শিশু নির্যাতকদের কেন বিচার নেই?

লজ্জা, ঘৃণা, পাপবোধ, গুনাহর ভয়—সব যেন উবে গেছে। শিশুদের প্রতি একশ্রেণির মানুষের সহিংসতা, নির্যাতনের ধরন আর নৃশংসতা সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বড় মানুষকে পিটিয়ে লাশ করে দিলে যখন কিচ্ছু হয় না, তখন তো শিশুরা নস্যি। তাদের যেমন খুশি কিল, চড়-থাপ্পড়, এমনকি গাছে বেঁধে পেটালে, কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে রাখলেও কেউ কিছু বলবে না। যে দেশে শিশুদের সুরক্ষার জন্য পৃথিবীর সেরা আইন আছে, যে দেশে স্কুলে-মাদ্রাসায় শিশুর গায়ে হাত তোলা দণ্ডযোগ্য অপরাধ, সে দেশেই শিশুরা মার খাচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, বলাৎকারের শিকার হচ্ছে নিজের বিদ্যাপীঠে, কাজের জায়গায়, বাড়িতে, পাড়ায়, চেনাজানা মানুষের হাতে, থানায় ও আদালত চত্বরে।

পাঠক নিশ্চয় জেনে গেছেন, ১১ জানুয়ারি সকালে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের বাঁশতলা গ্রামে এক প্রতিবেশীর ঘরের পেছন থেকে উদ্ধার করা লাশের রহস্য খুলতে শুরু করেছে। একটি চোখ ওপড়ানো সেই বস্তাবন্দী লাশ ছিল নিখোঁজ মাদ্রাসাছাত্র তোফাজ্জল হোসেনের (৭)। তোফাজ্জল হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া তার দুই চাচা, এক ফুফুসহ সাতজনকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

একই দিন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে রাতে ঘুমন্ত এক শিশুকে (১৩) বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে চুরির অপবাদে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। সেই নির্মমতার ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। শীতের সকালে চাদরে গা ঢেকে গোল হয়ে বসে রসিয়ে রসিয়ে সে রগড় দেখেছে গ্রামবাসী—সেই চিত্র প্রথম আলোয় প্রকাশিতও হয়েছে। শিশুটির স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। সে এখন হাসপাতালে। ঘটনাটি ১১ জানুয়ারির হলেও এর একটি ভিডিও ১২ জানুয়ারি রাতে ছড়িয়ে পড়ে। 

উত্তরের জনপদের মধ্যে সুন্দরগঞ্জের অন্য মর্যাদা দেওয়া হয়। সেখানকার গ্রামবাসীর চেষ্টায় গড়ে ওঠে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করেন—এমন কেউ নেই, যিনি সুন্দরগঞ্জের বিদ্যালয়টি দেখে আসেননি। এমন একটা জনপদে এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে, সেটা বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। রাতেই ফোনে যোগাযোগ করেছিলাম সুন্দরগঞ্জের সেই স্কুলের একজন সাবেক শিক্ষকের সঙ্গে। তিনিও খুব কষ্ট পেয়েছেন ঘটনায়। তারপর সৌজন্যবশত জানতে চাইলেন ঢাকার কথা। বলেই ফেললেন, আমরা তো শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক, আপনার তো শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়—সেখানকার শিক্ষক জোবাইদা নাসরীনের গায়ে হাত তুলল কারা? বিচার কী হবে জানি না। রেফারেন্স হয়ে থাকবে।

কেন এমন হচ্ছে?

অনেকে মনে করেন, ‘শিশুদের কথিত ছোটখাটো অপরাধের কারণে সালিসি বিচারের নামে তাদের সঙ্গে সহিংস আচরণ করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে একাধিক অপরাধের দ্বারা ভুক্তভোগী জনতার ক্ষোভ কোনো একটি শিশু চোর বা পকেটমারের ওপর পড়ছে। সাধারণ মানুষ এরূপ কোনো সহিংস ঘটনা ঘটতে দেখলেও হস্তক্ষেপ না করে ঝামেলামুক্ত থাকতে চায়।

এ পরিস্থিতিতে গত ৬ আগস্ট জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ইউনিসেফ উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে যে বাংলাদেশে খুব অল্প দিনের ব্যবধানে বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে পিটিয়ে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে শিশুদের রক্ষা করা প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা, পরীক্ষাপদ্ধতি উন্নত থেকে উন্নতর করার জন্য যেমন নানা গা-জ্বালাকর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তেমনি চলছে তাদের নিপীড়নের নানা কৌশল আবিষ্কার। পায়ুপথে পেটের মধ্যে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা, মাথা নিচে পা ওপরে দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে পেটানো ইত্যাদি কৌশল যুক্ত হচ্ছে। শামিল করা হচ্ছে পেটাতে ইচ্ছুক সবাইকে। প্রকাশ্যে চলছে এসব সহিংসতা।

গত ৫ নভেম্বর প্রবাসী অসহায় এক মা সৌদি আরব থেকে একটা ভিডিওবার্তা পাঠিয়ে তাঁর ছয় বছরের ছেলেকে বাঁচানোর আকুতি জানান। সন্তানকে দেখাশোনার জন্য যাকে তিনি কুড়ি হাজার টাকা আর একটা রিকশা কিনে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই চাচা শিশুকে উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন করেছিল বলে দেখা যায় সেই ভিডিওতে। পাষণ্ড শিশু নির্যাতক সেই ভিডিও পাঠায় প্রবাসী মাকে, যাতে তিনি আরও টাকা পাঠান।

যারা শিশুদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের মধ্যে একটা ধারণা হয়ে গেছে যে তাদের এই অপরাধের কোনো বিচার হবে না। কেননা, বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তেমন নজির নেই। আর এ ধারণাই অপরাধীদের শিশুদের ওপর পাশবিক আচরণের অভয় দেয়। এ পর্যন্ত শিশু নির্যাতনের ১ লাখ ৮০ হাজার মামলা হয়েছে। এ মামলাগুলোর অধিকাংশই এখনো বিচারাধীন। এ ছাড়া যেসব মামলার রায় হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ ধরনের নির্যাতনের মামলাগুলোর মাত্র ১ দশমিক ৩৬ শতাংশে আসামির সাজা হয়েছে, বাকি ৯৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ মামলায় আসামি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বিভিন্নভাবে বেরিয়ে গেছে। প্রথম আলোর খবরমতে, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৬৩০টি। ভুক্তভোগীর সিংহভাগের বয়স ১৮ বছর বা তার নিচে। ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ২১টি। ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি ৭–১২ বছর বয়সী শিশুরা। এই পরিসংখ্যান আগের বছরের চাইতে বেশি। শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের চলতি ধারাটি উদ্বেগজনক। 

শিশু অধিকার ফোরামের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৫৭২টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে অন্তত ২৩টি শিশুকে। এতে বলা হয়েছে, ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ৮৪টি শিশুর ওপর এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৭৫টি শিশু। এসবই সংবাদপত্রে প্রকাশিত ঘটনার নির্ঘণ্ট মাত্র। প্রকৃত ছবি কারোরই জানা নেই।

তবে উপায়?

বিশেষজ্ঞদের গৎবাঁধা কথা: জনসচেতনতা, সামাজিক প্রতিরোধ, আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ, দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণ এবং প্রকৃত দোষী ব্যক্তিরা যাতে বিচার থেকে রেহাই পেতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা গেলে শিশুদের অনেকাংশে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। তবে এসবের বাইরেও কিছু ভাবতে হবে। ভাবতে হবে আমাদের মাথা বিক্রির কথা। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে না চাওয়ার কথা। দেশ, সমাজ আর শিশুদের আপন না ভাবার আত্মপ্রতারণার কথা।

লেখক: গবেষক
[email protected]