৩০ জানুয়ারি জনপ্রিয়তার পরীক্ষাটি হয়ে যাক

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের মতো জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী দলের সাধারণ সম্পাদক পদে দ্বিতীয়বার দায়িত্ব পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।

বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের ত্রাণ সমন্বয় টিমের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদকের একটি সভা হয়। এতে শীতার্ত মানুষের কাছে শীতবস্ত্র পৌঁছানোর জন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের নেতৃত্বে কয়েকটি ত্রাণ দল গঠন করা হয়েছে। যেকোনো জনহিতৈষী রাজনৈতিক দলের জন্য এটি অবশ্যকর্তব্য। আওয়ামী লীগের দেখাদেখি অন্যান্য দলও ত্রাণ দল নিয়ে মাঠে নামলে শীতার্ত দরিদ্র মানুষগুলোর কষ্ট লাঘব হবে। আওয়ামী লীগের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।

ত্রাণ সমন্বয় দলের সভা শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ‘দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ বিএনপির বিরুদ্ধে। এই ৯০ শতাংশ মানুষ এখন বিএনপিকে চায় না। এই সংখ্যা আরও বাড়বে। ৯১, ৯২, ৯৩ এভাবে কমতে কমতে একসময় তাদের জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকবে।’

ওবায়দুল কাদের শুধু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নন, বর্তমান মন্ত্রিসভার একজন প্রভাবশালী সদস্যও। ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথমে তিনি ছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। পরে রেলওয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় হলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। আওয়ামী লীগের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন। অনেকের দপ্তর বদল হয়েছে। কিন্তু ওবায়দুল কাদের একই মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন আছেন। তাঁর হাতে শুরু হওয়া পদ্মা সেতুর কাজও তিনি শেষ করতে চান।

এর আগে বিএনপির নেতারা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, এটি প্রমাণ করতেই তাঁরা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাচ্ছেন। জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির নেতাদের বক্তব্য হাস্যকর। তাঁরা গণতন্ত্রের ভাষা বোঝেন না, তাঁরা আইন-আদালত কিছুই মানেন না। তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং হত্যা, খুন এবং লুটপাটের রাজনীতি চর্চা করা। (ইত্তেফাক, ৩ জানুয়ারি, ২০২০)

বিএনপির নেতারা যেকোনো উপায়ে নির্বাচনে যেতে চান কথাটির অর্থ কী? ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র সংবিধানসম্মত উপায় হলো নির্বাচন। আর নির্বাচন মানে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেই ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আমরা এই উপসংহারে আসতে পারি যে বিএনপি যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। এই তথ্য দেশবাসীকে আশ্বস্ত ও শঙ্কামুক্ত করতে পারত, যদি যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগটি সবার জন্য রহিত হতো। অন্য কোনো দল যদি যেকোনো উপায় ক্ষমতায় যায়, তাহলে বিএনপির জন্যও সেটি বৈধ হয়ে যায়। যেকোনো উপায় বলতে শুধু বন্দুকের জোর বোঝায় না, ব্যালটে জবরদস্তিও বোঝায়।

ওবায়দুল কাদের আরও বলেছেন, বিএনপির জনপ্রিয়তা তলানিতে নেমে এসেছে বলে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য কোনো দলে জনপ্রিয়তা মাপার মাপকাঠিটি কী? কোন দল কত জনপ্রিয় তার পরীক্ষাটিই–বা কীভাবে হবে? পরীক্ষার একমাত্র উপায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষা করতে পারেনি বলে আমরা একসময় পরীক্ষক হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করেছিলাম। বিএনপি সেটি নষ্ট করেছে। আর আওয়ামী লীগ বাদ দিয়েছে। কিন্তু আমরা পরীক্ষাটি সুষ্ঠুভাবে নিতে পারিনি। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে এসে এটি অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। নির্বাচন পরিচালনার জন্য সংবিধানে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান আছে। সেই অনুযায়ী উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ নির্বাচন কমিশনও গঠিত হয়েছে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে। ভারতের নির্বাচন কমিশন তিন সদস্যের। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন পাঁচ সদস্যের। লোকবলও অনেক বেশি। কিন্তু নাগরিকদের ভোটের সুরক্ষা তাঁরা করতে পারেননি। শামসুল হুদা কমিশন ২০০৮ সালে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেশে–বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিল। এরপর রকিব কমিশন ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করতে না পারলেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো মোটামুটি সুষ্ঠু করেছিল। কিন্তু কে এম নূরুল হুদা কমিশন এসে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। বিচারপতি আজিজ নির্বাচন না করেই নিজেকে বিতর্কিত করেছিলেন, আর নূরুল হুদা কমিশন একের পর এক ‘অভিনব’ ভোট করে নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে ধ্বংসের কিনারে নিয়ে এসেছে। সিটি নির্বাচনের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘আমরা বরিশাল, গাজীপুর বা খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।’ সিইসিসহ অপর চার কমিশনার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির নেতাদের বক্তব্য হাস্যকর। হ্যাঁ, আমরাও মনে করি, যদি ৩০ জানুয়ারির সিটি নির্বাচনটি সিইসির দাবি অনুযায়ী শতভাগ সুষ্ঠু হয়, তাহলে বিএনপির নেতাদের বক্তব্য হাস্যকরই হবে। আর যদি গাজীপুর, বরিশাল ও খুলনার পুনরাবৃত্তি হয়, তাহলে সিইসি ও তাঁর নির্বাচন কমিশন আগের মতোই দেশবাসীর হাসির পাত্র হবে। নূরুল হুদা কমিশন গত তিন বছরে নির্বাচনের নামে এত হাস্যকর কাজ করেছে যে মানুষ এখন হাসতেও ভুলে গেছে। নির্বাচনের কথা শুনলে তারা শুধু শঙ্কায় থাকে। তারপরও সিইসি বরাবরের মতো আশার বাণী শুনিয়ে চলেছেন।

১ জানুয়ারি সিইসি সাংবাদিকদের বলেছেন, চট্টগ্রাম–৮ আসনের উপনির্বাচন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ আসন্ন সব নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হবে। সঠিক নির্বাচন হবে। সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে। প্রতিযোগিতামূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে। এখানে কারও আশঙ্কার কোনো কারণ নেই।’

গাজীপুর, খুলনা ও বরিশাল সিটি নির্বাচন কীভাবে হয়েছে, দেশবাসী দেখেছে। তখনো সিইসি বলেছিলেন, দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তাই তিনি যখন কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে আগাম ঘোষণা দেন, তখন দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়।

আবারও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কথায় ফিরে আসি। তিনি বলেছেন, ৯০ শতাংশ মানুষ বিএনপির বিরুদ্ধে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি শুধু মাঠের খবর রাখেন না; রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো থেকেও খবর পান। আর সেই খবরটি যদি হয় ৯০ শতাংশ মানুষ বিএনপির বিরুদ্ধে, তাহলে আওয়ামী লীগ দক্ষিণে তাদের মেয়র প্রার্থী বদল করল কেন? বিএনপি যত জনপ্রিয় প্রার্থীই দিক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে যাওয়া ৯০ শতাংশকে ৫১ শতাংশে নিয়ে আসতে পারবে না। তাহলে কি মাঠের চিত্র আর কাদের সাহেবের কথার মধ্যে মস্ত ফারাক আছে?

বিএনপির বিরুদ্ধে ৯০ শতাংশ মানুষ, না আওয়ামী লীগের পক্ষে ৯০ শতাংশ, সেটি পরীক্ষার জন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচন তখনই অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, যখন ভোটাররা নির্ভয়ে পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। নির্বাচন তখনই সুষ্ঠু হয়, যখন ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়ে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা দলীয় নেতা-কর্মীরা হস্তক্ষেপ করবেন না। নির্বাচন তখনই সুষ্ঠু হয়, যখন নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা আইনানুযায়ী তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু পালন করতে পারবেন। নির্বাচন তখনই সুষ্ঠু হয়, যখন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকে। নির্বাচন তখনই সুষ্ঠু হবে, যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভোটের রাতে কোনো দলের নেতা–কর্মীদের তাড়া করবে না। বিরোধী দলের নির্বাচনী এজেন্টদের গাড়িতে তুলে নিয়ে নির্বাচনী এলাকার বাইরে কেউ ছেড়ে দিয়ে আসবে না। নির্বাচন তখনই সুষ্ঠু হবে, যখন কোনো দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা করা হবে না।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, বিএনপির বিরুদ্ধে ৯০ শতাংশ মানুষ। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষে কত শতাংশ মানুষ আছে, সেটি তিনি স্পষ্ট করেননি।

৩০ জানুয়ারি দুই সিটি করপোরেশনে সুষ্ঠু ও ভয়মুক্ত ভোটের মাধ্যমে তার পরীক্ষাটা হয়ে যাক।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]