বাঁচার ডাকে সাড়া দিন

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

জাত, পাত, শ্রেণি, ধর্ম, লিঙ্গনির্বিশেষে করোনা তাড়া করছে সবাইকে। সারা বিশ্বে মৃত্যুবরণ করেছে ১৪ হাজারেরও বেশি। আমাদের দেশে ৩৩ জন আক্রান্ত, ৩ জন মৃত। দেশ-জাতি এক বিশেষ বিপৎকাল অতিক্রম করছে। অথচ সরকারি সতর্কতা তৎপরতায় মনে হচ্ছে, শ্রমজীবী মানুষ বা পোশাকশ্রমিকেরা আর সব মানুষের কাতারে পড়েন না। তাঁদের নিরাপত্তা দাবি করা অন্যায্য। মধ্যবিত্তরা, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা বিচ্ছিন্ন পৃথক থাকবেন, ছুটিতে থাকবেন, তারও ঘোষণা অবশেষে ২৩ মার্চ সরকার দিয়েছে। ২৬ মার্চ থেকে আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি, যার আওতায় সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা সুনির্দিষ্ট করা আছে।

এর আগে বন্ধ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নিষিদ্ধ হয়েছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সভাসহ লোকসমাগমের সব আয়োজন। স্থগিত সংসদ অধিবেশন, মন্ত্রিসভার বৈঠক, নিম্ন আদালতের কার্যক্রম, আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষা এমনকি ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালনও। বিভিন্ন জেলায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আন্তর্জাতিক বেশির ভাগ ফ্লাইটও বন্ধ। এখন দেশ লকডাউনের পথে। দোকানপাট, শপিং মল বন্ধ, সারা দেশে থমথমে অবস্থা। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ের শীর্ষে অবস্থান করা কম মজুরি, কম ক্যালরি ও অপুষ্টির ঘানি টানা ৪০ লাখ শ্রমিক এখনো পথে, পরিবহনে এবং কারখানায়।

শ্রমঘন পোশাক খাতের শ্রমিকেরা গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে হাজারে হাজারে মানুষের সমাগমে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন করোনাভাইরাসে সংক্রমণের উপযুক্ত পরিবেশে। শ্রমিকদের একদিকে ভয় জীবনের, অন্যদিকে না খেয়ে মরার। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা পুষ্টিহীন শ্রমিকদের এই খাতে একবার করোনা প্রবেশ করলে তার পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে, তা হয়তো অনেকেই এখনো আঁচ করতে পারছেন না।

‘হোম কোয়ারেন্টিন’ বা ঘরে নিজেকে সবার থেকে পৃথক রাখা এই ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধে অন্যতম উপায় হিসেবে দেখছে সরকার। তাহলে শ্রমজীবীরা পথেঘাটে কারখানায় কেন? শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সবেতনে ছুটির দাবি করা সত্ত্বেও এখনো সরকার ও মালিকপক্ষের পক্ষ থেকে ছুটির ঘোষণা না আসাটা সরকারের দ্বিমুখী নীতিরই কি প্রকাশ ঘটাচ্ছে না? পোশাক কারখানা খোলা রাখার জন্য সরকার এবং মালিকপক্ষের সঙ্গে অনেকে সুর মিলিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।

কেউ বলছেন, কারখানার শ্রমিকদের বয়স ৪০-এর নিচে, তাঁরা তরুণ, তাঁদের করোনার আশঙ্কা নেই। কিংবা কারখানায় একত্র আছেন তাই ভালো আছেন। তাঁরা হয়তো জানেন না বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আক্রান্তের ৩৩ জনের মধ্যে ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে রয়েছেন ১৮ জন। ১০ বছরের নিচে ২ জন। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে ১৮-এর নিচে একজন মারা গেছেন, যাঁর আগে থেকে অসুস্থতা ছিল।

শ্রমজীবী মানুষ, কারখানার শ্রমিকেরা এমনিতেই অপুষ্টি, রক্তশূন্যতা, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে-শোকে ভোগেন। তাঁদের গড় কর্মজীবনের আয়ুও কম হয়। ফলে একটা বয়সের পর তাঁরা কারখানায় কাজের উপযোগী থাকেন না। সন্দেহ নেই যে তাঁদেরই জীবনের ঝুঁকি মধ্যবিত্ত তরুণ স্বাস্থ্যবান যে কারও চেয়ে বেশি। রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও তাঁদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চেয়ে কম। মালিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থ, শিপমেন্ট, লাভালাভের বিবেচনা আছে। কিন্তু আমাদের অর্থনীতির চলনশক্তির জীবন বাঁচাতে এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে জরুরি ভিত্তিতে শ্রমিকদেরও ঘরে ফেরানো দরকার। দরকার কারখানা বন্ধের ঘোষণাসহ অন্যান্য সতর্কতা।

শ্রমিকেরা ভয়ে আছেন যদি ছুটি হয়, বেতন হবে তো? সন্দেহ নেই এই মুহূর্তে বেতনসহই ছুটি লাগবে। মালিক ও বিদেশি বায়াররা এত দিন এ খাত থেকে যে লাভ করেছে, সেই জমানো লাভ থেকে এবং অভিজাত জীবন সংকোচন করেই শ্রমিকদের সব পাওনা পরিশোধ করতে হবে। কারখানা বন্ধ থাকলেও বেতন-বোনাস থেকে যাতে শ্রমিকেরা বঞ্চিত না হন, তার দিকে দেশবাসীকে সতর্ক নজর রাখতে হবে। সরকারকে প্রয়োজনে ভর্তুকি, কম সুদে ঋণ এবং আর্থিক সহায়তা দিতে হবে এ খাতে। বাংলাদেশের কোনো শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ এবং পোশাক কারখানার মানুষ যাতে না খেয়ে কিংবা করোনায় না মরেন, তার পুরো দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। শ্রমিক ও শিল্প রক্ষার এটাই প্রাথমিক ধাপ।

এ ছাড়া আছে নানা জরুরি পদক্ষেপ, যার মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণ সরকারের জরুরি কাজ। ইতিমধ্যে বাজারের যা অবস্থা, তাতে শ্রমজীবীরা সবার আগে আক্রান্ত হবেন, সন্দেহ নেই। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যবিত্তের মতো সঞ্চয় সম্পদ কিছুই নেই। মাসের বেতনের ওপর নির্ভর করেই টানাটানিতে চলতে হয়।

বাজারের যা অবস্থা, সরকার কি তাদের খাদ্য জোগান দেবে এই বিপদের সময়? উত্তর এখনো অজানা। পশ্চিম বাংলা ও কেরালায় সরকারিভাবে দরিদ্রদের জন্য খাদ্যসহায়তা নিশ্চিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২৫ মার্চ তাঁর ভাষণে কারখানা বন্ধেরও কথা বলবেন— এমন ধারনা করছেন অনেকে। কিন্তু তাঁদের বেতনের কী হবে? মালিকপক্ষ বলছেন, বেতনের সময়েই বেতন পাবেন। বেতন না দিয়ে কি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে? সরকার, বায়ার তারা কে কী দায়িত্ব নেবে? স্বাস্থ্যসেবার কী হবে? করোনা আক্রান্ত যদি কেউ হয়, তার কী হবে? যে শ্রমজীবী মানুষের স্বাভাবিক সময়েই সরকারি হাসপাতালে বারান্দায়ও ঠাঁই হয় না। তাদের স্বাস্থ্য রক্ষা পাবে কীভাবে?

এসব পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই খাতে আসন্ন অর্থনৈতিক সংকট এবং বিপদে পড়ার ঝুঁকি। তাই সবেতন ছুটি কেবল দাবি নয়, জরুরি মানবিক প্রয়োজন—বাঁচার ডাক। একে অবহেলা করবেন না।

লেখক: তাসলিমা আখতার, আলোকচিত্রী ও সভাপ্রধান গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি