নিলুফার মঞ্জুরের জন্য শোক: আমি যেন চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেছি
আমি অনেক স্কুলে কাজ করেছি। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে প্রায় ২০ বছর পড়িয়ে অবসর নেওয়ার পর অন্য কোনো স্কুলে টানা কাজ করার পরিকল্পনা ছিল না।
২০০৪ সালে একদিন ত্রপার বাবা (রামেন্দু মজুমদার) অফিস থেকে আমাকে ফোন করে মিসেস মঞ্জুরকে ধরিয়ে দিলেন। তাঁকে চিনতাম, তেমন আলাপ ছিল না। সালাম দিলাম। তিনি জানতে চাইলেন, কী করছি। বললাম, কী করব আর, বসে আছি, টুকটাক কাজ করছি।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, স্কুলে শিক্ষকতা করব না আর? আমি বললাম, আমার তো পায়ে ব্যথা। মিসেস নিলুফার মঞ্জুর তখন একটা চমৎকার কথা বললেন, ‘আপনার পায়ে ব্যথা, মাথায় তো ব্যথা নেই!’ আমি চুপ। তিনি আমাকে পরদিন স্কুলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন।
ত্রপার বাবা বাড়ি এলে জানলাম, মিসেস মঞ্জুর তাঁর অফিসে গিয়েছিলেন। কথায় কথায় আমার কথা উঠেছিল। আমি কোথাও পড়াচ্ছি না শুনে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
সানবিমস স্কুল তখন ছিল ধানমন্ডি ৬ নম্বরে। ছোট্ট স্কুলটা। পরদিন সেখানে গেলাম। তখনো আমার দুই হাঁটুর রিপ্লেসমেন্ট অপারেশন হয়নি, হাঁটতে পারি না। তো স্কুলে পৌঁছে আমি অবাক। প্রিন্সিপাল গেটে দাঁড়িয়ে আছেন আমার জন্য। আমার গাড়ির দরজা খুলে তিনি আমাকে হাত ধরে নামালেন। তখন থেকেই আমার মুগ্ধতার শুরু।
উঠান পেরিয়ে ওনার অফিস। মিসেস মঞ্জুর আমাকে বলতে লাগলেন, ‘এখানে পাথর, এখানে উঁচু, আস্তে হাঁটেন।’ অফিস রুমে যেতে একটু উঁচু দুটো সিঁড়ি। উনি বললেন, আগে একটু জিরিয়ে নিতে। ঘরে গিয়ে বসার পর দু-চারটা কথা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় কত দিন কাজ করেছি, কত বেতন চাই। তারপর আমাকে কাজে যোগ দিতে বললেন।
সেদিনই তিনি আমাকে হাত ধরে স্টাফরুমে নিয়ে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। টেলিভিশনের দৌলতে আমি তখন চেনা মুখ। সবাই বেশ হইহই করলেন। যা–ই হোক, আমি সানবিমসে ও-লেভেলে বাংলা পড়ানো শুরু করলাম। শুরু থেকেই মিসেস মঞ্জুরের প্রতি আমার আকর্ষণ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জন্ম নিল।
অনেক আগে কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ হয়েছিল। ওইটাও একটা মজার ব্যাপার। ১৯৭২ সালে আমি আর ত্রপার বাবা চাহিদা ও সামর্থ্যমতো একটা ভাড়া বাসার খোঁজে হতাশ হয়ে রাস্তায় হাঁটছিলাম। মঞ্জুর এলাহীর সঙ্গে দেখা। সব কথা শুনে তিনি জানতে চাইলেন, তাঁর শ্বশুরবাড়িতে থাকব কি না। কাছেই ইন্দিরা রোডে বাড়িটা।
আমি বললাম, কত ভাড়া দিতে হবে? আমাদের বাজেট ২ হাজার টাকা। মঞ্জুর বললেন, ভাড়া দিতে হবে না। জোরাজুরি করলে টোকেন হিসেবে মাসিক ভাড়া ধরলেন ৫০০ টাকা। বাড়িটায় বিরাট উঠান ছিল। চমৎকার ফুলের বাগান। অনেক পেয়ারাগাছ। মিসেস মঞ্জুর বলেছিলেন, আমার পছন্দমতো বাড়িটা রং করিয়ে সারিয়ে নিয়ে বিলটা তাঁকে দিতে। সেই বাসায় আমরা ছিলাম ত্রপা হওয়ার আগ পর্যন্ত।
আর এখন আমার মনে হচ্ছে, সানবিমস স্কুলে আমার কাজে ঢোকাটাও কী রকম যেন একটা গল্পের মতো। ধানমন্ডি থেকে স্কুল যখন উত্তরাতে যাবে, উনি জানতে চেয়েছিলেন, সেন্ট্রাল রোড থেকে অত দূরে গিয়ে কাজ করতে পারব কি না। বলেছিলাম, আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাই এবং এই স্কুলে কাজ করতে চাই। পারব না কেন?
ধানমন্ডির স্কুলটায় লিফট ছিল না। মিসেস মঞ্জুর বললেন, উত্তরার স্কুলে আমার কথা মাথায় রেখেই লিফট বসাবেন। আসলে লিফট তো সবার জন্যই। কিন্তু উনি যে কথাটা বলেছেন, আমার প্রাণটা ভরে গেছে।
প্রতিদিন উত্তরার স্কুলে যেতে প্রথম দিকে এক ঘণ্টা লাগত, তারপর দেড় ঘণ্টা, তারপর দুই ঘণ্টা। তারপর আড়াই ঘণ্টা। জ্যাম বেড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি নিরুৎসাহ হলাম না। শুধু এই মানুষটার জন্য! তিনি আমাকে বারবারই জিজ্ঞেস করতেন, ‘কষ্ট হচ্ছে?’ বলতাম, একবার চলে এলে আমার আর কষ্ট হয় না।
মিসেস মঞ্জুর ঢালের মতো আমার পাশে ছিলেন। নিজে খুব সম্মান দিতেন, অন্যদেরও বলতেন আমার কদর করতে। প্রত্যেককে বলতেন, আমি কোনো অনুরোধ করলে রাখতে। রাখা না গেলেও আমাকে কোনো রকম কটূক্তি না করতে। আমার নাটকের ব্যাপারটাকে তিনি খুব দাম দিতেন।
যত স্কুলে কাজ করেছি, আমার ভালোবাসার জায়গাটা—এই যে নাটক, এটাকে কেউ সম্মান দেখায়নি। সব স্কুলেই ভেবেছে যে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালনের পথে এটা একটা বাধা। মিসেস মঞ্জুর আমাদের ডেকে ‘মেরাজ ফকিরের মা’ করিয়েছেন। নাটকটা দেখে উনি আবেগে আপ্লুত হয়ে কথা বলতে পারছিলেন না।
এই যে সম্মানটা আমি পেয়েছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিটি আমাকে যে জায়গায় রেখেছিলেন, এটা আমার একটা পরম পাওয়া। জীবনেও ভুলব না এগুলো। একপর্যায়ে আমি বাড়তি দুই দিনসহ সপ্তাহে চার দিন ছুটি চাইলাম। সেই টার্ম শেষ হলে মিসেস মঞ্জুর আমার রুটিনটা এমনভাবে সাজিয়ে দিলেন যে টানা চার দিন ছুটি পেলাম।
সবার সামনে তিনি বললেন, ‘এই কদিন আপনি আপনার নাটকের কাজগুলো করবেন। ওটাকে অবহেলা করবেন না।’ যে কেউ কোনো অসুবিধার কথা বললে উনি সমাধান করতেন। আমি নিজের বেলায় প্রত্যক্ষভাবেই তা দেখেছি এবং অনুভব করেছি।
আরেকটা কথা, মিসেস মঞ্জুর কখনো বাচ্চাদের দোষ ধরতেন না। ছাত্রছাত্রীরা কেউ কোনো অন্যায় বা ভুল করলে উনি অস্থির হয়ে যেতেন। বলতেন, ‘বের করো কেন, কী হয়েছে। আমি মনে করি না বাচ্চাদের কোনো দোষ আছে।’ আর বলতেন বাচ্চাদেরও মানসম্মানবোধ আছে, ‘ওদের অসম্মান কোরো না।’
বয়সে তিনি আমার চেয়ে একটু ছোটই হবেন। করোনার সময়ে এই সেদিনও আমাকে বলেছেন, ‘আমাদের তো বয়স হয়েছে, নিজের যত্ন নেবেন। আপনাকে দরকার আছে।’ বললাম, আমি যত্ন নিচ্ছি। আপনিও নেবেন। আপনাকে সবার দরকার।
খুব প্রচারবিমুখ ছিলেন! কতবার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছি, রাজি হননি। তিনি আমাদের স্কুলের দারোয়ানকে হজে পাঠিয়েছেন। কিন্তু কোনো দিন কাউকে তা জানাননি। আমরা জেনেছি দারোয়ানের কাছ থেকে।
এত বিনয়ী! আর এত ভালোবাসা সবার জন্য! মানুষটা যে কত ভালো! স্বামী মঞ্জুর এলাহীর যত্নও তিনি খুব করতেন। সে জন্য মাঝেমধ্যে স্কুলে আসতে পারতেন না।
২০১৮ সালে আমার বই ‘যা ইচ্ছা তাই’য়ের প্রকাশনা উৎসবে এসেছিলেন। আমার অনুরোধ ফেলতে পারেননি। মঞ্চে মিসেস মঞ্জুর আমার পাশে বসেছিলেন। সেদিনের ছবিগুলো দেখছি। সেখানকার তিনজন প্রিয় মানুষকে আমি হারিয়েছি। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, আনিসুজ্জামান স্যার আর তিনি।
সেদিন তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলাম। তিনি আমার একটু পেছনে দাঁড়ালেন। সামনে আসতেই চাইলেন না। বললেন, তাঁর জায়গা পেছনে।
মিসেস মঞ্জুর ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেছেন। বাংলায় সড়গড় ছিলেন না। প্রায়ই নানা শব্দের বাংলা জানতে চাইতেন। বাংলা শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করতেন। একদিন কী প্রসঙ্গে আমি বলেছি, এদের যে তৎপরতা! আবার বলেছি, অবান্তর কথা লেখে। যেটা আসল পয়েন্ট, সেটা না দিয়ে অবান্তর কথায় ভরিয়ে দেয়।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, অবান্তর মানে কি ইররেলেভেন্ট? আমি বললাম, জি। বললেন, কেন যে বাংলা শিখলাম না! এখন শিখছি একটু একটু করে। আপনাদের বাংলা এত সুন্দর! তৎপরতা শব্দটা কী চমৎকার। এই শিক্ষাটাও আমি তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি যে ছোট-বড় সবার কাছ থেকে শেখার আছে।
স্কুল–অন্তঃপ্রাণ ছিলেন! আমরা সানবিমসের কেউই মিসেস মঞ্জুরকে ছাড়া স্কুলের কথা কল্পনা করতে পারি না। ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবদুল কাদের বলতেন যে, আপা একটা কথা বললে সেটাই যথেষ্ট।
গতকালই তাঁর ছেলে নাসিম মঞ্জুর আমাকে বলেছিল, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। মা স্ট্যাবল আছে। আপনাদের দোয়া, আশীর্বাদ আছে। ইনশা আল্লাহ ভালো হয়ে যাবেন। আপনারা সবাই দোয়া করেন।’ সে বলেছিল, দূর দূর থেকে মানুষ এসেছেন তাঁকে প্লাজমা দেওয়ার জন্য।
হঠাৎ করে যখন ওনার চলে যাওয়ার কথা শুনেছি, আমি যেন চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমার মনে হয়েছে যে আমি চলে গেলেও তো পারতাম। আমাকে তো সবার এত দরকার নেই। আমি তো এত বড় প্রতিষ্ঠান চালাই না। আর আমার এত উদারতা নেই।
এখন ভাবলেই আমার দুর্বল লাগে যে উনি ছাড়া আমি স্কুলে যাব! আমার যে আকর্ষণ ছিল, ইচ্ছা ছিল, ভালোবাসা ছিল, আমি যে শক্তি নিয়ে যেতাম—সব যেন হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তাঁকে ভালোবাসি। তাই তিনি যা ভালোবাসেন, আমি চেষ্টা করব, সেটা ভালো রাখতে।
ভালো থাকুন তিনি ওই জগতে গিয়ে। তাঁর স্কুল এবং তাঁর নীতি—কাউকে কটূক্তি না করা, কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করা, বাচ্চাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার না করা—এসব ঠিক থাকা নিয়ে তাঁকে যেন চিন্তা করতে না হয়, তা আমরা দেখব।
ফেরদৌসী মজুমদার: অভিনয়শিল্পী; জ্যেষ্ঠ শিক্ষিকা, সানবিমস স্কুল
আরও পড়ুন: