'বানের ভাবগতি বালা না, বাজান'

বন্যার পানির মধ্যেই খাবারের খোঁজে বেরিয়েছেন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া, অসুস্থ আয়শা বেগম। গতকাল দুপুরে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বালুগ্রামে।  ছবি: আব্দুল আজিজ
বন্যার পানির মধ্যেই খাবারের খোঁজে বেরিয়েছেন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া, অসুস্থ আয়শা বেগম। গতকাল দুপুরে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বালুগ্রামে। ছবি: আব্দুল আজিজ

বাংলাদেশের উত্তর-পুব কোণে আসাম সীমান্তের সবচেয়ে কাছের ইউনিয়নটির নাম ‘সাহেবের আলগা’। এটি ব্রহ্মপুত্র নদের একটি চর। নদ খেপলে সবার আগে টের পায় সেখানকার মানুষ। সেখানকার বাসিন্দা জসিম মোল্লা একসময় রাজনীতি করেন। এখন শুধু ঘর গেরস্থালি নিয়েই থাকেন। তাঁকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, ‘বান-বন্যা হলেই খালি তোমাগো ফোন আসে। এবার বানের কোন ভাউ বুছতেছি না। চারোদিক থেকেই পানি আসে দেখি। ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, হলহলিয়া, ঝিনঝিরাম সব একসাথে ডাক ছারিছে। উপারের খবর কিছু জানো?’ জসিম মোল্লার কাছে ‘উপার’ মানে আসাম। তাঁকে বললাম, আসামের খবর ভালো নয়, বন্যায় মারা গেছে ১৬ জন। ডিব্রুগর শহর পানিতে তলিয়ে গেছে। এটা ইতিহাসের প্রথম ঘটনা। 

জসিম মোল্লা বললেন, ‘ডিব্রুগরের ওটা বন্যা লয় জলাবদ্ধতা। উটা বদ উন্নয়নের ফসল। ডিব্রুগরের একদিক দিয়ে রেল লাইন, আরেক দিক দিয়ে বাই পাস বানাইছে না? পানি যাওয়ার নাস্তা (রাস্তা) রাখে নাই। উখানকার পানি মেপে হামার লাভ কী? ধুবরির কী অবস্থা?’

আসামের ধুবড়ির মাঠঘাট, নিচু জায়গার বসতি ডুবে গেছে; পানি আরও বাড়বে। আসামের ব্যারাজগুলোর গেট খুলে দেওয়া হচ্ছে একে একে। কখন কোন গেট খোলা হচ্ছে আর কতটুকু পানি ছাড়া হচ্ছে আর তার সঙ্গে বৃষ্টিপাতের হিসাব না কষলে বন্যার সঠিক ভাউ বোঝা সম্ভব নয়।

ভারতের সঙ্গে ৫০ বছরেও নদী, বন্যা, ব্যারাজের পানি ছাড়া, পানি আটকানোর আলোচনার কূলকিনারা হলো কই। জসিম মোল্লাদের বন্যার ‘ভাউ’ বোঝার প্রধান অনুষঙ্গ এখন আকাশ মেঘ বৃষ্টি পূর্ণিমা অমাবস্যা নয়, তাঁরা জানতে চান, আসাম কবে কোন ব্যারাজে কখন কতটুকু জল ছাড়বে। এবার মনে হয় কোনো দুর্যোগই আমাদের ছেড়ে কথা বলতে চাইছে না। বন্যাও হানা দিতে আসছে। করোনার কারণে মার্চ থেকে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ইত্যাদি ঠিকমতো হয়নি। নদনদী, খালবিলের ধারণক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ৬৪ জেলায় পুনঃখনন প্রকল্পের ধীরগতি, অনিয়ম বন্যার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পুনঃখনন প্রকল্পের অনিয়মের খবর নিত্যদিনের। 

প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড় জেলার পাঁচটি নদী ও একটি খাল পুনঃখননের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে। মোট ১৬টি প্যাকেজে করতোয়া, চাওয়াই, ভেরসা, পাথরাজ, বুড়িতিস্তা নদ–নদী ও বড়সিঙ্গিয়া খালের মোট ১৬৪ কিলোমিটার পুনঃখনন কাজ চলছে। এর মধ্যে বোদা উপজেলার পাথরাজ নদের শুরুর অংশের ১২ কিলোমিটার পুনঃখনন শুরু হয় গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি। কাজটি পায় ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে তারা নিজে কাজ না করে স্থানীয় এক ঠিকাদারের কাছে নাকি বিক্রি করেছে। তারা গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাজ শুরু করে এক মাসেই মধ্যেই শেষ করেছে। দায়সারাভাবে খনন করায় স্থানীয়দের চাপে তারা পড়ে আবারও গত জানুয়ারিতে খনন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আবারও কয়েক দিনেই দায়সারাভাবেই কাজ শেষ করেছে।

৫০ মিটার প্রশস্ত নদটি প্রথম দফায় ২০ মিটার আর পরে ১০ মিটার পুনঃখনন করেই ৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকার মধ্যে বেশির ভাগ বিল তুলে নিয়েছে। বোদা উপজেলা সদরের পাথরাজ নদের প্রামাণিকপাড়া থেকে শুরু করে ১২ কিলোমিটার ৩ মিটার গভীর খননের কথা থাকলেও ১ মিটারের বেশি গভীর খনন করা হয়নি। যেখানে-সেখানে খননের মাটি-বালু ফেলে রাখা হয়েছে। পাড়ের মাটি সমান করে ঘাস ও গাছ লাগানোর কথা, কিন্তু তা–ও করেনি। এ রকম অনিয়মের অভিযোগ আরও নানা স্থানে আছে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলেছে, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া, দিনাজপুর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও সুনামগঞ্জে বন্যা হতে পারে। দেশের অন্তত পাঁচটি নদীর পানি পাশের জেলাগুলোর ঘাট-মাঠ, বাড়িঘরে ঢুকে পড়তে পারে। সব মিলিয়ে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১৮ জেলা বন্যার কবলে পড়তে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে।

কিন্তু এই দুঃসময়ে মানুষ যাবে কোথায় 

ফুলছড়ি উপজেলার বালাসি ঘাট থেকে সাঘাটা উপজেলার ভাঙ্গার মোড় পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার বাঁধ মেরামতের সময় বাঁধের বাসিন্দা প্রায় ১৫ হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। বাঁধে ফিরে আসা ছাড়া তাদের আর কী উপায়? বন্যায় আশ্রয়ের আরেক জনপ্রিয় স্থান স্কুলঘর। সেগুলোও তিন-চার মাসে প্রায় ভুতুড়ে অবস্থায়। মাইকিং করার পাশাপাশি এগুলোর ব্যবস্থাপনায় মন দেওয়া দরকার। অতিরিক্ত পানির কলের ব্যবস্থা, হাত ধোয়ার জায়গা, ল্যাট্রিন স্থাপন এবং সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ এখনই নিতে হবে।

বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র ১৬-১৮ জেলায় সামনের ১০-১২ দিনের যে মাঝারি মাত্রার বন্যার পূর্বাভাস দিচ্ছে, তা হবে এই মৌসুমের প্রথম বন্যা। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের বন্যা রয়েছে সামনে। অভিজ্ঞতা বলে, নিচু এলাকাগুলোর মানুষেরা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে অপেক্ষা করে পরের ধাপের বন্যা পর্যন্ত। এই করোনাকালে তাদের আশ্রয়ের জায়গাগুলো নিরাপদ করতে হলে কিছু বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে। 

এই ইঁদুরদের ধরতে হবে

বাঁধ তৈরি ও মেরামত, খাল খনন, নদী ব্যবস্থাপনার কাজে যেসব লোক ক্ষতিকর ইঁদুরের মতো তৎপরতা চালায়, মানে অনিয়ম-দুর্নীতিতে লিপ্ত থেকে বন্যার সমস্যা বাড়ায়, তাদের দমন করা অত্যন্ত জরুরি। সম্প্রতি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর পিএস হাদিস মীর দুর্নীতির দায়ে চাকরি হারিয়েছেন; কিন্তু মন্ত্রণালয় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেনি। মামলা না হলে পুলিশ তাঁকে কতক্ষণ আটকে রাখবে?

বাঁধ তৈরি ও মেরামত, খাল খনন ও নদী ব্যবস্থাপনার সরকারি কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা না হলে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও বন্যার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। 

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক