পারসন’-এর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আর কমে যাচ্ছে বলেই কি ‘অসুস্থ’ লোকের সংখ্যা বাড়ছে।

যদি কারও দেহের অসুখ হয়, তাহলে পরিবার ঘটিবাটি বেচে হলেও চিকিৎসা করায়। তাঁকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার কথা কেউ মুখে আনে না। অথচ কারও মাথা গরম হয়ে গেলে, মানে কেউ মনোরোগী হলে, তাঁকে বের করে দেওয়াই দুরস্ত মনে হয়। মানসিক রোগ হলেই তাঁকে দাগিয়ে দিয়ে, তাঁকে ‘অযোগ্য’ প্রমাণ করে ব্রাত্য করে দেওয়া হয়। সেই পুরোনো ধারণা সবার মনে চাগাড় দিয়ে ওঠে, পাগলের আবার চিকিৎসা কী?

অথচ বেশির ভাগ মনোরোগী ঠিকমতো চিকিৎসা পেলে সুস্থ হন। এই চিকিৎসার উপশম যতটা না শিশি–বোতলে পোরা কিংবা প্যাকেটে মোড়ানো ওষুধে, তার চেয়ে বেশি বাধাহীন নির্মল মুক্ত নিশ্বাসে। সিলিন্ডারের অক্সিজেন নয়, মুক্ত বাতাসের অক্সিজেনের মধ্যেই এই মাথা গরমের ওষুধ নিহিত। শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিবেশই যখন এই রোগের মূল কারণ, তখন মুক্ত বাতাসেই তার শেফা। 

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]