শিশুরা বই ও পরীক্ষার বোঝা নিতে পারছে না

প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষাক্রমে জোরেশোরে বলা হয়েছে: কমে যাবে বইয়ের বোঝা, কমে যাবে পরীক্ষার বোঝাও। আসলে কি তাই?

প্রথমেই বইয়ের বোঝা নিয়ে কথা। এ বিষয়ে আগেই আলোচনা করেছি। বিস্তারিত আর কিছু না বলাই ভালো। শুধু এটুকু বলা যথেষ্ট, চিন্তার মাধ্যম দুটি—ভাষা ও গণিত। ভাষা প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ায়, গণিত তাতে যুক্তির শাণ দেয়। তাই ভাষা ও গণিত হলো শিক্ষার ভিত্তি। কিন্তু এই দুই বিজ্ঞান শিশু রপ্ত করে তার চারপাশের অভিজ্ঞতা দিয়ে। শিশুর শিক্ষার জন্য সমাজ, প্রকৃতি, পরিবেশ হলো গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

প্রশ্নটা এখানেই। কোন ভাষা শেখানো উচিত? অবশ্যই মায়ের ভাষা। কিন্তু আমরা উল্টোপথে চলতে ওস্তাদ। তাই শিশুর বোল ফোটার আগেই তাকে ইংরেজি শেখাতে চাই। বাংলা বর্ণমালা শেখার আগে শিশুর কাঁধে চাপাই ইংরেজির বোঝা। তাতে নাকি শিশু স্মার্ট হয়! এগুলো হলো মনোজগতে চেপে বসা উপনিবেশের ভূত। আসলে শিশুকে দাস্যমনোবৃত্তিতে গড়ে তোলার গোপন বাসনা থেকে এর জন্ম।

প্রসঙ্গত বলি, দুনিয়ার কোনো জাতিই মায়ের ভাষায় শিক্ষা ছাড়া উন্নতি করতে পারেনি। ভাষা ইন্দোনেশিয়ার কথাটাই ধরুন। ১৯৪৯ সালে ওলন্দাজ উপনিবেশবাদীদের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সময় তাদের কোনো একক লিপি ও ভাষা ছিল না। প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ ও তাঁর সহযোগী হাদা ভাষা প্রশ্নে নতুন নীতি গ্রহণ করেন: ১. রোমান লিপি ২. বিভিন্ন দ্বীপের মধ্যে যোগাযোগের সূত্র হিসেবে ভাষা ইন্দোনেশিয়া গড়ে তোলা ৩. সে ভাষায় প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিদ্যাচর্চা করা। তাতে ফল পাওয়া গেল দ্রুত। পিছিয়ে থাকা একটি জাতি দ্রুত জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গেল। প্রযুক্তি দক্ষতায়, উৎপাদনে সে হয়ে উঠল স্বনির্ভর।

আমরা তিন ভাষার ফাঁদে আটকে রেখেছি শিশুকে। বাংলা শিখুক কিংবা না শিখুক, তাকে ইংরেজি শিখতেই হবে। সঙ্গে ধর্মীয় ভাষার (আরবি বা সংস্কৃত বা পালি) ধকল। এভাবে, শুধু ভাষা শেখার ধকলে নাকাল আমাদের শিশুরা।

আমরা মনে করি, তৃতীয় শ্রেণির আগে শিশুর কাঁধে বিদেশি ভাষার বোঝা না চাপানোই সংগত।

শুধু সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ দেওয়াই যথেষ্ট। কিন্তু আমরা নানা নামে জাতীয় ও বিশ্বপরিচয় চাপিয়ে দিই শিশুর কাঁধে। শিশুকে তার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শেখালে সে সহজে শেখে শেখার কৌশল। সেটা একবার রপ্ত করতে পারলে তামাম দুনিয়া চেনা তার জন্য সহজ হয়ে যায়। সে জন্য নিজের বসতবাড়ি, গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলার ও দেশের ইতিহাস, ভূগোল, প্রকৃতি বিষয়ে জানার জন্য অভিজ্ঞতাভিত্তিক পাঠই আদর্শ। সারা দুনিয়ার বোঝা শিশুর ঘাড়ে চাপানো কখনোই উচিত নয়। কাজেই সমাজপাঠ হতে পারে এমন একটি পাঠ্যপুস্তক, যেটি শিশু তার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিখতে পারে। এতে শিক্ষার ভিত মজবুত হয়, দেশপ্রেম পোক্ত হয়। শিক্ষা সৃজনশীল হয়। প্রাথমিক স্তরে এ তিন বিষয়ের বাইরে কিছু পড়ানো অর্থহীন। তাতে বইয়ের বোঝা কমবে।

একটা কথা যেন আমরা কখনোই না ভুলি। শিক্ষার বুনিয়াদ তৈরি হয় শিক্ষার কৌশল বা মেথড রপ্ত করার মধ্য দিয়ে, বিষয় বা কনটেন্ট দিয়ে নয়। আমরা কেন বিষয়বস্তুর ওপর জোর দেব? কৌশল রপ্ত হলে বিষয় জ্ঞান সহজ হয়ে যায়। তাই প্রাথমিক শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত শেখার কৌশল রপ্ত করা, বিষয় জ্ঞান নয়।

এবার পরীক্ষার কথা। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা বোঝা কীভাবে কমবে তা বুঝতে আমি অক্ষম। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার বোঝা নামছে না শিশুর কাঁধ থেকে। জেঁকে বসেছে জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষাও। যদিও দেশজুড়ে এই দুই পরীক্ষা বন্ধের দাবি সবার। প্রথমত, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শিশুর কাঁধে এক ভারী পর্বতের মতো বোঝা। দ্বিতীয়ত, পরীক্ষার নামে চলে স্রেফ তামাশা। শিশুরা অনৈতিকতায় হাতেখড়ি পায় শিক্ষক, প্রশাসকদের উপস্থিতিতে। এ জন্য আবার প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যা কেবল দুর্নীতির নতুন রাস্তাই খুলে দেবে।

শুধু প্রাথমিক স্তরেই নয়। নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেও বইয়ের বোঝা চাপানোর কূটকৌশল চোখে পড়ার মতো। নবম-দশম শ্রেণির বিষয়বস্তু প্রাথমিকে শেখানোর কসরত, স্নাতক পর্যায়ের বিষয়বস্তু মাধ্যমিকে নামিয়ে আনার বুদ্ধি কারা জোগায়? মাধ্যমিক স্তরে মার্কেটিং, ব্যাংকিং, ফিন্যান্স, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান ইত্যাদি পড়ানোর যৌক্তিকতা কী? বিজ্ঞানে তো জড় ও জীববিজ্ঞান দুটো বিষয় পাঠ্য করলেই চলে। সেখানে এত এত বিষয় কেন? কেন জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষার পুলসিরাত পার হতে হবে শিক্ষার্থীকে?

৫০ বছর ধরে বলা হচ্ছে, উচ্চমাধ্যমিক স্তর তুলে দিতে হবে; কিন্তু দশম শ্রেণি শেষে মাধ্যমিক এবং দ্বাদশ শ্রেণি শেষে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বহাল রাখা হবে কেন? যেখানে দ্বাদশ শ্রেণি শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষাই যথেষ্ট, সেখানে আমাদের শিশুদের ঘাড়ে চারটি পাবলিক পরীক্ষার বোঝা! যদি বই এবং পরীক্ষার বোঝা কমাতেই হয়, তাহলে দ্বাদশ শ্রেণি শেষে মাধ্যমিক গ্রহণই আদর্শ হওয়া উচিত।

অষ্টম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হলে একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হয়তো পাওয়া যেত। তাতে পরীক্ষার সংখ্যা চার থেকে দুই-এ নেমে আসত। কিন্তু সরকারের কথার মধ্যে কোনোই সামঞ্জস্য নেই, কোন পরিকল্পনাও নেই। তারা একেক সময় একেক রকম কথা বলেই চলেছেন। এগুলো খুবই বালখিল্য আচরণ।

সবচেয়ে বড় কথা, যখন-তখন পাঠ্যক্রম (সিলেবাস) ও শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) পরিবর্তনের সর্বনাশা বাতিক। এবার নিয়ে গত সাত বছর দুবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তন ও অন্তত সাতবার পাঠ্যবই পরিবর্তন করা হচ্ছে। ঘন ঘন পরিবর্তনে শিক্ষার্থীদের নাভিশ্বাস অবস্থা। আর বছরের মাঝখানে, এমনকি, একেবারে শেষ সময়ে নম্বর পুনর্বণ্টন যেন এনসিটিবির রুটিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা চলে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। এই তুঘলকি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পড়ুয়া তো বটেই, শিক্ষকেরাই মানিয়ে নিতে পারেন না। ফলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটে। এতে কিছু মতলববাজ কনসালট্যান্ট, লেখক, প্রেস মালিক, কোচিং বণিকদের ব্যবসার সুবিধা হয়, ক্ষতি হয় জাতির। দুনিয়ার কোথাও ১৫–২০ বছরের আগে শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হয় না। তড়িঘড়ি শিক্ষাক্রম তৈরি, পাঠ্যপুস্তক রচনা প্রকাশ আখেরে কোনো সুফল দেয় না। গতবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তনে আমরা তার কুফল হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এ ধরনের কর্মকাণ্ড দুর্নীতির রাস্তাই খুলে দেয় শুধু।

তাই, আমরা মনে করি, নতুন কারিকুলাম তৈরি, পাঠ্যপুস্তক রচনায় আরও চিন্তাভাবনা, আরও পরামর্শ প্রয়োজন। এ কাজে পদাধিকারীদের পরিবর্তে প্রকৃত শিক্ষা বিজ্ঞানী, কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের পরামর্শই দিশা হওয়া উচিত। আমলাদের নাক এখানে না গলানোই উত্তম। আর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া আদৌ উচিত নয়।

* বিগত পর্বগুলোয় শিক্ষাক্রমের স্থলে ‘পাঠ্যক্রম’ লেখা হওয়ায় দুঃখিত।

আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
amirulkhan7 @gmail. com