'পিডাইয়া মাইরালা'

অলংকরণ:প্রথম আলো
অলংকরণ:প্রথম আলো

বছর আটেক আগে এক শবে বরাতের রাতে বন্ধুরা সবাই মিলে মসজিদে গিয়েছিলেন নামাজ পড়ে পরের বছরের সৌভাগ্য চেয়ে আনতে। নামাজ শেষে তাঁরা চাঁদনী রাতে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামসংলগ্ন কেবলার চরে বেড়াতে যান। স্থানীয় বক্তিরা ডাকাত সন্দেহে তাঁদের আটক করে মারধর শুরু করেন। মসজিদের মাইকে ডাকাত ধরা পড়ার খবর এলান করে দেওয়া হয়। সাত বন্ধুর ছয়জনই সেদিন রাতে গণপিটুনিতে নিহত হন। রাজধানী ঢাকার পাশেই আমিনবাজার ১৭ জুলাই, ২০১১ সালের সেই ঘটনা সে সময় সবাইকে বিচলিত করেছিল। নিহত ছয়জনের মধ্যে একজন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং বাকিরা ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র। তিনজন ছিলেন বাঙলা কলেজের ছাত্র।

বাঙলা কলেজের বন্ধুরা এক দিন রাস্তা বন্ধ করে প্রতিবাদ করেন। তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে স্থানীয় লোকদের অভিযুক্ত করে একটি হত্যা মামলা করা হয়। পুলিশের চাপ ঠেকাতে আমিনবাজারে বড়দেশী এলাকার বালু ব্যবসায়ী আবদুল মালেক স্থানীয় ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে একটি ডাকাতির মামলা করেন। পরে বিচার বিভাগীয় তদন্তে নিহত ছাত্রদের অপরাধের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অনেক জট কাটিয়ে দুবছর পর ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি ঢাকার সংশ্লিষ্ট আদালতে পুলিশের করা মামলার অনুকূলে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ওই বছরের ৮ জুলাই ৬০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন আদালত। এরপর ছয় বছর পার হলেও বিচারকাজ শেষ হয়নি। হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে ৬ জন পলাতক, ১ জন কারাগারে, ৫২ জন জামিনে এবং ১ আসামি মারা গেছেন। গণপিটুনি নিয়ে এর আগে কোনো মামলা এত দূর এগোনোর রেকর্ড নেই।

রাজধানীর আশপাশের ঘটনা আর কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় কিংবা প্রচারমাধ্যমের ক্রমাগত ফলোআপ ইত্যাদি কারণে হয়তো মামলাটা শামুকের গতিতে হলেও এগিয়েছে। একই বছর ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে শামছুদ্দিন মিলন নামের এক নিরপরাধ তরুণকে পুলিশ আটকের পর ডাকাত ধরার খবর রটিয়ে তাঁকে মারমুখী জনতার হাতে তুলে দিলে জনতা পিটিয়ে মেরে ফেলে। পুলিশ জানিয়ে দেয় ডাকাত সন্দেহে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে জনতা তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে। দেশে তখনো সেভাবে স্মার্টফোনের এত রমরমা ছিল না, তারপরও সে ঘটনার ভিডিও সে সময় ফেসবুকে ছড়ায়। সেখানে কারা কারা পিটিয়েছে, সেটা খুব পরিষ্কার হয়ে যায়। তবু আট বছরে মামলাটি তদন্তেই আটকে আছে। ২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা ইউনিয়নের হিলটন বাজার এলাকায় গণপিটুনিতে পাঁচজন নিহত হন। ২০১৬ সালের ১১ মার্চ একই উপজেলার চেয়ারম্যানঘাট এলাকায় ডাকাত সন্দেহে চারজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মানুষ মনে রাখে না। পুলিশও ভুলে যায় হাজারটা কাজের চাপে। পিটিয়ে মারা বন্ধ হয় না। বরং পিটিয়ে মারার পক্ষে জনমত দিনকে দিন প্রবল হতে থাকে।

ভাদুরি বাড়ির মিষ্টি মেয়ে গুড্ডি থেকে পদ্মা নদীর মাঝি সিনেমার কপিলা, পশ্চিম বাংলার তৃণমুলের সাংসদ–অভিনেত্রী মিমি শুরু করে আমাদের ভাটি অঞ্চলের সহজ–সরল জননেতা পর্যন্ত বলছেন, ‘পিডাইয়া মাইরালা’। আবরার হত্যার পর মনে হয়েছিল মানুষ হত্যার এই ধারাটা থেমে না গেলেও অন্তত থমকে যাবে। হত্যার নেশায় আচ্ছন্ন মাতালেরা চুপ থাকবে কিছুদিন। সেটা হয়নি। বরং অন্যায়–অবিচার, অপরাধ দমনের সহজ আর দ্রুততম পথ হিসেবে ‘এখুনি মেরে ফেলার’ চর্চাটা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ‘গণপিটুনিতে মৃত্যু’ কিংবা ‘গণপিটুনিতে জীবনাবসান’ এ ধরনের শিরোনাম দেখে আমরা এখন আর আঁতকে উঠি না। বরং নিজেরটা না গেলে ভাবি, ঠিকই হয়েছে। নিশ্চয়ই নিহত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা দাগি অপরাধী ছিলেন। দাগি অপরাধী হলেও যে একজনকে পেটানো বা পিটিয়ে মেরে ফেলা যায় না, সেটা যেমন আবরার হত্যাকারীদের বোধের মধ্যে ছিল না, তেমনি আমাদের বোধ–বুদ্ধিতেও নেই। তাই রোজদিন খবর আসে, রাজধানীতে পুলিশের ‘সোর্সকে’ পিটিয়ে হত্যা, নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় টিনের চাল বেয়ে বৃষ্টির পানি পড়া নিয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যা, মাদক নিরাময়ের নামে কুষ্টিয়ায় কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা, আটঘরিয়ায় শিক্ষক নেতাকে পিটিয়ে হত্যা, কুড়িগ্রামে ফল বাকি না দেওয়ায় ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে আহত করেছে পুলিশ ইত্যাদি ইত্যাদি। বলা বাহুল্য এঁরা কেউই চোর–ডাকাত বা ছিনতাইকারী সন্দেহে কিংবা হাতেনাতে ধরা পড়া ব্যক্তি নন। নিতান্তই ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের উপাদন হয়ে উঠছে গণপিটুনি।

গত ২২ মাসে পিটিয়ে হত্যা বা আহতের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৬০০ জন। মূলত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং কিছু অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত খবর পর্যালোচনা করে এই তথ্য মিলেছে। এই হিসাব রীতিমতো আতঙ্কের। কারণ, গত জুলাই মাসে (২০১৯) আইন সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত মোট সাড়ে আট বছরে সারা দেশে গণপিটুনিতে নিহত হন প্রায় ৮২৬ জন। সাড়ে আট বছরে যেখানে ৮২৬, সেখানে মাত্র ২২ মাসে ৬০০ জন গণপিটুনির শিকার হওয়া কি আমাদের বেপরোয়া হয়ে ওঠাকে ইঙ্গিত করে না? গণপিটুনির পক্ষে যে যতই ওকালতি করুন না কেন, এটাকে অপরাধ দমনের ন্যায্য তরিকা ভাবলে বড়ই ভুল হবে। ভুল হবে যদি ভুলে যাই পাবনার ঘটনা—২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট পাবনায় অপহরণকারী সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় তিন ব্যক্তিকে। পরে জানা যায়, ওই তিনজনই ছিলেন ব্যবসায়ী। অপহরণকারী গুজব রটিয়ে একটি মহল তাঁদের গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করিয়েছিল। ওই তিনজনই পেশায় ব্যবসায়ী এবং একে অপরের আত্মীয়।

আইন কী বলে
বাংলদেশ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, অপরাধী (চোর) হাতেনাতে বা সন্দেহজনকভাবে ধরা পড়লে তাঁকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতে হবে। না করলে দণ্ডবিধি ১৮৭ ধারা অনুযায়ী যে বা যারা আটকে রেখেছে, তাদের কমপক্ষে ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। আর আটক ব্যক্তিকে উদ্ধারে যাওয়া পুলিশকে বাধা দিলে দণ্ডবিধির ১৮৬ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান আছে।

কাউকে আটক রাখার পর তাঁকে পিটুনি বা ধোলাই দেন, তবে কারাদণ্ডের আগে মেয়াদ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে অনূর্ধ্ব তিন বছর এক মাসে। সঙ্গে অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা তো থাকছেই। আইন এখানেই থেমে যায়নি। অনেক সময় মারতে মারতে গুরুতর আহত করা হয়। মেরে ফেলার ইচ্ছায় করা আঘাতে আটক ব্যক্তি মারা গেলে বা মেরে ফেলার ইচ্ছায় আঘাত না করার পরও কারও মৃত্যু—ইত্যাদি নানা বিষয় বিবেচনা করে নানা মাপের শাস্তি রাখা আছে আইনে।

বাংলদেশ ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা খুবই পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে, গণপিটুনিতে আপনার হিস্যা যা–ই থাক শাস্তি জড়িতদের সবার জন্য সমান। এখানে আইনের যৌথ দায়িত্বশীলতার নীতি আনুসরণ করা হয়েছে। একই ইচ্ছায় একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ ঘটালে বা ঘটতে দিলে, প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন যেন তিনি নিজেই অপরাধ করেছেন। এক থাপ্পড়ের যে শাস্তি ১০ কিল–ঘুষি বা পিঠে লাঠি বা উইকেট ভাঙারও সেই শাস্তি। আইন বলছে, গণপিটুনিতে যদি অপরাধীর মৃত্যু ঘটে, তবে তার দায় বর্তাবে অপরাধ সংঘটনকারী সব ব্যক্তির ওপর। গণপিটুনিতে কেউ মারা গেলে, পিটুনিতে অংশ নেওয়া সবাইকে সমানভাবে দায়ী করা যাবে।

তারপরও মানুষকে সমাজের মাথারাই বলছেন আইনের অপেক্ষায় থেকো না। ধরার সঙ্গে সঙ্গে ‘মাইরালা’। ‘মাইরালার’ ঝোঁক কিন্তু সুদূর প্রসারিত হতে পারে। সমাজে বিরাট নৈরাজ্য ও প্রাণঘাতী সংস্কৃতি ছড়িয়ে যেতে পারে। আইনের শাসনের তাই কোনো বিকল্প আছে কি?

লেখক: গবেষক
[email protected]