জনগণ জানে কাকে ভোট দিলে উন্নয়ন হবে: আতিকুল

>

১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ঢাকা উত্তরের প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনে লড়ছেন আতিকুল ইসলাম। ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে তিনি ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। আসন্ন নির্বাচন ও নগর বিষয়ে তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

প্রথম আলো: আপনি অল্প সময়ের জন্য হলেও ঢাকা উত্তরের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, আবার মেয়র হওয়ার জন্য প্রার্থী হয়েছেন। মেয়র থাকা অবস্থায় কী অভিজ্ঞতা হলো?

আতিকুল ইসলাম: ঢাকা উত্তরের মেয়র হিসেবে আমার ৯ মাসের অভিজ্ঞতা হলো। এই দায়িত্ব পালন আমার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। নানা কিছুর মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। মেয়র হিসেবে যখন দায়িত্ব নিলাম তখন দেখলাম, সিটি করপোরেশনের সিইওর পদ খালি, অবসরে গেছেন প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপক। দায়িত্ব নেওয়ার ৯ দিনের মাথায় প্রগতি সরণিতে একটি দুর্ঘটনায় এক ছাত্র মারা যায়, এ নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। তা সামাল দিতে আমাকে মাঠে নামতে হয়। বনানীতে আগুনের ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গু। ডেপুটেশনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে থাকা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তত দিনে নিজের কর্মস্থলে চলে গেছেন। আমি নির্বাচিত হওয়ার সময় যুক্ত হয়েছে ১৮টি নতুন ওয়ার্ড। সেগুলোর রাস্তা ড্রেন, ফুটপাত—এসবের পরিকল্পনা করার কাজও শুরু করতে হয়েছে। এখানেও যে কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেছিলাম, তিনিও করপোরেশন ছেড়ে চলে গেছেন। নিজে দুর্ঘটনায় পড়ে পা ভেঙেছি, কিন্তু এরপরও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে গেছি। ফলে বলতে পারি, সময়টা কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছে।

প্রথম আলো: ব্যক্তিগতভাবে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছেন। ঢাকা নগরীর জন্য চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?

আতিকুল ইসলাম: আমি আগেই বলেছি, দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। এরপর বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা বিবেচনায় নিলে বলা যায় যে নিরাপদ সড়ক থেকে শুরু করে সামগ্রিকভাবে এবং সব ক্ষেত্রে বাসযোগ্য একটি নিরাপদ নগরী গড়ে তোলার বিষয়টিই আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য সব পর্যায়ের একটি নিরাপদ নগরী গড়ে তোলাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে হয়।

প্রথম আলো: এই সময়ে যা করেছেন, তাতে নিজেকে সফল বলে মনে করেন কি?

আতিকুল ইসলাম: আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি। যতটুকু পেরেছি করেছি। সময় পেয়েছি মাত্র ৯ মাস।

প্রথম আলো: এই পরিস্থিতিতে আবার মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কোন বিবেচনা থেকে?

আতিকুল ইসলাম: গত ৯ মাস আমি যা করেছি, তাকে অনুশীলনপর্ব বলতে পারেন। এ সময়ে আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছি। অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, নলেজ গেদার করেছি। ঢাকা শহরের চ্যালেঞ্জগুলো কী, তা বুঝতে পেরেছি। বলতে পারেন, আমি এখন রেডি টু প্লে, খেলার জন্য প্রস্তুত। অনুশীলন শেষে এখন টেস্ট খেলতে চাই।

প্রথম আলো: ঢাকা শহরে তো সমস্যার শেষ নেই। ৯ মাস কাজ করে আপনার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। আবার নির্বাচিত হলে একেবারে শুরুতে আপনি কোন কোন দিকগুলোতে নজর দেবেন? যদি তালিকা করেন, তাহলে ধারাবাহিকভাবে কোন কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেবেন?

আতিকুল ইসলাম: সামনে আবার ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম শুরু হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে এখন থেকেই নানা উদ্যোগ নিতে হবে। ফলে আমার প্রাধান্যের তালিকায় প্রথমেই থাকবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার বিরুদ্ধে কার্যক্রম। এই কার্যক্রম ব্যাপক এবং এতে নগরের অন্যান্য সমস্যার দিকেও নজর পড়বে। যেমন জলাবদ্ধতার সমস্যা, পরিচ্ছন্নতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা—এসব ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করা। ২৪টি পার্ককে জনগণের ব্যবহার উপযোগী ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম, সেগুলোর কাজ শেষ করে একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমার জন্য জরুরি। নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের ব্যাপারে নগর-পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে নিয়ে প্রস্তাব তৈরি করেছি। অনুমোদনের জন্য তা একনেকে পাঠিয়েছি। এই কাজ শুরু করা আমার অগ্রাধিকারে থাকবে। পৌর কর আদায়সহ সিটি করপোরেশনের নানা নাগরিক সেবা কার্যক্রমের অটোমেশন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে নাগরিকদের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি কমবে। নাগরিক সমস্যা শুনতে, সেবা নিশ্চিত করতে ও জবাবদিহির স্বার্থে ৩৩৩ হটলাইন সেবা চালু করব। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে একটি কমান্ড সেন্টার করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই সেন্টারের কাজ হবে কোথায় কী নেই বা কোথায় কী সমস্যা, তা নিয়মিত তদারক করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।

প্রথম আলো: এর বাইরেও অনেক সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে যানজট। ঢাকা শহর কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। শব্দ ও বায়ুদূষণে নগরবাসী বিপর্যস্ত।

আতিকুল ইসলাম। ফাইল ছবি
আতিকুল ইসলাম। ফাইল ছবি


আতিকুল ইসলাম: ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য ও দূষণমুক্ত করতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং আরও পরিকল্পনা রয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে আগারগাঁওয়ে ১০ কিলোমিটার সাইকেল লেন করেছি। কালশী খালের সমস্যা এরই মধ্যে দূর করেছি। সেখানকার জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে। মহাখালীর বাস টার্মিনালকে শহর থেকে সরানোর পরিকল্পনা রয়েছে এবং এটা এখানে থাকবে না। কারওয়ান বাজার থেকে কাঁচাবাজার সরানো হবে। এ ছাড়া চারটি স্মার্ট নেইবারহুড করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। জলাবদ্ধতা কী কারণে হয়, তা আমাদের জানা। ধরে ধরে এসব সমস্যা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে পরিস্থিতি অনেকটাই সহনীয় হবে।

প্রথম আলো: আপনার আগে যিনি মেয়র ছিলেন, প্রয়াত আনিসুল হক, তিনি যানজট দূর করতে গণপরিবহন ব্যবস্থা, বিশেষ করে ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে বিভিন্ন রুটে বাস পরিচালনা করে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ শুরু করেছিলেন। সেই কাজে কোনো অগ্রগতি আছে কি?

আতিকুল হক: ঢাকা শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে হলে ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। এটা করতেই হবে। ঢাকার দুই অংশকে মিলেই এটা করতে হবে। আনিসুল হকের মৃত্যুর পর এ-সংক্রান্ত পরিকল্পনা ও সামগ্রিক অগ্রগতির বিষয়টি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছিল। সেই বিষয়টি এগিয়ে নিতে হবে। আমি আবার নির্বাচিত হলে ঢাকা দক্ষিণের নতুন মেয়রকে সঙ্গে নিয়ে কাজটি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হব। এটা না করতে পারলে ঢাকার বিশৃঙ্খলা দূর করা যাবে না।

প্রথম আলো: সিটি করপোরেশনের কাজ বাস্তবায়নের জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ওপর নির্ভর করতে হয়। স্থানীয় পর্যায়ে কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকে। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করা ও জবাবদিহির মধ্যে রাখার কাজটি আপনি কীভাবে করবেন?

আতিকুল ইসলাম: আমি নির্বাচিত হলে প্রতি মাসে অন্তত একটি ওয়ার্ডে যাব এবং সেখানে টাউন হল মিটিং ধরনের বৈঠক করব। উন্নত দেশগুলোর শহরে স্থানীয় পর্যায়ে এ ধরনের সভা হয়, যেখানে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের মুখোমুখি হন। আমি এ ধরনের সভার আয়োজন করব, যাতে কাউন্সিলরদের জবাবদিহির মধ্যে রাখা যায়। প্রতিশ্রুতি পূরণ না হলে জনগণ সেখানে প্রশ্ন করতে পারবে। তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারবে। একই সঙ্গে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সম্পদের বার্ষিক হিসাব নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে।

প্রথম আলো: ঢাকা শহর দেখভালের সঙ্গে সিটি করপোরেশনসহ অনেক সংস্থা যুক্ত। সিটি করপোরেশন ও এসব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব ঢাকার মতো নগরীর যথাযথ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক বড় বাধা। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এই সমস্যা আপনি কীভাবে সামাল দেবেন?

আতিকুল ইসলাম: দেখুন আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধি। জনগণের সামনে আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। অন্যদের তা করতে হয় না, কিন্তু আমি তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা করব। কার বা কোন সংস্থার ব্যর্থতা বা দায়িত্বহীনতার কারণে কাজ করা যায়নি বা জনগণ দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে, তা আমি জনগণের সামনে প্রকাশ করব এবং সরকারকে জানিয়ে দেব। তাদের জবাবদিহি করতে বাধ্য করব।

প্রথম আলো: একজন মেয়র প্রার্থী হিসেবে আপনি প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন, কিন্তু যে কায়দায় সব প্রার্থী তা করছেন, তাতে জনগণ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। উচ্চ স্বরে মাইক বাজছে। শব্দদূষণ হচ্ছে। পোস্টার পরিবেশ দূষিত করছে। আপনারা নগরবাসীর সেবা করতে চান, কিন্তু আপনাদের জন্য তো নগরবাসী বিরক্ত হচ্ছে। আধুনিক যুগে এ ধরনের প্রচারণা আর কত?

আতিকুল ইসলাম: আসলে বর্তমান প্রযুক্তির যুগে আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের প্রচার-প্রচারণার পক্ষে নই। কোনো আধুনিক দেশ ও শহরে এমন হয় না। আমাদের এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে আমি অনুরোধ করব, ভবিষ্যতে নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেন এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং প্রচার-প্রচারণা, বিশেষ করে মাইক ও পোস্টার ব্যবহার-সংক্রান্ত আচরণবিধিতে বড় পরিবর্তন আনা হয়।

প্রথম আলো: সিটি করপোরেশন, জাতীয় নির্বাচনসহ সাম্প্রতিক সময়ে যে কায়দায় নির্বাচন হয়েছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া যে মাত্রায় বিতর্কিত হয়েছে, তাতে তো নির্বাচনের প্রতি জনগণ আস্থা হারিয়েছে। এবারও কি নির্বাচন আগের মতোই হবে?

আতিকুল ইসলাম: আপনি জানেন যে আমি একসময় বিজিএমইএতে নেতৃত্ব দিয়েছি। নির্বাচনের মাধ্যমে এবং ভোটে জিতেই আমি সভাপতি হয়েছি। আমি সব সময়েই মনে করি যে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উৎসবমুখর হওয়া উচিত। জনগণ তাঁর পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন, এমন পরিস্থিতি আমি চাই। জনগণের এটা বোঝার ক্ষমতা আছে যে কে যোগ্য এবং কাকে ভোট দিলে উন্নয়ন মিলবে। আমি একটি সন্ত্রাস ও সংশয়মুক্ত নির্বাচনের আশা করছি। নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আতিকুল ইসলাম: ধন্যবাদ।