কিছু মৃত্যু, করোনা মহামারি ও আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমার আজকের লেখাটির মূলে যাওয়ার আগে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে আমার পরিচিত ও শ্রদ্ধেয় যাঁরা এই করোনাকালে মারা গেছেন, তাঁদের আত্মার প্রতি মাগফিরাত কামনা করছি। প্রথমে যাঁর কথা মনে আসে, তিনি এ দেশের শ্রদ্ধেয় ও সৎ ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান। ১ জুলাই অনেক দিন অসুস্থ থাকার পর মারা গেছেন। লতিফুর রহমানের সঙ্গে আমার তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না, যতটুকু ছিল, তা ছিল সামাজিক পরিচয়। অল্পবিস্তর লেখালেখির কারণে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার–এর উদ্যোক্তা হিসেবে এই অমায়িক অতি শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি পত্রিকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কথা হয়েছে।

এই দুই প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে যতবার গিয়েছি, ততবার তিনি আগ বাড়িয়ে সম্ভাষণ করেছেন। মৃদু কথাবার্তা বলতেন। প্রায়ই বলতেন যে আমার লেখা তিনি মাঝেমধ্যে সময় পেলেই পড়তেন। যেকোনো অনুষ্ঠানে তিনি যেখানেই থাকতেন, সবার সঙ্গে নিজে গিয়ে কথা বলতেন, ধন্যবাদ জানাতেন। স্বল্পভাষী অমায়িক মানুষ ছিলেন। লতিফুর রহমান আধুনিক শিল্পায়নে দেশের অর্থনীতিতে শুধু জোগানই দেননি, প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে হৃদয়ে অনেক বেদনা নিয়ে বেঁচে ছিলেন। পিতা হিসেবে কন্যা হারিয়েছেন আততায়ীর হাতে, পিতামহ হিসেবে সুযোগ্য নাতি হারিয়েছেন হোলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায়। এর চার বছর পর একই দিনে দেশের এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব মারা যান। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর প্রতিষ্ঠান আর অর্জিত সুনামের মাধ্যমে। তিনি করোনায় আক্রান্ত হননি কিন্তু তাঁর শেষ বিদায়টি করোনার কারণে যেমন হওয়ার ছিল, তেমন হয়নি।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা গেলেন এ দেশের আরেকজন শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি ও যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করছে তাঁর যমুনা গ্রুপ। মিডিয়া জগতে তিনি রেখে গেছেন দুটি প্রতিষ্ঠান—‘যুগান্তর’ ও ‘যমুনা টেলিভিশন’। এই দুই প্রতিষ্ঠানের এবং সামাজিক যোগাযোগের কারণে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় বলেছিলেন যে তিনি ভবিষ্যতে বিদেশি মানের দুটি হাসপাতাল তৈরি করবেন, যার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশিদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কমাবেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাঁকে সে সময়টুকু দেননি।

এ ছাড়া এ সময়ে প্রাণ হারিয়েছেন আমার অনেক শ্রদ্ধেয় ও কাছের মানুষ সাবেক নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাইমিনুল ইসলাম। সবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

দুই.
নুরুল ইসলাম বাবুল চেয়েছিলেন তিনি দুটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল তৈরি করবেন। আগে যদি তিনি এ কাজ হাতে নিতেন, তাহলেও কি আমাদের রাজনীতিবিদ ও বিত্তবানেরা সামান্য অসুস্থতা এমনকি যৎসামান্য চেকআপের জন্য ব্যাংকক বা ভারতে দৌড়াদৌড়ি করা বন্ধ করতেন? আমার তাতে সন্দেহ রয়েছে। আমাদের ক্ষমতাসীনেরা যখন তাঁদের সামান্য অসুস্থতার জন্য বাইরে চলে যান, তখন হয়তো তাঁরা একবারও ভাবেন না যে যাঁদের নামে নেতা হয়েছেন, তাঁদের অবস্থা কী? সাধারণ মানুষ ন্যূনতম পক্ষে তাঁদের সাধারণ চিকিৎসাও পান না। যাঁরা সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের অবস্থা ভেবে দেখার মতো।

স্বাধীনতার পর থেকে বাদ দিলাম তবে ১৯৯১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে কত হাজার টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, তার পরিসংখ্যান অবশ্য সরকারের কাছে রয়েছে। তবে সূত্র মোতাবেক ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাথাপিছু বছরে খরচ ছিল ৩৬ মার্কিন ডলার। কিন্তু এখন ২০২০ সালের এ সময় যখন সমগ্র বিশ্ব করোনা নামক মহামারির প্রকোপে রয়েছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ আর সাধারণ মানুষের ন্যূনতম স্বাস্থ্যব্যবস্থা করোনার প্রকোপে তথৈবচ। এই মহামারিতে বাংলাদেশে সব অর্জন ধসের মুখে পড়েছে। এই মহামারি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ খাত স্বাস্থ্য খাতের এত দিনের ফানুস থেকে বাতাস বের করে দিয়েছে। মাত্র তিন মাসের মাথায় এই একটি খাত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে এত দিন এই খাতে যে দুর্নীতির কথা শুনে আসছি, তার কিছু আলামত দেখছি মাত্র।

প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেস ব্রিফিংয়ে ঘোষণা দেওয়া হয় যে বিভিন্ন হাসপাতালে কত বেড খালি আছে, এমনকি সিসিইউতে কত বেড খালি রয়েছে। কয়েকটি কোয়ারেন্টিন কেন্দ্র রোগীর অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অধিদপ্তর অবশ্যই তাদের মতো করে ব্যাখ্যা দিচ্ছে, যা খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়। বস্তুত পক্ষে সাধারণ মানুষ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এটাই সত্য। সাধারণ মানুষ মনে করেন, হাসপাতালের অব্যবস্থায় মৃত্যুবরণ করার চেয়ে বাড়িতেই যা হওয়ার হোক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটা নির্মোহ জরিপ করলেই এই মতামতের সত্যতা পাবে। অবশ্য নিজেরাও যে উপলব্ধি করছে বা তেমন নয় কিন্তু সার্বিকভাবে রাজনৈতিক পর্যায়ে জবাবদিহির অভাবের কারণে সঠিক তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে না।

তিন.
স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির যে চেহারা বের হয়েছে, সেগুলো নিয়ে খোদ মন্ত্রণালয়ও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। করোনা মহামারি না হলে হয়তো জনসমক্ষে এ ধরনের নিদারুণ চিত্র ফুটে উঠত না। করোনার কারণেই আমরা জানতে পারলাম সাহেদ করিম আর ডা. সাবরিনার মতো লোকজন কীভাবে মন্ত্রণালয়ের নাকের ডগা দিয়ে উইপোকার মতো দেয়াল নড়বড়ে করেছে। তাঁরা তো শৈলপ্রবাহের এক মাথামাত্র। কীভাবে তাঁরা বেড়ে উঠেছেন রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক ছত্রচ্ছায়ায়, তা যদি বের না করা হয়, তবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। যখন অধিদপ্তর বলে তারাও তাঁদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে, তখন আর কী বলার থাকে।

করোনা মহামারির প্রথম পর্যায়েই আমরা মাস্কের ও পিপিইর কেলেঙ্কারি দেখলাম। যে পরিচালক প্রথমেই এ দ্রব্যাদির মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তিনিই টিকতে পারেননি। ওই সময়ে কোনো সংস্থাই বিষয়টি খতিয়ে দেখেনি এমনকি দুদকও নয়, যার খেসারত দিতে হয়েছে পঞ্চাশের অধিক এ দেশের অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসককে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেকর্ড করেছে। সময় থাকতে হস্তক্ষেপ করলে হয়তো এমন না–ও হতে পারত।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, যা নাগরিকের মৌলিক অধিকার অন্যতম। এ খাতের যে চরম অবস্থা দেখা যাচ্ছে তার একমাত্র কারণ দুর্নীতি আর সম্পূর্ণ অব্যবস্থা, এক সাহেদ করিম আর সাবরিনাই এমন প্রতারক, আরও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আমলা। এমনকি সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে সাহেদ করিমরা প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় লালিত হচ্ছেন। তাঁদের সমূলে উৎপাটিত না করলে এবং সর্বক্ষেত্রে সুশাসনের মাধ্যমে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে বাংলাদেশের সব উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। এই করোনা মহামারি এমনটাই দেখাচ্ছে।

এম সাখাওয়াত হোসেন : নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র ফেলো (এনএসইউ)
[email protected]