জনতার 'সিন্ডিকেট' কোথায়?

‘আজকে আমাদের দেশে মারাত্মক ইউনিটি দেখি আমি। একতা। কাদের মধ্যে? সেটা হলো—যেমন মোটরযান চালকের মালিক বাহিনী। এদের মধ্যে একতা আছে। মোটর যান চালকদের যে শ্রমিক বাহিনী; এদের মধ্যেও একতা আছে। পেঁয়াজের যাঁরা আড়তদার-মজুতদার; এদের মধ্যেও কিন্তু ইউনিটি আছে। আবার লবণের ব্যবসায়ী যারা আছে; এদের মধ্যেও ইউনিটি আছে। মানে যত সংগঠন আমি দেখি, শ্রমিক মালিক সবার মধ্যে ইউনিটি আছে। শুধু ইউনিটি নাই জনগণের মধ্যে’—হুবহু এই কথাগুলো মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের। 

গত ২৩ নভেম্বর রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে তিনি নিদারুণ খেদের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন। কথাগুলোর মূল সুর ছিল, যত অশুভ ও নিকৃষ্ট লোকেরা যখন সংঘবদ্ধ ও সংহত ঠিক তখন সাধারণ মানুষ বিক্ষিপ্ত ও ছত্রভঙ্গ। ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তাদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই।

এখন ২০১৯ সাল। আক্ষরিক অর্থেই ‘আজি হতে শতবর্ষ আগে’ অর্থাৎ ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতির এই কথাগুলো বলেছিলেন তাঁর ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’ কবিতায়: ‘সর্বোৎকৃষ্টরা হয়ে যাচ্ছে প্রত্যয়হীন আর নিকৃষ্টতমরা আজ সুখের তীব্রতায় আপ্লুত’ (দ্য বেস্ট ল্যাক অল কনভিকশন, হোয়াইল দ্য ওয়ার্স্ট আর ফুল অব প্যাশনেট ইনটেনসিটি)।

এর আগে আছে অযুতবিশ্রুত সেই দুটি লাইন: ‘চুরমার হচ্ছে সব, কেন্দ্র আর আগলাতে পারছে না/ রাজ্যের ফিৎনা-ফ্যাসাদ নাজিল হচ্ছে জমিনের বুকে’ (থিংস ফল অ্যাপার্ট, দ্য সেন্টার ক্যান নট হোল্ড/মেয়ার অ্যানার্কি ইজ লুজড আপন দ্য ওয়ার্ল্ড)।

ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, প্রশাসন, চিকিৎসা, পরিবহন—সমস্ত ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট একতাবদ্ধ হয়ে সব বিধি–শৃঙ্খলা চুরমার করে ফেলছে। তাদের ‘ইউনিটি’ এতটাই জোরালো হয়ে উঠেছে যে ‘সেন্টার ক্যান নট হোল্ড’। একদিকে অশুভ শক্তির ‘ইউনিটি’, অন্যদিকে সুস্থ চিন্তার দুর্বলচিত্তের মানুষের অনৈক্য। এই দ্বৈতের বাইরে কিছু নেই। ‘ওয়ার্স্ট’ আপন নিকৃষ্টতায় ‘বেস্ট’ এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আছে। আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের মহিমা যেহেতু আগেই অস্তমিত হয়েছে সেহেতু আড়তদার-মজুতদার, দালাল-ফড়িয়া, শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রেড ইউনিয়ন, অমুকের অনুসারী, তমুকের ‘ছোট ভাইয়েরা’ সংহত হবেই।

পেঁয়াজের দাম নিয়ে দেড় মাসের বেশি সময় ধরে দেশে যা চলছে তা ইতিহাস তৈরি করেছে। ঘাটতিকে কাজে লাগিয়ে আড়তদার-মজুতদারদের সিন্ডিকেট পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি আড়াই শ টাকার বেশিতে নিয়ে গেছে। অবস্থা সামাল দিতে কার্গো প্লেনে উড়িয়ে পেঁয়াজ আনা হয়েছে। বহু দেশ থেকে পেঁয়াজের জাহাজ আসছে বলে আদার ব্যাপারী থেকে ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’—সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাজারে যে পরিমাণ নতুন পেঁয়াজ উঠেছে তাও কম না। অন্তত সে কারণে হলেও পেঁয়াজের দাম পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই ‘ওয়ার্স্ট’দের ইউনিটি এবং ‘বেস্ট’দের ‘ডিজইউনিটি’ মজুতদার চক্রের পাতানো খেলাকে এখনো জিইয়ে রেখেছে। পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পর্যন্ত মাঠে নেমেছে। শুল্ক গোয়েন্দারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, বগুড়া ও সাতক্ষীরার ১৪ জন পেঁয়াজ আমদানিকারককে রাজধানীতে ডেকে এনে বিভিন্ন তথ্য জানতে চেয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান প্রত্যেকেই গত সাড়ে তিন মাসে কমপক্ষে এক হাজার টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি করেছে। সে হিসেবে দেশে এত সংকট থাকার কথা না। এনবিআর মনে করছে, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির জন্য আমদানি করা পেঁয়াজ অবৈধভাবে মজুত করা হচ্ছে। শুধু এনবিআর নয়, সরকারের সব পর্যায় থেকে পেঁয়াজের ঝাঁজ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু হায়! ‘সেন্টার ক্যান নট হোল্ড’।

পেঁয়াজের ঝাঁজের মধ্যে চালের দাম লাফাতে শুরু করেছে। সরু চালের দাম এক মাসে ১২ শতাংশের বেশি বেড়েছে। চুয়াডাঙ্গায় হাটবাজারগুলোতে ধান-চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে প্রকারভেদে প্রতি মণ (৪০ কেজি) চালের দাম ৮০ থেকে ৩২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। পাইকারির এই দামের প্রভাব খুচরা বাজারেও পড়েছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল তিন থেকে চার টাকা ও সরু চাল আট টাকা পর্যন্ত বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে সারা বছরে যত চাল কেনাবেচা হয়, এককভাবে তার সবচেয়ে বড় অংশ এখন ৫০টি বড় চালকল প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। দাম ওঠানো নামানোর বিষয়ে তারা এককাট্টা হয়ে কাজ করে। বাজারে কত দামে চাল বিক্রি হবে, তা-ও এই চালকলমালিকেরা নির্ধারণ করছেন। এমনকি চাল আমদানি ও রপ্তানি কখন করতে হবে কখন করা যাবে না তা ঠিক করার ক্ষেত্রেও তাঁদের ভূমিকা প্রধান।

দাম বাড়া দেখে পাবলিকের যখন কপালে ভাঁজ খাওয়া শুরু হয়েছে, তখন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘চালের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে সরকার চিন্তিত নয়। এত দিন চালের দাম আসলে অতিরিক্ত কম ছিল। এখন দাম বাড়ায় কৃষক লাভবান হচ্ছে।’ তাঁর কথার সঙ্গে চাল ব্যবসায়ীদের কথার বেশ মিল পাওয়া যাচ্ছে। তাঁর কথার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের অভাবনীয় ‘ইউনিটি’র গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

সারা দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় যে ঘোর নৈরাজ্য চলছে তা নতুন করে বলার কিছু নেই। সেখানে লাইসেন্সহীন, ফিটনেসহীন গাড়ির মালিক ও চালকদের ঐক্য সোনা দিয়ে বাঁধাই করে রাখার মতো। সরকার যখন গোটা ব্যবস্থাকে একটু নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে, যখন সড়ক আইন কার্যকর করতে যাচ্ছে, তখনই আমরা মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সেই ‘ইউনিটি’ দেখছি। সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ লোকও তাঁদের সেই ইউনিটিকে ইউনিক আইডিয়া বলে স্বাগত জানাচ্ছেন।

বলা বাহুল্য হলেও বলা দরকার, আইন প্রণয়নকারী ও আইনরক্ষকেরা শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমন করেন। প্রয়োজনে সরকারের কঠোর হওয়ার সামর্থ্য আছে—সমাজের অভিজ্ঞতালব্ধ এই বিশ্বাসই সরকারের বিশিষ্টতা প্রতিষ্ঠিত করে। জনগণের বিশ্বাসই সরকারের শক্তির মূল। যে সমাজে দুর্বৃত্তের ঐক্য জনগণের সামনে সরকারের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসে এবং ‘সেন্টার’ যখন গোটা ব্যবস্থা ‘হোল্ড’ করতে পারে না, সেই সমাজ জঙ্গলের নিয়মে চলে যায়। সেই রাষ্ট্রে জোর যার, সমাজ তারই নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পাবলিকের অনৈক্য ও দুর্বৃত্তের ঐক্যের পিঠে ভর করে এই সমাজ দৃশ্যত প্রবল বেগে সেই দিকে ছুটছে। কেন কর্মকর্তারা আড়তদার মজুতদারদের ‘ইউনিটি’র কাছে নতিস্বীকার করেন, কেন তাঁরা সাধ্য থাকলেও শিষ্টের পালনে সক্রিয় হন না, সেসব প্রশ্নের হাতেগরম উত্তর হচ্ছে—রাজনীতি তথা অপরাজনীতি।

দুর্বৃত্তের ঐক্যের বাড়বাড়ন্ত যেহেতু শতধা বিভক্ত ‘জনগনমন’কে ক্রমাগত বঞ্চনার গহ্বরে নিক্ষেপ করছে, সেহেতু নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে জনতা আচমকা ‘ঘন সন্নিবিষ্ট তাম্রলিপির মতো’ যূথবদ্ধ হয়ে উঠবেই। ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’এর মতো আড়তদার–মজুদদার ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদের ঐক্যের বিরুদ্ধে মজলুম ভোক্তাদের প্রতি–ঐক্য অনিবার্য হয়ে উঠবেই। আজ নয়তো কাল। কারণ ‘ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে’।

সারফুদ্দিন আহমেদ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]