ঘাতকেরা বর্বরতার সব সীমা অতিক্রম করেছিল

>

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২, ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর দুই পলাতক আসামি আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ওই দুই কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ ১৭ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। দণ্ডিত ব্যক্তিরা কখনো আপিল করেননি। এই মামলার শুনানিতে সাক্ষীদের ভাষ্যে অনেক অজানা মর্মস্পর্শী তথ্য ও বিষয় উদ্‌ঘাটিত হয়। তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নথিপত্রের ভিত্তিতে কিছু বিষয় নির্বাচিত করেছেন। এর সবটাই মূলত শহীদদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি। পাঁচ কিস্তির এই নির্বাচিত অংশের চতুর্থ পর্ব প্রকাশিত হলো আজ।

[গতকালের পর]

অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর অপহরণ ও হত্যা

এই অভিযোগ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য দেন শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভ্রাতুষ্পুত্র ইফতেখার হায়দার চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে বেঁচে ফিরে আসা একমাত্র ভিকটিম দেলোয়ার হোসেন। ১৯৭১ সালে সাক্ষী ইফতেখার হায়দার চৌধুরী ছিলেন ৮ বছরের শিশু। তিনি তাঁর চাচি শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্ত্রী, তাঁর মা ও বাবার কাছ থেকে তাঁর চাচা অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শুনেছেন। অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর লাশ তাঁর পরিবার আর কখনো খুঁজে পায়নি। পরিবারের জন্য এটি কত যে কষ্টের! এই সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো—

সাক্ষী ইফতেখার হায়দার চৌধুরীর (শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভ্রাতুষ্পুত্র) সাক্ষ্যের অংশ:

 ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী আমার বড় চাচা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।...আমার চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর থেকেই দেশের ভাষা আন্দোলনসহ সকল প্রকার প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রতি তাঁর উচ্চকিত সমর্থন ছিল। তিনি ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষ। তিনি মুক্তচিন্তা এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।...তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকের উদ্যোগে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে যে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান চলছিল, তার প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিলেন।

‘১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর আমার চাচা নিরাপত্তাজনিত কারণে তাঁর ফুলার রোডের বাসা ছেড়ে আমাদের শান্তিবাগের বাসায় এসে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন।...আমার চাচা যখন আমাদের বাসায় চলে আসেন, তখন নুরু নামের একটি কাজের ছেলেকে তাঁর ফুলার রোডের বাসায় রেখে এসেছিলেন এবং তাকে তিনি বলে এসেছিলেন তিনি কোথায় যাচ্ছেন।

‘আমার বড় চাচি (শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্ত্রী), আমার বাবা এবং আমার মায়ের কাছ থেকে শুনেছি যে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আলবদরের একটি সশস্ত্র গ্রুপ মুখে কাপড় বাঁধা অবস্থায় দুপুরের দিকে ফুলার রোডের চাচার বাসায় যায় এবং নুরুর কাছ থেকে জানতে চায় মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সাহেব কোথায় আছেন। নুরু প্রথমে আমার চাচার অবস্থান জানাতে অস্বীকার করলে অস্ত্রের মুখে সে ভীত হয়ে চাচার অবস্থান জানায় এবং তারা তাকে সঙ্গে করে আমাদের শান্তিবাগের বাসায় নিয়ে আসে। বাসার কলাপসিবল গেট দারোয়ান খুলে দিলে ওরা ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে। বাসাটি দোতলা ছিল, আমরা নিচতলায় থাকতাম। দরজায় কড়া নাড়ার পর আমার বাবা লুত্ফুল হায়দার চৌধুরী সাহেব দরজাটি খুলে দিলে ৫–৬ জন অস্ত্রধারী মুখোশ পরা অবস্থায় আমার বাবাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করে, “হোয়্যার ইজ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী”। ...তখন আমার বাবা তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন তারা আমার চাচাকে খুঁজছে এবং কোনো ওয়ারেন্ট আছে কি না। প্রত্যুত্তরে তারা বলেছিল মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সাহেবকে ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে নিয়ে যাবেন এবং তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এই অবস্থায় একটু ধাক্কাধাক্কি করেই সশস্ত্র লোকগুলো ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং এরই একপর্যায়ে আমার বড় চাচা সামনে এসে বলেন আমিই মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। চাচাকে মুখোশধারীরা তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে আমার বাবা বলেছিলেন তিনি কাপড় পরিবর্তন করে তারপর যাবেন। মুখোশধারীদের একজন ঘরের ভেতরে আমাদের ডাইনিং টেবিলের পাশে অবস্থান করছিল।...একপর্যায়ে তিনি ওই মুখোশ পরা লোকটিকে বললেন আপনারা মুখোশ পরে আছেন কেন, এই বলে তিনি ওই লোকটির মুখে বাঁধা রুমালটি টান দিয়ে সরিয়ে ফেলেন। তখন আমার বড় চাচা ওই লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন “তুমি মঈনুদ্দীন না?” লোকটি উত্তরে বলেছিল “জি আমি মঈনুদ্দীন, আমি আপনার ছাত্র।” এই কথাগুলো আমরা সবাই আমার বাবা এবং চাচার পাশে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে ওই লোকটি আরও বলেছিল “আমি স্যারকে নিয়ে যাচ্ছি, ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়েই তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।” মুখের রুমালটি খোলার পর থেকে সে আর রুমালটি মুখে বাঁধেনি। আমার চাচাকে যখন নিয়ে যাচ্ছিল তখন বাড়িতে আমরা সবাই কান্নাকাটি করছিলাম, একপর্যায়ে কলাপসিবল গেটের কাছে গিয়ে আমার চাচা আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন আমি যেহেতু কোনো অন্যায় করিনি, আমি নিশ্চয়ই তোমাদের মাঝে আবার ফিরে আসব। আমার বড় চাচিসহ আমরা যখন এগোতে চেষ্টা করলাম, লোকগুলো আমাদেরকে বাইরে যেতে কঠোর ভাষায় নিষেধ করে এবং আমার চাচাকে একটি কাদামাখা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

‘১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০–১১টার দিকে আমরা যখন বুঝতে পারলাম দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, চারদিকে জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছে...। আমার বাবা এবং মেজো চাচা উভয়েই আমার বড় চাচার খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালান। চারদিক থেকে বিক্ষিপ্তভাবে খবর আসছিল এখানে-সেখানে অনেক লাশ পড়ে আছে। যেখানেই লাশ পড়ে আছে খবর পেয়েছেন আমার বাবা এবং মেজ চাচা সেখানেই গিয়েছেন বড় চাচার খোঁজে। ওই সময়ে আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।...আমার বাবা এবং চাচা রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে আমার বড় চাচার লাশ খুঁজতে গিয়েছিলেন। তারা সেখানে অনেক বিকৃত ও গলিত লাশ দেখেছিলেন কিন্তু আমার বড় চাচার লাশ তারা খুঁজে পাননি। আমরা শুনেছি আরও অনেকের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ’

কী পেলাম এই সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে? একজন ছাত্র তার শিক্ষকের ঘাতক। একজন ছাত্র তার শিক্ষককে অপহরণ করে নিয়ে যায়, হত্যা করে। সাহসী শিক্ষকের লাশটি তাঁর পরিবার ও স্বজনেরা খুঁজে পাননি। এমন বর্বরতার কোনো নজির কোথায় আছে জানি না। ওপরের কয়েকজন বিশিষ্টজন যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁদের কথা থেকেই উঠে এসেছে কীভাবে পরিকল্পিতভাবে একই দিনে শিক্ষকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কত ঠান্ডা মাথায় নির্মমভাবে তাঁদের নিধন করা হয়।

অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণ ও হত্যা

এই অভিযোগ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য দিয়েছেন শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর ও দেলোয়ার হোসেন, যিনি রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। ১৯৭১ সালে আসিফ মুনীর ছিলেন চার বছরের শিশু। তিনি ও তাঁর পরিবার শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর লাশটি খুঁজে পাননি।

আসিফ মুনীরের (শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র) সাক্ষ্যের অংশ:

 ‘আমার নাম আসিফ মুনীর ওরফে তন্ময়, পিতা শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। ১৯৭১ সালে আমি চার বছরের শিশু ছিলাম। আমার বড় ভাই ভাষণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার মা লিলি চৌধুরী (৮৪) এখনো জীবিত আছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি বাসায় অবস্থান করেন। আমার ভাই মিশুক মুনীরের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর পর থেকে আমার মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তিনি জনসমক্ষে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।

২০ সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা আমার দাদার বাসা। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে সেন্ট্রাল রোডের সেই বাসা থেকে আমার বাবা অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। আমার বাবা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। আমার বাবা একাধারে নাট্যকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ভাষাতত্ত্ববিদ ও শিক্ষক ছিলেন। তবে তিনি নাট্যকার হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বহুল প্রচারিত নাটক ছিল কবর, যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অবলম্বনে রচিত। এ ছাড়া তাঁর লেখা রক্তাক্ত প্রান্তর কলেজ পর্যায়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভাষাতত্ত্ববিদ হিসেবে তাঁর অবদান বাংলা ব্যাকরণ বই রচনার ক্ষেত্রে এবং বাংলা টাইপরাইটারের কি-বোর্ড মুনীর অপটিমা তৈরির ক্ষেত্রে অপরিসীম। বর্তমানে কম্পিউটারে বাংলা কি-বোর্ড ব্যবহৃত হয় তার ভিত্তি এই মুনীর অপটিমা কি-বোর্ড, যা বিজয় কি-বোর্ডের প্রবর্তক মোস্তাফা জব্বার তাঁর বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে আমার বাবার ধারণা হয় যে দেশ স্বাধীন হতে চলেছে, এই বিষয়ে তিনি পরিবারের সবার সঙ্গে আলোচনা করতেন। পরিবার থেকে বিভিন্ন সময় আমার বাবাকে নিরাপত্তার স্বার্থে এই বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার উপদেশ দেওয়া হলেও তিনি তাঁর মাকে ছেড়ে যেতে না চাওয়ায় সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। এরই একপর্যায়ে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, বেলা একটার দিকে যখন আমার বাবা মধ্যাহ্নভোজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তার আগে বাড়ির সদস্যরা বাড়ির লোহার গেটে ঝনঝনানির শব্দ পান। তখন দোতলা থেকে
জানালার পর্দা সরিয়ে আমার মা একটি মিনিবাস দেখতে পান, যার জানালাগুলোতে কাদা লাগানো ছিল এবং ছাদটি গাছের ডালপালা দিয়ে ঢাকা ছিল। আমার মা ওই মিনিবাস থেকে ৩–৪ জন তরুণকে নামতে দেখেন। ওই বাড়িতে অবস্থানরত আমার অপর চাচা শমসের চৌধুরী ওরফে রুশো দোতলা থেকে নিচে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে যান। তরুণদের মধ্য থেকে একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি মুনীর চৌধুরী?” তখন আমার রুশো কাকা উত্তরে বলেন, মুনীর চৌধুরী আমার বড় ভাই। তখন ওই তরুণেরা আমার কাকাকে বলে আপনি একটু মুনীর চৌধুরী সাহেবকে ডেকে দিন। আমার কাকা বাসার দোতলায় গিয়ে বাবাকে খবর দিলে তিনি লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় কাকাকে নিয়ে নিচে নেমে আসেন। আমার মেজ ভাই মিশুক মুনীর রুশো কাকার অনুরোধে গেটের তালার চাবিটি নিচে দিয়ে যান এবং ওপরে গিয়ে বারান্দা থেকে লুকিয়ে পুরো দৃশ্যটি দেখেন।

‘আমার মা আমার বাবাকে নিচে যেতে নিষেধ করেছিলেন। উত্তরে আমার বাবা বলেছিলেন যাই দেখি ওরা কী বলে। রুশো কাকা এবং আমার বাবার পেছনে পেছনে আমার মা–ও নিচে নেমে আসেন। আমার কাকা রুশো গেটের তালা খুলে দেন, বাবা আগত ৩–৪ যুবককে জিজ্ঞাসা করেন “তোমরা কী চাও”। জবাবে তারা বলে, ‘‘স্যার, আপনাকে একটু আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।” তখন আমার বাবা শহীদ মুনীর চৌধুরী একটু উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তোমাদের কাছে কি কোনো ওয়ারেন্ট আছে।” জবাবে তাদের একজন বলে, “আছে”—এই বলেই তাদের একজন আমার বাবার পেছনে এসে বন্দুক ধরে। তখন আমার বাবা রুশো কাকার দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিলেন “রুশো, তাহলে যাই”। আমার বাবা লক্ষ করেননি যে পেছন থেকে আমার মা এসব দৃশ্য দেখছিলেন। ওই ৩–৪ জন তরুণ আমার বাবাকে ঠেলে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। আমার বাবাকে আমাদের সেই শেষ দেখা।...সেই থেকে তাঁর কোনো সন্ধান পাইনি।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের পরে আমরা শুনতে পেলাম মিরপুর এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে অনেক বুদ্ধিজীবীর লাশ পড়ে আছে। তখন আমার রুশো কাকা এবং আমার বড় চাচা অধ্যাপক কবীর চৌধুরী রায়েরবাজারে আমার বাবাকে খুঁজতে যান। সেখানে পড়ে থাকা বিকৃত, আধা বিকৃত বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলোর মধ্যে আমার বাবার লাশ শনাক্ত করতে পারেননি। পরবর্তীতে আমার চাচা, ভাই পত্রিকার মারফত জানতে পেরেছিলেন সুপরিকল্পিতভাবে ওই সময়ে বাসা থেকে ধরে নিয়ে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি ১৪ ডিসেম্বরে আমার বাবাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাসহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করার ঘটনাগুলো আমার মা, রুশো কাকা ও আমার মেজ ভাই মিশুক মুনীরের (সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত) কাছ থেকে শুনেছি।’

সাংবাদিক, সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের অপহরণ ও হত্যা

এই অভিযোগ প্রমাণে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার। তিনি তাঁর স্বামীকে অপহরণ করে নিয়ে যেতে দেখেছেন। তারপর শহীদুল্লা কায়সার আর ফিরে আসেননি, এমনকি তাঁর লাশটিও তাঁর পরিবার খুঁজে পায়নি। সাক্ষী পান্না কায়সার ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার কিয়দংশ:

 ‘আমার নাম প্রফেসর পান্না কায়সার, স্বামী শহীদ সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার। ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১, আমাদের সকলের অতি প্রিয় শহীদ
সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন সাহেবকে আলবদররা বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমার স্বামী এ কথাটি আমাকে বলেননি, পরবর্তী সময়ে আমি জানতে পেরেছি। শহীদুল্লা কায়সার তখন...শুধু তাঁর প্রিয় পত্রিকা, সংবাদ–এর জন্য হেডলাইন, এডিটোরিয়াল, পোস্ট এডিটোরিয়াল লিখতে থাকেন এই আশায় যে দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে সেগুলো পত্রিকায় ছাপা হবে।

ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নূরুল ইসলাম সাহেব আমাদের বাসায় আসেন। ফিসফিস করে তিনি আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলে চলে যান। তাঁর চলে যাওয়ার পর আমার স্বামী আমাকে বলেছিলেন নূরুল ইসলাম তাঁকে বাসা ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলেছেন।... তিনি বললেন যে আলবদরদের অত্যাচার বেশি বেড়ে গেছে, সে জন্য এখানে থাকা বেশি নিরাপদ নয়।

১৩ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে তিনি কাপড়চোপড় গুছিয়ে...বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যান এবং যাওয়ার সময় ক্রন্দনরত তাঁর মা এবং আমাকে বলেছিলেন তোমরা কাঁদছ কেন, দু–এক দিনের মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, আমি চলে আসব।...কিছুক্ষণ পর তিনি আবার ফিরে চলে আসলেন, এসে বললেন যেখানে যেতে চেয়েছিলাম সেখানে তারা আমাদের সবার জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছে। তাই আগামীকাল আমরা সবাই সেখানে যাব। মা, আপনি পান্নাসহ তৈরি হয়ে নেন, কাল কারফিউ উঠলেই আমরা চলে যাব।...

 ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, কারফিউ আর শিথিল হয়নি। ওই দিন একটি ছোট্ট চিরকুট আমাকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছিলেন। আমার কাছে চিরকুটটি দিয়ে তিনি বলেছিলেন তোমাকে তো কোনো দিন প্রেমপত্র লিখতে পারিনি, এটি সেই প্রেমপত্র। চিরকুটটি আমি হাতে নিয়ে দুই লাইন পড়ে আমি আর পড়তে পারিনি। আমি চিত্কার করে বলেছিলাম, তুমি এসব কী লিখলে, আমি তো কোনোভাবেই নিজেকে সংবরণ করতে পারছি না। চিরকুটটিতে লেখা ছিল, “পান্না, যদি আমি না থাকি, আমার সন্তানদের তুমি আমার আদর্শে মানুষ করো।’ এই চিরকুটটিতে আরও লেখা ছিল, কিন্তু আমি এইটুকু লেখা পড়ার পরই তা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। আজ আমার অনুশোচনা হয়, কেন আমি তা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।

ওই দিনই আমি আসরের নামাজ পড়ে বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই চিরকুটটির কথাই ভাবছিলাম, ঠিক ওই সময় দেখি ৪–৫ জন যুবক আমাদের বাসার দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করছে। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়..., শহীদুল্লা কায়সার রেডিওর নব ঘুরিয়ে বিবিসি অথবা ভয়েস অব আমেরিকা শোনার চেষ্টা করছিলেন। আমি যুবকদের ইশারাটা সন্দেহজনক মনে করে বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে শহীদুল্লা কায়সারকে জানাই।...আমি যুবকদের সম্পর্কে বলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি চমকে ওঠেন এবং আমাকে আমি আর কী কী দেখেছি জিজ্ঞেস করেন। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলে মাগরিবের নামাজ পড়তে যাচ্ছিলাম, এ সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আমার জন্য ভালো করে দোয়া করো।” নামাজ শেষ করে এসে দেখি আমার ছেলেটি (অমিতাভ কায়সার) সোফায় তাঁর পাশে শুয়ে আছে, আমি তখন নিচে পাটিতে বসে মেয়েকে (শমী কায়সার) শিশিতে করে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। এমন সময় আমার চতুর্থ দেবর ওবাইদুল্লাহ, সে আমার স্বামীকে বলে “বড়দা, কয়েকজন যুবক আমাদের বাড়ির গেটে কড়া নাড়ছে, কী করব।” তখন তিনি বলেছিলেন “খুলে দাও দেশ বোধ হয় স্বাধীন হয়ে গেছে, এরা সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধার দল।” তিনি তখন আমার আঁচল থেকে চাবির গোছা নিয়ে আলমারি খুলে গরম কাপড়চোপড় ও টাকাপয়সা এই যুবকদের দেওয়ার জন্য বের করে সোফার ওপরে রাখছিলেন আর বলছিলেন “নয় মাস যুদ্ধ করে এরা এসেছে, এদের কাছে কিছুই নেই, তাই এগুলো এদেরকে দিতে হবে।”

 দু–এক মিনিট পরেই ৪–৫ জন যুবক মুখবাঁধা অবস্থায় টক টক করে দোতলায় উঠে আসে। এসেই রুমে ঢুকে প্রশ্ন করে এখানে শহীদুল্লা কায়সার কে? শহীদুল্লা কায়সার প্রথমে ভেবেছিলেন এরা মুক্তিযোদ্ধা। তাই তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন “আমিই শহীদুল্লা কায়সার”। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে একজন চট করে শহীদুল্লা কায়সারের হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়।...আমিও পিছে পিছে বারান্দায় যাই এবং শহীদুল্লা কায়সারের হাত ধরে রাখি এবং আরেক হাত দিয়ে বারান্দায় বৈদ্যুতিক বাতির সুইচ অন করি। বাতি নেভানো ছিল, কারণ তখন ব্ল্যাকআউট চলছিল। আমি চিত্কার করে কী যে বলেছিলাম মনে নেই। তখন পাশের রুম থেকে আমার সন্তানসম্ভবা ননদ শাহানা দৌড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। তখন আমরা মুখ বেঁধে রাখা একজনের মুখের কাপড় সরাতে চেষ্টা করছিলাম, তারা সংখ্যায় বেশি থাকায় আমরা পারিনি।...আমার এবং আমার ননদের বাধা সত্ত্বেও একপর্যায়ে তারা টেনেহিঁচড়ে আমার স্বামীকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। এ সময় আমার হাত যখন স্বামীর হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন শহীদুল্লা কায়সার বলেছিলেন “ভালো থেকো, আমি আবার ফিরে আসব।” বাড়ির সামনেই আমার শ্বশুরের প্রতিষ্ঠা করা মসজিদ ছিল। সেই মসজিদের ইমাম সাহেবের (বর্তমানে মৃত) কাছ থেকে জানতে পেরেছি, আমার স্বামীকে একটি কাদামাখা মাইক্রোবাসে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।...

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, সকাল ১০টা–সোয়া ১০টার দিকে আমি আমার তৃতীয় দেবর জাকারিয়া হাবিবের সঙ্গে মামা জহুর হোসেন চৌধুরীর বাসায় যাই, তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে শক্ত থাকতে বলেছিলেন। আমি এবং আমার দেবর একটি রিকশায় করে রায়েরবাজার বধ্যভূমির দিকে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় তখন অসংখ্য মানুষকে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের বরণ করতে দেখেছি।...রায়েরবাজারে গিয়ে দেখি, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্বজনরাসহ অনেক বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়স্বজন কান্নাকাটি করছেন। আমার দেবর আমাকে নিয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমির কর্দমাক্ত গর্তে নামতে বললে আমি সেখানে গিয়ে অনেকের গলিত বিকৃত লাশ উল্টেপাল্টে দেখেছি, কিন্তু শহীদুল্লা কায়সারের লাশ পাইনি। আমি তখন থেকেই স্থির করেছি, শহীদুল্লা কায়সার আমার অন্তরেই থাকবে। বাড়িতে ফিরে আমার শাশুড়িকে বলেছি, আমি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না।’

 পান্না কায়সারের দেওয়া বর্ণনা থেকে উঠে এসেছে কত বড় সাহসী এবং দেশপ্রেমিক একজন মানুষ ছিলেন শহীদ শহীদুল্লা কায়সার। পরিণতি জেনেও শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন নিরুদ্বিগ্ন, যখন তাঁকে জালেম আলবদররা ধরে নিয়ে যায়। তাঁর পরম প্রিয় স্ত্রীর কষ্টও পরিমাপ করার সুযোগ নেই। জীবনসাথিকে হারিয়েও তিনি এগিয়ে গেছেন। সন্তানদের পিতৃ আদর্শে গড়ে তুলেছেন।

আগামীকাল: মামলার মধ্য দিয়ে সত্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান: হাইকোর্টের বিচারপতি