'নেই' আর 'নেই'-এর নির্বাচন

বদিউল আলম মজুমদার।
বদিউল আলম মজুমদার।

ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাতটি কেন্দ্রে প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়। পর্যবেক্ষণ থেকে আমার কিছু অভিনব অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ছিল ‘নেই’ আর ‘নেই’-এর নির্বাচন। এই নির্বাচনে ভোটার নেই, ভোটারদের আগ্রহ নেই, প্রধান বিরোধী দলের প্রার্থীদের এজেন্ট নেই, সহিংসতা নেই, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর চাপ নেই, সর্বোপরি ভোটারদের আস্থা নেই ইত্যাদি।

আমার দেখা সাতটি কেন্দ্র হলো বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র, ঢাকা পলিটেকনিক ল্যাবরেটরি স্কুল, সেগুনবাগিচা হাইস্কুল (দুটি কেন্দ্র), বেগম রহিমা আদর্শ বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজ (দুটি কেন্দ্র)। এর মধ্যে চারটি ছিল ঢাকা উত্তরের এবং তিনটি ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত।

দিনটি শুরু হয়েছিল সকাল আটটায়, যখন আমি সপরিবার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিতে যাই। আমরা নির্বিঘ্নেই ভোট দিতে পেরেছি। যখন বুথে উপস্থিত হই, তখন আমি মাত্র আরেকজন ভোটারকে দেখতে পাই। বাইরেও তখন কোনো লাইন ছিল না। কিছু তরুণ ঘোরাঘুরি করছিল, তাদের সবার গলায় নৌকা কিংবা সরকারি দল-সমর্থিত এবং সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন স্থানীয় কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর ব্যাজ ছিল। বিএনপি এবং বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর ব্যাজ পরা কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি আমার চোখে পড়েনি।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত একটি বুথে ৩৫৯ জন ভোটারের মধ্যে ৩০ জন বা ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ ভোট জমা পড়ে। ঢাকা পলিটেকনিক ল্যাবরেটরি স্কুল কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পড়েছিল ১ হাজার ৫৩৫ ভোটের মধ্যে ১৭২ টি, যা ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। ওই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২ হাজার ৪৫৬ জনের মধ্যে ৩৯০ জন বা ১৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোট দেন।

সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের একটি কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩ হাজার ১৯৮ জনের মধ্যে ২৪৪ জন বা ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ ভোট পড়ে। ওই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি কেন্দ্রে দুপুর ১২টার মধ্যে ২ হাজার ১২৮ জনের মধ্যে ২২৫ জন বা ১০ দশমিক ৫৭ ভোট পড়ে। বেগম রহিমা আদর্শ বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে বেলা দুইটা পর্যন্ত ২ হাজার ৩৭৩ জনের মধ্যে ৩৯২ জন (১৬.৫২ %), মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজের পুরুষ কেন্দ্রে দুইটা পর্যন্ত ২ হাজার ২৩২ জনের মধ্যে ৪০০ জন (১৭.৯২ %), ওই প্রতিষ্ঠানের নারী কেন্দ্রে বেলা তিনটা পর্যন্ত ২ হাজার ৬৯৩ জনের মধ্যে ২৭০ জন (১০.০৩ %) ভোট দেন। আমি তিনটার দিকে যখন মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে যাই, তখন সেখানে ভোটারের উপস্থিতি প্রায় ছিলই না, বাইরেও তেমন কাউকে দেখা যায়নি।

আমার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ঘোষিত ভোটের হার সংগতিপূর্ণ নয় বলেই আমার মনে হয়। ইভিএমে ভোট গ্রহণ করায় দ্রুত ফল ঘোষণা করার কথা থাকলেও গভীর রাত পর্যন্ত সব ফলাফল পাওয়া যায়নি, যা এই সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করে। ইভিএম ব্যবহারের কারণে পুনর্গণনা করে তা বের করারও সুযোগ নেই—কমিশন যে তথ্য দিয়েছে, তাই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। তবে ভোটের হার কম হলে নির্বাচন অবাধ হয় না এবং জনগণের সম্মতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না।

এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি শুধু নগণ্যই ছিল না, ভোটারদের মধ্যে ভোট দেওয়ার আগ্রহও অনেক কম ছিল। বেলা তিনটার দিকে মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে পাঁচজন যুবকের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যারা খালি রাস্তা পেয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে। তাদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারি যে নির্বাচনের আগে দুই প্রধান দল একে অপরের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখলের যে অভিযোগের তির ছুড়েছে, তাতে তারা আতঙ্কিত হয়ে ভোট দিতে যায়নি। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশের ফলে তাদের মধ্যে আরও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে যে ভোটের ফলাফল এরই মধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে।

আমি যে সাতটি কেন্দ্রে গিয়েছি, তার একটিতেও ধানের শীষের কোনো এজেন্ট দেখিনি। ছয়টি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা বলেছেন যে ধানের শীষের এজেন্ট আসেইনি। আরেকটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, ধানের শীষের এজেন্ট এসেছিল, কিন্তু তারা কোথায় তা তাঁর জানা নেই।

এসব কেন্দ্রের বাইরে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের একধরনের জটলা, বস্তুত মহড়া দেখেছি, যা অন্যদের ওপর একধরনের নিরাপত্তাহীনতা ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করতে বাধ্য। তবে কোথাও কোনো উত্তাপ দেখিনি। কেন্দ্রে কোনো প্রতিপক্ষ না থাকার কারণেই কোনো উত্তাপ-উত্তেজনা ছিল না।

যে কয়টি কেন্দ্রে আমি গিয়েছি, সেগুলোতে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অনেক কেন্দ্রেই নিচতলার পরিবর্তে ওপরের তলায় বুথ স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে বুথ ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ তলায়। সেখানে বয়স্ক ব্যক্তিকে ধরাধরি করে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে দেখেছি।

সাতটি কেন্দ্রে অনেকের সঙ্গে আলাপ করে তাদের মধ্যে ব্যাপক আস্থার অভাব অনুভব করেছি—ইভিএমের ওপর আস্থার অভাব, সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার অভাব। ইভিএম ও ইভিএমের দুর্বলতা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি আগে থেকেই ছিল। এর সংগত কারণও রয়েছে। স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনারও স্বীকার করেছেন যে আগের ভোটে ব্যবহৃত ইভিএমে ত্রুটি ছিল (যুগান্তর, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯), যে ত্রুটির ব্যাপারে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেননি এবং তা দূরীকরণে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা-ও বলেননি। এ ছাড়া ইভিএমের ব্যবহার সম্পর্কেও কমিশনের পক্ষ থেকে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ দেখা যায়নি। ইভিএম নিয়ে সন্দেহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইভিএম পরিচালনাকারী নির্বাচনী কর্মকর্তা তথা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে ভোটারদের মনে ব্যাপক আস্থাহীনতা। গত জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে অনেকের মনে এই ধারণা জন্মেছে যে, তারা ভোটকেন্দ্রে গেলেও ভোট দিতে পারবে না। আর ভোট দিলেও তাতে কিছু আসবে-যাবে না—যাদের জেতার তারাই জিতবে। জনমনে গড়ে ওঠা এই সন্দেহ ও আস্থার সংকট কমিশন দূর করতে পারেনি।

প্রসঙ্গত, সাতটি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণের সময় আমার কাছে একাধিক ব্যক্তি বেশ কিছু অভিযোগ করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের নেতা-কর্মী বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন। জিজ্ঞেস করলে একজন বলেন, যেমন ভোট হওয়ার কথা, তেমনই হচ্ছে। ফলে নির্বাচন কমিশনের ওপর ভোটারদের মধ্যে আস্থার অভাব তো কাটেইনি, বরং আরও প্রকট হয়েছে।

পরিশেষে, এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে আবারও সুস্পষ্ট হলো যে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ভোটারদের আস্থাহীনতার সমস্যা ব্যাপক। ফলে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ নির্বাচনই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবেÿক্ষমতা বদলের একমাত্র পন্থা। তাই নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে জাতি হিসেবে আমরা এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারি, যার মাশুল দল-মতনির্বিশেষে ভবিষ্যতে সবাইকেই গুনতে হবে।

বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)