লাউয়াছড়ায় অবকাঠামো উন্নয়ন

জল-জঙ্গল সবখানেই সভ্যতার অস্তিত্ব বিস্তার করতে গিয়ে আমরা বিবর্তনবাদ আর বাস্তুতন্ত্রের মৌলিক সূত্রগুলো ভুলতে বসেছি। আমাদের মেকি উন্নয়নের রাজসূয় যজ্ঞের বলি হচ্ছে নিরীহ বন্য প্রাণী।

‘উন্নয়নের’ নেশায় আত্মমগ্ন ক্ষমতাধরদের কাছে এই সব কথা যে নিতান্ত অর্থহীন আপ্তবাক্য, তার সর্বশেষ উদাহরণ দেখা যাচ্ছে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। সেখানে ‘ইকোট্যুরিজম’ উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বনকে বিপদে ফেলার প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রায় ৫০ কোটি টাকার যে প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে, তার কাজ শুরু হলে সংরক্ষিত বনের মধ্যে ইটপাথরের কর্মযজ্ঞ চলবে। তা প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে লাউয়াছড়া নেহাত বাণিজ্যিক চিত্তবিনোদন, বনভোজন ও ভোগবিলাসের কেন্দ্রে পরিণত হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সুবাদে জানা যাচ্ছে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পরিবেশকর্মীরা বলছেন, মন্ত্রীর এই আগ্রহ পরিবেশবিনাশী ও প্রাণী স্বার্থবিরোধী। এই প্রকল্পে সীমানাপ্রাচীর, বক্স কালভার্ট, সড়কের উভয় পাশে আরসিসি খুঁটিসহ প্লাস্টিকের বেড়া, গোলঘর, পাহাড়ের ওপরে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে যাওয়ার জন্য আরসিসি সিঁড়ি, সাইট প্রটেকশন গাইড ওয়াল, ওয়াশরুম, পর্যটক চলাচলের রাস্তার সেতু, ‘বঙ্গবন্ধু কনভেনশন হল’, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার—এমন অনেক কিছু নির্মাণ করা হবে।

পরিবেশকর্মীরা মনে করছেন, এ রকম উন্নয়ন হলে বনের প্রাকৃতিক অবস্থা থাকবে না। কিন্তু বন কর্মকর্তারা বলছেন, উদ্যানের মূল এলাকায় কিছু করা হবে না। পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করেই উন্নয়নকাজ করা হবে। বনের উন্নয়ন বলতে সাধারণত বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য রক্ষা এবং যতটুকু বন নষ্ট হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনাকে বোঝায়। কিন্তু কর্মকর্তারা ইট, লোহা, সিমেন্ট, বালু, কাঠের অবকাঠামোকেই উন্নয়ন সাব্যস্ত করে বসে আছেন। সেখানেই মূল গলদ।

 পরিবেশকর্মী ও গবেষকেরা মনে করছেন, এ উন্নয়ন পরিকল্পনা সংরক্ষিত বনের জীববৈচিত্র্যের জন্য যে মঙ্গল বয়ে আনবে না, সে বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত। ইকোট্যুরিজমের নামে এ ধরনের বাণিজ্যিক প্রকল্পের বাস্তব চিত্র অতীতে দেখা গেছে।

এখন সত্যিকার অর্থে লাউয়াছড়ার বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য উন্নয়ন করতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবে। পাশাপাশি প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য রক্ষায় সত্যিকারের পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা নিতে হবে।