করোনায় কালচারাল শক

বাসায় যা–ও ছিল ইয়ার বান্ধবের আনাগোনা, করোনা তার ওপরেও কারফিউ জারি করেছে। ছবি: লেখক
বাসায় যা–ও ছিল ইয়ার বান্ধবের আনাগোনা, করোনা তার ওপরেও কারফিউ জারি করেছে। ছবি: লেখক

সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে অনেক কিছু। অর্থনীতি, বাণিজ্য, রাজনীতি, সমরনীতি থেকে শুরু করে জীবনযাপন— সবকিছু যে নতুন করে শুরু করা দরকার, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর পৃথিবীর বিখ্যাত চিন্তকেরা বিভিন্নভাবে সে কথা বলতে শুরু করেছেন। এই পরিবর্তন কতটা ভালো বা মন্দ হবে সেটা এখনই বলার সময় নয়। কিন্তু পরিবর্তনটা শুরু হয়েছে। অর্থনীতি, বাণিজ্য, রাজনীতি, সমরনীতি ইত্যাদি অনেক বড় বিষয়। এগুলোর সঙ্গে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার জড়িত। তার হিসাবই আলাদা। আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের মাথায় সেসব ঢুকবে বলে মনে হয় না। তার চেয়ে আমরা কালচার নিয়ে কথা বলে ‘সিম্পলের’ মধ্যে ‘গর্জিয়াস’ থাকি।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর যতই দিন যাচ্ছে, আমরা এক ধরনের কালচারাল শকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং ক্রমশ তার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। শুধু আমরাই নই। পুরো পৃথিবী এখন এই কালচারাল শকের মধ্যে আছে। এর শুরুটা হয়েছে সামাজিক দূরত্ব বাড়ার মধ্য দিয়ে। সমাজবদ্ধ মানুষের প্রথাগত যে জীবনযাপন প্রণালি, সেখানে ঘন হয়ে থাকা, জড়িয়ে থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। এটা শুধু তার পারিবারিক জীবনেই নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও দেখা যায়। মানুষের এ প্রবণতা লক্ষ্য করেই সৈয়দ শামসুল হক “গোল হয়ে আসুন সকলে,/ ঘন হয়ে আসুন সকলে,/ আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে।” সমাজবদ্ধ স্থির মানুষ ঘন হয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। করোনাভাইরাস এই ঘন হয়ে থাকার ওপরেই প্রথম আঘাত হেনেছে সামাজিকভাবে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার মাধ্যমে। বাঙালি তো বটেই, চায়নিজ-জাপানি-মার্কিন সব জাতির মানুষই এখন বিচ্ছিন্ন হতে পারলেই বাঁচে! উনিশ শতকের অর্থনৈতিক মন্দার অভিঘাত লেগেছিল আমাদের পারিবারিক জীবনে। পুরো উনিশ ও বিশ শতকে মানুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে অর্থনৈতিক চাপে। কিন্তু সে বিচ্ছিন্নতা মানুষ ভুলে গিয়েছিল তার নতুন সামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করে। একুশ শতকে করোনাভাইরাস মানুষকে বিচ্ছিন্ন করল তার গোটা সামাজিক ব্যবস্থা থেকে। এখন আপনি মানুষের যত কাছে যেতে চাইবেন, মানুষ ততই আপনার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে বাঁচার জন্য। মানুষের সুদীর্ঘ সংস্কারের ওপর এ এক ভয়াবহ আঘাত। আর সেটা হেনেছে অদৃশ্য এক ভাইরাস, তার নাম এখন সবার জানা।

এই পুরো প্রক্রিয়ায় বাঙালি পরেছে এক মহা ফাঁপরে। পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মতো বাঙালিরও অতিথিপরায়ণতা আর আড্ডার সুনাম সর্বজনবিদিত। করোনাভাইরাসের এই মহা প্রাদুর্ভাবের কালে অন্যান্য জাতি কূলের মতো বাঙালিও বাধ্য হয়েছে বা হচ্ছে তার সংস্কার ভুলে যেতে। একে তো খোঁয়াড় জীবনের অদ্ভুত উপহাস শহুরে মানুষের অদৃষ্টে সকাল-বিকেল খোঁটা মারে, তাও যা ছিল ইয়ার বান্ধবের আনাগোনা, করোনা তার ওপরেও কারফিউ জারি করেছে। মানুষ তাদের বাসার সামনে ব্যানার টাঙাতে বাধ্য হয়েছে, অতিথিদের আগমন নিরুৎসাহিত করা হলো। মানে সোজা কথায়, বাসায় আসতে সরাসরি নিষেধ করা যাচ্ছে না, তাই একটু ঘুরিয়ে বলা আরকি। এর কারণে আমাদের খাবার টেবিলগুলোর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে। অতিথি আসলেই বাঙালি আর কিছু করুক না করুক, টেবিল ভর্তি হরেক পদের সুস্বাদু খাবার বানায়। অতিথিই তো নেই, খাবার বানিয়ে লাভ কী? আর এই বন্দীদশায় কি খাবার সুস্বাদু লাগবে? ফেসবুকের খাবারবিষয়ক গ্রুপগুলোতে দেখবেন সুস্বাদু খাবারের পুরোনো ছবিই ঘুরছে, নতুন ছবির পরিমাণ খুবই কম। অথবা করোনাভাইরাস নিয়ে আলাপ হচ্ছে। আবার এদিকে রেস্তোরাঁগুলোও বন্ধ। অর্থাৎ বাঙালির খাবারের ব্যাপারটা ঠিক জমছে না এখন। এখন ঘরবন্দী মানুষ কিছুটা হলেও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার চেষ্টায় আছে। যদিও ইউরোপ-আমেরিকার প্রভাবে আমাদের দেশেও স্বাস্থ্য সচেতনতার একটা ঢেউ বয়ে চলেছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। সে জন্য দেখবেন বাঙালি এখন যোগব্যায়াম না করে ইয়োগা বা মেডিটেশন করে, হালকা সেদ্ধ, আধা সেদ্ধ না খেয়ে বয়েল্ড খাবার খায়। তবে এই একটি জায়গাতেই মনে হয় বাঙালি তার ঐতিহ্যের সঙ্গে থাকতে পারে। কারণ শোনা যাচ্ছে, বাঙালির ওভারকুকড, ঝাল-মসলার খাবার খাওয়ার প্রবণতাই তাকে অনেক কিছু থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে।

প্রায় প্রতিটি বহুতল ভবনের লিফটের গোড়ায় নোটিশ সাঁটানো হয়েছে অর্ধেক মানুষ ওঠার জন্য। ছবি: লেখক
প্রায় প্রতিটি বহুতল ভবনের লিফটের গোড়ায় নোটিশ সাঁটানো হয়েছে অর্ধেক মানুষ ওঠার জন্য। ছবি: লেখক

খুব অন্তরঙ্গ মানুষকে, যার সঙ্গে হৃদয়ের যোগ অনেক গভীর, আমাদের এত দিনের অভ্যাসে ছিল দেখা মাত্রই তাকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা বিনিময় করা। এই উষ্ণতা যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি মানসিক, আবেগগত। এ রকমই একটি প্রথা করমর্দন। এখন অন্যের কর মর্দন করা তো দূরের কথা, তিন ফিটের মধ্যে যাওয়াই উচিত নয়। একই অবস্থা দেখবেন লিফটে ওঠার ক্ষেত্রে। প্রায় প্রতিটি বহুতল ভবনের লিফটের গোড়ায় নোটিশ সাঁটানো হয়েছে অর্ধেক মানুষ ওঠার জন্য। অর্থাৎ, আগে যে লিফটে অনায়াসে ধাক্কাধাক্কি করে ১০ জন মানুষ উঠত, এখন সেখানে ৪-৫ জন মানুষ উঠতে পারবে। এখানেও কাছাকাছি হওয়ার কোনো উপায় নেই। শ্যামলী টু যাত্রাবাড়ী রুটের ৮ নম্বর বাসে তো বটেই, প্লেনে উঠতেও যে জাতির মানুষ ধাক্কাধাক্কি করে আগে উঠতে চায়, তাদের কাছে ধাক্কাধাক্কিটা যে বড় প্রিয়, বড় মনোহর সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবার করোনাভাইরাস থাবা বসিয়েছে সেই প্রিয় জিনিসটা ওপর। এখন সবাইকে দূর হতে দেখেই মুগ্ধ থাকতে হচ্ছে।

সুদীর্ঘদিনের যাপিত জীবনের চর্চায় গড়ে ওঠা কালচারের ওপর আসা এই যে আঘাত, এটা কিন্তু সর্বাধুনিক পৃথিবীতে গড়ে ওঠা কোনো ইজমের হাত ধরে আসছে না। আসছে স্রেফ মানুষের বাঁচতে চাওয়ার উদগ্র বাসনার জন্য। কারণ অদৃশ্য করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষেই ছড়াচ্ছে মানুষের আবেগ আর ঘন হয়ে থাকার সুযোগ নিয়ে। কাজেই শত শত বছরের কালচারে যাই থাক, পরিবর্তিত পরিস্থিতি হচ্ছে, একা হও, নিঃসঙ্গ হও। নইলে পৃথিবীর আনন্দযজ্ঞে তোমার কোনো স্থান নেই।