করোনা এখন অনেক কাছে

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

জাফরুল্লাহ ভাইয়ের (ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী) জ্বরের খবর পেয়েছিলাম ঈদের দুই দিন আগে। শিরিন টেলিফোনে বলেছিল, জাফরুল্লাহ ভাইয়ের জ্বর ছিল, টেস্ট হয়েছে, রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। সবার মতো আমিও জানতাম, জাফরুল্লাহ ভাইয়ের ডায়ালাইসিস হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। তাই শঙ্কাবোধ অনেকটাই বেশি। দুই দিন পর শিরিন বলল, তারও জ্বর। পরের দিন টেস্ট হলো, সে–ও পজিটিভ, তাদের ছেলে বারিশেরও একই অবস্থা। পরের দিন জাফরুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো, ঢাকা মেডিকেলে যাবেন না তিনি, আরও মুমূর্ষু রোগীর সিট তিনি দখল করতে রাজি নন। এক দিন অবস্থা ভালো থাকে তো আরেক দিন একটু খারাপ। এক দিন বাসায়, এক দিন হাসপাতালে—এভাবেই চলছে। মঙ্গলবার সকালে শিরিন বলল, তার এখন জ্বর নেই, বারিশেরও জ্বর নেই। বাসা লকডাউনে, গেটে তালা দেওয়া।

সকালে নূর খান লিটন জানাল, তার অক্সিজেন লেভেল ৯২ থেকে ৯৪–এর মধ্যে ওঠানামা করছে। জ্বর চলছে ১১–১২ দিন ধরে। বাসায় অক্সিজেন নিচ্ছে। গত তিন–চার বছরে মানবাধিকার, বিশেষত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আর গুম নিয়ে যে কয়েকটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল, তার প্রতিটির জন্য নূর খান লিটনের সাহায্য ও অংশগ্রহণ ছিল অপরিহার্য।

ড. ফিরোজ আহমেদকে সকালে ফোনে পাইনি। সোমবার কথা হয়েছিল। সে ও তার ডাক্তার স্ত্রী উভয়েই করোনায় আক্রান্ত। বেশ কয়েক বছর আগে ফিরোজ এসেছিল মক্কেল হিসেবে। তারপর অনেকবার চেম্বারে এসেছে। ‘স্যার, এই অনিয়ম, এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু না করে কেমন করে বসে থাকি? সব চেষ্টা করেছি, কিন্তু লাভ হচ্ছে না, হাইকোর্টে একটা মামলা করে দেবেন?’ এখন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, জাফরুল্লাহ ভাইয়ের গণস্বাস্থ্যের টেস্ট কিট উদ্ভাবনের অন্যতম বৈজ্ঞানিক সহকর্মী।

বন্ধু রুমির (বিমানের অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ফয়জুল ইসলাম) সঙ্গেও কথা হলো টেলিফোনে। নাজনীন, তার স্ত্রী, হাসপাতালে ২৭ মে থেকে। এখন ভালো। দু–চার দিনের মধ্যে টেস্টে নেগেটিভ এলে বাসায় চলে আসবে। বাসায় তারা সবাই নেগেটিভ।

ফজলুর রহমান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের (বিলিয়া) প্রশাসনিক কর্মকর্তা। অবৈতনিক পরিচালক হিসেবে বিলিয়ার দেখভাল করেছি ৯ বছরের বেশি সময়। গত বছরের মাঝামাঝি পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তন হলো, দ্বিমত হলো। ইস্তফা দিলাম। ঝড়ঝাপ্টা আছড়ে পড়ল ফজলুর ঘাড়ে। চার বছর আগে তাকে পদোন্নতি দিয়েছিলাম, সেই পদোন্নতি বাতিল হয়ে গেল। কেন হলো, কী অপরাধ, এর কোনো সদুত্তর নেই। ফজলু একটু নরম প্রকৃতির, সাংঘাতিক মুষড়ে গেল। বেচারার বেতনও হয়ে পড়েছিল অনিয়মিত। দিন দশেক আগে শুনলাম, তার জ্বর। ভাগ্য ভালো, দুই দিন পর ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হতে পেরেছিল। শুনেছি, ঢাকা মেডিকেলে রোগীদের মুঠোফোন ব্যবহারে কড়াকড়ি আছে। বিলিয়ার অন্য এক সহকর্মীর মাধ্যমে জেনেছিলাম, ফজলু অনেক ঘাবড়ে গেছে, অনেকের কাছেই মাফ চাইছে। টেলিভিশনে বারবার উপদেশ শুনেছি, করোনায় আক্রান্ত হলে মনোবল হারাবেন না, তাই ফজলু সম্পর্কে শঙ্কা বেড়ে গিয়েছিল। মঙ্গলবার সকালে জানলাম, সে ভালো। ডাক্তার বলেছে, দু–এক দিনের মধ্যেই বাসায় চলে যেতে পারবে।

কয়েক দিন ধরে ভয়ে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে টেলিফোন করা অনেক কমিয়ে দিয়েছি, পাছে কোনো দুঃসংবাদ পাই। গত সোমবার সিপিডির উদ্যোগে ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতিতে আনিসুজ্জামান স্যারের স্মরণসভা হলো। আনিসুজ্জামান স্যারকে স্মরণ করতে গিয়ে কেউ কেউ নিলুফার মঞ্জুরের কথাও বললেন। আমার মনে পড়ল, করোনা এখন অনেক কাছে।

২.

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কথা টেলিভিশনে শুনছি আর পত্রপত্রিকায় পড়ছি। তাঁদের কথা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু স্পষ্টতই এই কথাগুলোই সরকারের কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। তা না হলে সরকার একের পর এক সম্পূর্ণ উল্টোটা কেমন করে করছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আর উপদেশ সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য না হলে সরকারের উল্টো পথে যাত্রার নিশ্চয়ই গভীর কোনো কারণ আছে, যে কারণ আবার আমাদের কাছে দুর্বোধ্য। এখন সারা দেশকে নাকি সবুজ, হলুদ আর লাল রঙে রাঙিয়ে দেওয়া হবে। কার ভাগ্যে কী রং পড়বে কে জানে। কাকে কী নাচ নাচতে হবে আর কী গান গাইতে হবে, সেটাও সরকার নির্ধারণ করে দেবে। দুই দিন আগে শুনেছিলাম সব অফিস খোলা, এখন শুনছি ২৫ শতাংশের হিসাব। ধরেই নিচ্ছি, দু–এক দিন পর কোনো কোনো অফিসকে নতুন কোনো হিসাব কষতে হবে।

যে মন্ত্রীই টেলিভিশনের সামনে মুখ খুলছেন, সেই মন্ত্রীই বারবার আমাদের আশ্বস্ত করছেন যে সবকিছুই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে, পরামর্শে এবং উপদেশে। সবকিছুই যদি প্রধানমন্ত্রীর আদেশে, নির্দেশে, উপদেশে হয়, তাহলে মন্ত্রীদের দরকারটা কোথায়। প্রধানমন্ত্রী আর সচিবদের মাঝখানে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী আর উপমন্ত্রীদের লটবহর আমরা কেন বইব। এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর হলো সংবিধান নির্ধারণ করে দিয়েছে যে বাংলাদেশে একটা মন্ত্রিসভা থাকতে হবে। 

৩.

কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি যে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হোক। সংক্রমণ যখন বাড়ছে, তখন জীবিকাকে প্রাধান্য দেওয়ার পেছনে সরকারের গভীর কারণ আছে, সেটাই সঠিক হোক। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সব মতামত আর পরামর্শ উপেক্ষা করে সবকিছু খুলে দিয়ে সরকার একটা ভালো কাজ করেছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণিত হলে জুলাই মাস থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো উপদেশই বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবে না। আমেরিকার মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে আমরাও সদর্পে টা টা-গুডবাই বলব, সঠিক উপদেশ না দেওয়ার কারণে।

বহু বছর পর স্বাস্থ্যসেবা এখন আলোচনায় এসেছে। নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। একই কর্তব্য আছে শিক্ষার ব্যাপারেও। রাষ্ট্র ও সরকারের এ দুটি দায়িত্ব-কর্তব্য আমরা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। করোনার যত দোষই থাকুক না কেন, অধম একটা গুণ খুঁজে পেয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা যে রাষ্ট্রের কর্তব্য, অন্তত করোনা আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছে। করোনা চলে গেলেও—কত দিনে ও কীভাবে চলে যাবে, সেটা বলতে না পারলেও, এটা জোর দিয়ে বলতে হবে যে স্বাস্থ্যসেবা আমাদের অধিকার।

এ অধিকার কীভাবে আদায় করে নিতে হবে, সে নিয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, লেখালেখি, স্লোগান–মিছিল সবই করতে হবে এবং করতে হবে সবাইকে মিলে। এই পর্যায়ে আমাদের একটা প্রাথমিক প্রস্তাব আছে। যিনি বা যাঁরা সরকারি তহবিল থেকে বেতন-ভাতা, পেনশন-প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং সেই সঙ্গে সরকারি বাড়ি, গাড়ি, টেলিফোন, ইলেকট্রিসিটি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সুযোগ–সুবিধা পেয়ে থাকেন, তাঁরা অসুস্থ হলে চিকিৎসা নেবেন এই বাংলাদেশের হাসপাতালে। তাঁদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি আমাদের করের টাকা থেকে দেওয়া হয়। আমরা এখন বিদেশে তাঁদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে আর রাজি নই। যাঁরা সাংবিধানিক পদে আছেন এবং যাঁরা সরকারি চাকরি করেন, তাঁদের বেতন–ভাতার বাইরে অন্য কোনো আয় আইনত থাকতে পারে না (কিছু ব্যতিক্রম থাকলে সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত নথিতে আগে থেকেই উল্লেখ থাকতে হবে)। অতএব, নিজের পয়সা দিয়ে যাচ্ছি, সেই যুক্তিও অগ্রহণযোগ্য। আমরা একমাত্র ব্যতিক্রম করতে পারি মহামান্য রাষ্ট্রপতির জন্য।

বিরাট বিরাট কথা বলছি, কিন্তু জানি যে বিমান চার্টার করে বিলাত–আমেরিকায় উড়ে চলে যাওয়াও এখন এই দেশের কিছু মানুষের জন্য কোনো ব্যাপার নয়।


ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক