কুর্দিদের জাতিরাষ্ট্র ও আমেরিকার লোভ

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

জাতিরাষ্ট্রের ধ্যানধারণা দুই শতক ধরে অন্য সব রাজনৈতিক কাঠামোকে নিষ্ক্রিয় করে পৃথিবীকে জাতিভিত্তিক ভূখণ্ডে বিভক্ত করেছে। নিজ দেশে বিদেশি বানিয়েছে কোটি কোটি মানুষকে। জন্ম দিয়েছে রক্তাক্ত ইতিহাস। জাতিরাষ্ট্রের এই নির্মমতা আঁচড় করতে পেরেই প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চ্যাটার্জি তার The Nation and Its Fragments গ্রন্থে ‘জাতিরাষ্ট্রকে তাত্ত্বিক দিক থেকে আধুনিক দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্বল একটি ধারণা’ হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। 

কিন্তু এক শ বছর ধরে দুর্বল এই ধারণাকে অমর মেনে, ধর্মীয় ভাষা আর আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদে ভর করে, নিজ রাষ্ট্র গঠনেই সমাধান দেখছে প্রতিটি জাতি। যে মিছিলে সর্বশেষ শামিল হয়েছে কুর্দিরা। মার্কিনদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনবরত যুদ্ধের নতুন মিত্র কুর্দিরা পশ্চিমা সনদে বিপ্লবী হয়েছেন মার্ক্সবাদের আদর্শ বিকিয়ে দিয়ে। আমেরিকা ও ন্যাটোর বন্ধু হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তন করে নতুন জাতিরাষ্ট্র ‘কুর্দিস্তানের’ উত্থানে কাজ করছে তারা। সন্দেহাতীতভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন জাতিরাষ্ট্রের উত্থান আবার অগণিত মানুষকে নিজ ভূখণ্ডে বিদেশি বানাবে; যেভাবে ব্রিটিশের হাত ধরে আধুনিক ইরাক, ইরান, তুরস্ক আর সিরিয়া গঠনের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ কুর্দি নিজ ভূখণ্ডে বিদেশি হয়েছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ে প্রায় এক হাজার বছরের তুর্কি প্রতাপের অবসান ঘটে মধ্যপ্রাচ্যে। প্রথাগত ক্ষমতা কাঠামোয় আকস্মিক শূন্যতা তৈরি হয়। আর ওই শূন্যতার মধ্যেই মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুর্কিদের ইউরোপমুখী যাত্রা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিকে মধ্যপ্রাচ্যে গেড়ে বসার সুযোগ দেয়। এই সুযোগে পশ্চিমারা বিশেষ করে ইংরেজ আর ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তি অনেকটা ভারতীয় উপমহাদেশের ঢঙে আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সীমানা নির্ধারণ করে কুর্দিদের চারটি বড় রাষ্ট্রে—তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া আর ইরানে সংখ্যালঘুতে পরিণত করে। পশ্চিমা ধাঁচের জাতিরাষ্ট্র গড়তে গিয়ে ধাপে ধাপে কামাল আতাতুর্ক থেকে শুরু করে সাদ্দাম আর আসাদ পরিবার কুর্দিদের নিষ্পেষিত করেছে। নিজেদের সংস্কৃতি ভাষা আর ধর্মীয় বিশ্বাস ধরে রাখতে কুর্দিরা সংগ্রাম শুরু করলে পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ঠেকানোর নামে সেই আন্দোলন–সংগ্রামে ভরণপোষণ দেয়নি। কুর্দি ও আরবসহ হাজার হাজার মানুষ জীবন দিয়েছেন সেই আন্দোলনে। ওদিকে আরব জাতীয়তাবাদীরাও গড়ে তুলতে পারেনি কোনো অর্থপূর্ণ রাষ্ট্র। বরং রাষ্ট্র হয়েছে নির্যাতন ও নিধনের প্রতীক। ভঙ্গুর এই অবস্থার মধ্যেই আবার মধ্যপ্রাচ্যে নতুন জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব হচ্ছে। তবে এবার ব্রিটিশ নয় মার্কিনদের হাত ধরে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে মার্কিনরা নিজ স্বার্থে নানা দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উসকানি দিয়ে জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোকে দুর্বল করতে চেয়েছে। ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তায়ন। বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোকে। সমকালীন ইরাক, নাইজেরিয়া, ভেনেজুয়েলা, আর চিলি তার মধ্যে অন্যতম। মোটা দাগে এই দেশগুলোতে মার্কিনরা গণতন্ত্র পাচারের নামে সম্পদ দখলে সফল হলেও তাদের অনুগত দেশি শক্তি দিয়ে কোনো সশস্ত্র বাহিনী গড়তে পারেনি। শুধুই সেনাবাহিনী অথবা বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে উসকানি দিয়ে কাজ সেরেছে। কিন্তু সিরিয়ায় মার্কিনরা নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছে সিরীয় কুর্দিদের একাংশের সহায়তায়। যারা মার্কিনদের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে সিরিয়ার তেল সম্পদে মার্কিন দখলদারি নিশ্চিত করছে।

ফ্রি সিরিয়ান আর্মি নিজেদের দখলকৃত এলাকার তেলকূপগুলোতে মার্কিন মালিকানা নিশ্চিত করার বিনিময়ে নিজেদের স্বপ্নের জাতিরাষ্ট্র ‘কুর্দিস্তান’ গঠন করতে চায়। প্রায় অর্ধযুগ কুর্দিদের অঞ্চলে থেকেছি। ভাষা শেখার পাশাপাশি রাজনীতিক সংগ্রাম দেখার অভিজ্ঞতার জায়গা থেকেই বলছি, যদি কুর্দিদের দুর্দশার দমনে মার্কিন সমর্থনে ‘কুর্দিস্তান’ নামক জাতিরাষ্ট্রই একমাত্র সমাধান হয়ে থাকে, তাহলে তা সমাধান না হয়ে বরং মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হবে কুর্দিদের জন্য। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি স্থান, শহর থেকে শুরু করে পল্লি অঞ্চল পর্যন্ত একই সঙ্গে নানা ভাষা আর ধর্মের মানুষের বসবাস। যে অঞ্চলকে নিয়ে ‘কুর্দিস্তান’ গড়তে চায় কুর্দিরা, ওই অঞ্চলে গড়পড়তায় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পর্যন্ত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী বাস করে। ওই সব জনগণ; আরব, তুর্কমেনি, ইয়াজিদী, অ্যাসিরিয়ানসহ খ্রিষ্টানরা কি কুর্দিদের নেতৃত্ব মেনে নেবে? তাদের ভাষা, ধর্ম আর সংস্কৃতি কি সমাদর পাবে? সে দেশের নাম এককভাবে কুর্দিদের নামে হবে কেন? এই সব প্রশ্নে ঐকমত্যের আশ্রয় না নিয়ে জাতীয়তাবাদের হুজুগ আর মার্কিন সমর্থনে যেকোনো রাষ্ট্রের উদ্ভব মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান চিত্র থেকে নতুন কিছু অঙ্কন করবে না।

ইরাক আর সিরিয়ার বড় বড় শহরগুলো আজ শিয়া, সুন্নি, আরব, কুর্দিসহ নানা গ্রুপ ও উপদলে বিভক্ত। উপাসনালয় থেকে শুরু করে পাবলিক স্পেস, সবকিছুই আলাদা আলাদা। শিয়া–সুন্নি, আরব আর কুর্দিদের মধ্যে বিয়ে, ব্যবসা ও সামাজিক বন্ধন ক্রমাগত নিঃশেষিত হয়েছে। সাদ্দামের পতনের পর সুন্নি জনগোষ্ঠী প্রান্তিক হয়েছে রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে। আর সাদ্দাম–পরবর্তী সরকারি নীতি সুন্নিদের সমাজচ্যুত করেছে। সুন্নিদের আকস্মিক এই পতনে সুদিন ফিরেছে শিয়াদের, যা বাগদাদে তেহরানকে চালকের আসনে বসিয়েছে। অবস্থা এমনই ভয়াবহ যে ইরাক যেকোনো সময়ে শিয়া, সুন্নি আর কুর্দি রাষ্ট্রে বিভক্ত হতে পারে।

মার্কিনদের কুর্দি রাষ্ট্রের প্রতি মোহ থেকেই নিন্দুকেরা প্রশ্ন তুলছেন, যদি জাতিরাষ্ট্রই সমাধান হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে মার্কিনরা কেন ছয় দশকের ফিলিস্তিনিদের সাহায্য না করে বরং সন্ত্রাসী আখ্যা দিচ্ছে, কেন গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের রক্ষায় কয়েকটি বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত দিয়েছে, কেন কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনে আওয়াজ না তুলে মোদিকে জনসভার জন্য মার্কিন মুলুকে ডেকেছে। বেলুচিস্তানসহ আফ্রিকার অনেক অঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলনে সায় না থাকলেও কেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে মার্কিনদের এই বিপুল আগ্রহ। তবে কি তা শুধুই সিরিয়া, ইরাকের অবাধ তেল সম্পদ কবজা করা আর ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে হানাহানি জিইয়ে রেখে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করার জন্যই?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজবাদী চিন্তাচেতনা জাতিরাষ্ট্রের জয়গানকে স্বল্প পরিসরে গতিহীন করলেও সোভিয়েত–পরবর্তী একক মার্কিন কর্তৃত্বের দিনে জাতিরাষ্ট্রের জয়গান আবার শুরু হয়েছে। সুবিধামতো সময়ে মার্কিনরা ছোট ছোট জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের লোভ দিয়ে যুদ্ধে নামিয়ে, বন্দুকের ব্যবসার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা বলে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করে। যার সফল চিত্রায়ণ হয়েছে ইরাক, সিরিয়ায় আর লাতিন আমেরিকায়। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম পেট্রল উৎপাদক ইরাকে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে রুটি, পানি আর বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে। চিন্তা করা যায়! যখন কুর্দিরা নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র নির্মাণে ব্যস্ত, তখন ইরাক আর সিরিয়া থেকে উত্তোলিত পেট্রলের অর্থ ভাগাভাগি হয় পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে। মেসোপটেমিয়া সভ্যতার নিদর্শনের রক্ষক জাদুঘরগুলো লুট ও নিঃশেষ হয়েছে, জাতিগত যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেছে হাজার বছরের ইতিহাস। জাতিরাষ্ট্রের লোভ দিয়ে আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে পশ্চিমার পুরো একটি সভ্যতাকে লুট করেছে। তাই জাতিরাষ্ট্রের ধারণা বাদ দিয়ে কুর্দি, আরব, সিরিয়সহ সব জনগোষ্ঠীর ঐকমত্যের শাসন হাঙ্গামা আর পশ্চিমা লুট বন্ধ করতে পারে।

রাহুল আনজুম: ইস্তাম্বুলে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সাবেক শিক্ষার্থী।