করোনাকালে রথের মেলার কী হবে?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

২৩ জুন রথযাত্রা। ফিরতি যাত্রা, মানে উল্টো রথ আগামী ১ জুলাই। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান উৎসব রথযাত্রা। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে। রথের ওপর দেবতার মূর্তি বসিয়ে চালিয়ে নিয়ে উৎসব পালন করা হয় বলেই এই উৎসবের নাম রথযাত্রা। এই দৃশ্য দেখেই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন— 

‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।’

জগন্নাথ ধাম হিসেবে পরিচিত ওডিশার পুরীতে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ওডিশার অর্থনীতিতে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব এক বিশাল ভূমিকা পালান করে। সারা পৃথিবী থেকে ভক্ত ও পর্যটক আসেন পুরীতে। রথযাত্রার সেবার জন্য ২ হাজার ২০০ জন সেবায়েত আছেন সেখানে। এ থেকেই বোঝা যায় আয়োজনের বিশালতা। তাই এই করোনাকালে কীভাবে, কোন মাত্রায় উৎসব হবে না হবে, তা নিয়ে মামলা ওডিশার হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। করোনাভাইরাসের জন্য এ বছর পুরীতে রথযাত্রা স্থগিত রাখার পক্ষে বেশ কয়েকটি আবেদন জমা পড়ে ওডিশা হাইকোর্টে। আবার রথযাত্রা বন্ধ না করার আবেদন জানিয়েও বেশ কয়েকটি দরখাস্ত জমা পড়ে। করোনা পরিস্থিতিতে এ বছর পুরীর রথযাত্রা দেখার জন্য ভক্ত বা পর্যটকদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। শুনানি শেষে হাইকোর্ট রথযাত্রা নিয়ে সিদ্ধান্তের বিষয়টি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। হাইকোর্ট জানিয়েছেন, পুরীতে রথযাত্রা এ বছর হবে কি না, তা করোনা পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এর মধ্যেই রথ তৈরির কাজ শেষ করতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন কাঠশিল্পী সেবায়েতরা। সব সেবায়েতকে সুস্থ রাখার জন্য তাঁদেরও হোমিওপ্যাথি ইমিউনিটি বুস্টার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।

জনস্বার্থবাদীরা হাল ছাড়েননি। তাঁদের আরও দুটি আবেদন জমা পড়ে আদালতে। রথ টানার সময় ভক্তদের যে হুড়োহুড়ি–ঘেঁষাঘেঁষি হয়, তা করোনার দূরত্ব বিধিমালার পরিপন্থী। তাই তাঁদের আবেদন ছিল, মানুষ নয়, অন্য কোনোভাবে রথ টানার ব্যবস্থা করা যায় কি না? আবেদনকারীরা চেয়েছিলেন, আদালত যেন রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রীয় বিধিমালা মেনে চলার জন্য লিখিত নির্দেশ দেন। জনস্বার্থবাদীদের যুক্তি ছিল কারফিউ জারি করেও সম্প্রতি স্নানযাত্রার সময়ে ভিড় ও গা-ঘেঁষাঘেঁষি ঠেকানো যায়নি। অতএব আদালত যেন বলে দেন রথযাত্রায় করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় বিধিমালা কীভাবে মেনে চলতে হবে। কিন্তু আদালত লিখিত আদেশ না দিয়ে পর্যবেক্ষণ বা পরামর্শ জানিয়েছেন। আদালত বলেছেন, এ বছর যদি রথযাত্রা করতেই হয়, তবে যন্ত্র বা হাতি বা অন্য কোনো বিকল্প উপায়ে রথ টানার ব্যবস্থা করতে হবে। দেখুন: (https://www.anandabazar.com/topic/puri) ও (https://www.anandabazar.com/topic/ratha-yatra)।
বাংলাদেশে রথ উৎসবের কথা উঠলে ঢাকার সংবাদমাধ্যম কেবল ধামরাইয়ের রথের কথা প্রচার করে। রথযাত্রা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব হলেও একে ঘিরে যে মেলা বসে, সেটা একেবারেই অসাম্প্রদায়িক। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় আর অধিকাংশ উপজেলায় রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে মেলা বসে। ৩০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী বাগেরহাট সদর উপজেলার বারুইপাড়া ইউনিয়নের লাউপালা গ্রামের গোপাল জিউর মন্দিরে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উপলক্ষে যে মেলা বসে, তাতে দেশের প্রায় সব প্রান্তের মানুষের ভিড় জমে। কেনাবেচা চলে কয়েক দিন ধরে। রাজশাহী নগরীর কল্পনার মোড় থেকে সাগরপাড়া বটতলা মোড় পর্যন্ত আধা কিলোমিটারেরও বেশি জায়গাজুড়ে বসে রথের মেলা। রাস্তার দুধারে মাটির তৈজসপত্র, মিষ্টি, খাবারের দোকান, কাঠের আসবাবপত্র, কাপড়, স্টিলের তৈজসপত্র, মাটি ও স্টিলের হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে দূরদূরান্ত থেকে আসা শিল্পী–দোকানিরা। রাজশাহীর এই মেলায় পসারি সাজিয়ে বসেন নওগাঁ, বগুড়া, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর থেকে আসা নানা ধর্মের মানুষ। উল্টো রথ পর্যন্ত চলে এই মেলা। খুলনা নগরীর আর্য ধর্মসভা মন্দির থেকে তিনটি সুসজ্জিত রথ নিয়ে হাজারো ভক্ত যান জোড়াগেট প্রেমকানন পর্যন্ত। এই রথযাত্রাকে ঘিরেও মেলা বসে।

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী শিবমন্দির চত্বরের মেলা। নেত্রকোনার দুর্গাপুর পৌর শহরের প্রাচীনতম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান শ্রীশ্রী দশভুজা মন্দির পরিচালনা কমিটির আয়োজনে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রাকে ঘিরে মেলা। বরিশালের আগৈলঝাড়ায় উপজেলা সদরের জগন্নাথ মন্দিরের মেলা ছাড়াও উপজেলার বাহাদুরপুর রথবাড়ি মেলা। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সদরের রথবাড়ির মেলা। মাগুরা শহরের সাতদোহা লেংটা বাবাজির আশ্রমকে ঘিরে রথের শতবর্ষী মেলা। বগুড়ার শেরপুরে পৌর শহরের শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের মন্দির প্রাঙ্গণ মেলা। যশোর অভয়নগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ভাটপাড়া রথের মেলা। এ ছাড়া কুষ্টিয়ার রথখোলার মেলা, রাজশাহীর পুঠিয়ার রথের মেলা, সিলেটের লামাপাড়া রথযাত্রার মেলা উল্লেখযোগ্য।

মেলা উৎসব প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ আষাঢ় মাস কৃষকের ব্যস্ততার মাস। এসব মেলা থেকে তাঁরা তাঁদের বছরের হাতিয়ার কৃষিসরঞ্জাম আর ঘরগৃহস্থালির জিনিসপত্র কেনাবেচা করেন। অনেক জনপদে রথের মেলায় একমাত্র বার্ষিক মেলা, যেখানে গ্রামীণ জীবনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সস্তায় দরদাম করে কেনা যায়। পসারিরা মাস ছয়েক আগে থেকে তৈরি হন বছরের এই সময়ের জন্য। গত বছর রাজশাহীর রথের মেলায় বৃষ্টির মধ্যে দেখা হয়েছিল খুলনার ডুমুরিয়া থেকে মাটির তৈরি তৈজসপত্র নিয়ে আসা আসলামের সঙ্গে। আসলাম, শংকর, কবির, বড়ুয়ার মতো আরও অনেকেই এসেছিলেন খুলনা অঞ্চল থেকে।

আসলামরা ১৫ বছর ধরে এই মেলায় আসেন। প্রতিবারের মতো সেবারও মেলার ঠিক মাঝামাঝি স্থানে দোকান পেতেছিলেন। সঙ্গে ছিল ছেলে, মেয়ে আর বউ। আসলাম বলেছিলেন, ‘১৫ বছর ধরে এই মেলা আসি। আট থেকে নয় দিন থাকে মেলা। তাই বউ-বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে আসি। কোনোমতে রাত কাটাই দোকানের মধ্যেই। দিনে বেচাবিক্রি করি। এখানে এক সপ্তাহ ব্যবসা করলে যা আয় হয়, তা দিয়ে তিন থেকে চার মাস কেটে যায়।’ ওই যে রবিঠাকুর যাকে ‘বৃহৎ’ হওয়া, আসলামরা ওই মেলার আট থেকে নয় দিন যতটুকু পারেন ‘বৃহৎ’ হন। তারপর তিন থেকে চার মাস সংকুচিত হতে থাকেন। যেটাকে আসলাম বলেছিলেন কেটে যায়।

বাংলাদেশের একদল খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষ নানান মৌসুমি জীবিকায় বেঁচে থাকেন। বলেন এটাওটা করি। মেলায় মেলায় পসারি সাজিয়ে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে চলে কয়েক মাস। করোনা যদি কেড়ে নেয় বছরের একটা সুযোগ, তাহলে উপোস ছাড়া তাদের পথ থাকবে না। প্রশাসন যেভাবে গ্রামীণ হাটবাজার ব্যবস্থা করছে, বন্ধ না করে দূরত্ব বজায় রেখেও রথের মেলা আয়োজন করা সম্ভব। মেলা কমিটির সঙ্গে বসে একটা ব্যবস্থা না করলে আসলামদের সামনের মাসগুলো কাটবে কীভাবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]