বন্যাদুর্গত মানুষ

দেশব্যাপী প্রাণঘাতী করোনার মধ্যেই প্রথমে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে। আম্পানের রেশ কাটতে না কাটতেই এল বন্যা। এবারের বন্যায় দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকা কমবেশি প্লাবিত। প্রথম উত্তরাঞ্চলে বন্যা আঘাত হানলেও পরে এটি মধ্যভাগেও ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি পরিসংখ্যানেই বলা হয়েছে, ৪২ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়েছেন মাত্র ৮০ হাজার মানুষ। বাকিদের অনেকে আধা ডুবন্ত ঘরবাড়িতে থাকতে কিংবা বাঁধ বা উঁচু সড়কের পাশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। দুর্গত মানুষের মধ্যে আহাজারি বাড়ছে। 

এই যে লাখ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তঁাদের সহায়তায় সরকার কী করেছে? কতজনকে সহায়তা দিয়েছে। গতকাল উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি বন্যা আক্রান্ত জেলা জামালপুর, কুড়িগ্রাম, রংপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের প্রথম আলো প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। বন্যাদুর্গত খুব কম মানুষই সরকারি ত্রাণসামগ্রী পেয়েছেন। অন্যান্য বার বেসরকারি সংস্থাগুলো সহায়তার হাত বাড়াত। করোনার কারণে এবার তাদের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণ নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রথমত যেসব এলাকা বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেসব এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র কম। 

দ্বিতীয়ত, আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে শুকনো খাবারই ত্রাণসামগ্রী হিসেবে বিতরণ করা হয়। কোথাও চালের সঙ্গে ডাল ও শিশুখাদ্য থাকে। কোথাও বা শুধু চাল। যে মানুষগুলোর ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ডুবে গেছে, তাঁরা চাল দিয়ে কী করবেন। শুকনো খাবার খেয়ে কত দিন থাকবেন? তৃতীয়ত, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হয়। তাঁরা এ নিয়ে ‘ভোটের রাজনীতি’ করে থাকেন। বেশ কয়েকটি জেলা থেকে বরাদ্দ করা ত্রাণসামগ্রী তথা চাল মাপে কম দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে ত্রাণসামগ্রী গ্রহণকারীদের কাছ থেকে। 

 চাহিদার তুলনায় ত্রাণসামগ্রী সব সময়ই কম থাকে। কিন্তু যেখানে ১০০ মণ ত্রাণসামগ্রী প্রয়োজন, সেখানে যদি ৫ মণ দেওয়া হয়, তাহলে বণ্টন নিয়ে তো ঝামেলা হবেই। ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হোক বা কম হোক, সব জেলায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে যেসব জেলার বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, সেসব জেলার দুর্গত ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবে কম পেয়েছেন। 

ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা রহিত করতে সরকারের উচিত গতানুগতিক বিতরণব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা এবং একটি সুষ্ঠু নীতিমালার ভিত্তিতে কাজটি করা। ত্রাণসামগ্রী বিতরণের সঙ্গে যেসব সব মন্ত্রণালয় যুক্ত, বিশেষ করে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি, খাদ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা লোকদেখানো বৈঠক না করে একটি বিশেষ সেল তৈরি করুক। সেই সেল বন্যাদুর্গত অঞ্চলের গরিব ও প্রান্তিক মানুষের একটি স্থায়ী তালিকা করবে। স্থানীয় প্রশাসন সেই তালিকার ভিত্তিতে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করবে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে হবে সুষ্ঠু নীতিমালার ভিত্তিতে। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তাই যা করার এখনই করতে হবে। 

মন্ত্রী-এমপিদের হস্তক্ষেপে যাতে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বেশি আশ্রয়কেন্দ্র এবং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বেশি আশ্রয়কেন্দ্র না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।