একজন জাহানারা ইমাম

জাহানারা ইমাম
জাহানারা ইমাম

মুখে ক্যানসার নিয়েই লড়লেন একজন জাহানারা ইমাম। সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক হাসপাতালে কর্কট ব্যাধির সঙ্গে চূড়ান্ত বোঝাপড়া করার ক্ষণেও তিনি বিস্মৃত হলেন না স্বীয় কর্তব্য। এই সুন্দর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার অব্যবহিত আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রার্থী এ দেশের জনতার উদ্দেশে কম্পিত হাতে লিখলেন তাঁর শেষ বার্তা। পরম আস্থার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভার দিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন গণমানুষের ওপর। দৃঢ়তার সঙ্গে শেষ বাক্যে লিখলেন, ‘জয় আমাদের হবেই’।
এটি তো জনগণের প্রতি শুধু একজন লেখক বা শহীদমাতা জাহানারা ইমামের বার্তা নয়, এটি ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র আহ্বায়ক জাহানারা ইমামের শেষ নির্দেশ। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন তাঁর দেহাবসানের সেই মর্মান্তিক ক্ষণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত আমার মতো লক্ষ-কোটি কর্মীর কাছে একচিলতে কাগজে লেখা জাহানারা ইমামের সেই বার্তাই ছিল শোক থেকে শক্তি সঞ্চার করার প্রেরণা। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এরও ১৬ বছর পর ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এ দেশে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচারের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়, যার বিচার কার্যক্রম চলছে। ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বেশ কয়েকজনের বিচার হয়েছে, কয়েকজনের শাস্তি কার্যকর হয়েছে এবং আরও অনেকের বিচার–প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন সূচিত হওয়ার মাত্র আড়াই বছরের মাথায় অনিবার্য মৃত্যুর কোলে নিজেকে সমর্পণ করলেন জাহানারা ইমাম। ফলে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি খুব অল্প সময় পেয়েছেন, কিন্তু নিঃসন্দেহে তাঁর অসমসাহসী গঠনমূলক নেতৃত্বের কারণে তিনি বাংলাদেশে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সেনাধিপতি হিসেবে জনমনে স্থান করে নিতে সমর্থ হয়েছেন। বিষয়টি যত সহজে উল্লেখ করা গেল, আদতে গণমানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়ার বাস্তবতা ছিল ভয়ংকর রকমভাবে কঠিন। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় স্মরণে রাখা জরুরি।
১. স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর খালেদা জিয়া সরকার গঠনের মাত্র এক বছরের মধ্যে এই আন্দোলন শুরু হয় যখন স্বৈরাচার হটানোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে গঠিত তিনটি জোট (শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আট দল, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত দল এবং রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে পাঁচ দল) রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিল; ২. জাহানারা ইমাম যে সমন্বয় কমিটির নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেলেন তাতে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠন ও ছাত্র-জনতাই শুধু যুক্ত ছিল না, সেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। এই বাস্তবতায় এমন এক মৌল রাজনৈতিক ইস্যুতে জাতীয় সমন্বয় কমিটির কান্ডারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সহজসাধ্য কর্ম নয়। দারুণ এক বৈরী সময়ে নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল তাঁকে, যখন ক্ষমতায় ছিল জামায়াতপুষ্ট খালেদা জিয়ার সরকার। তবে তিনি সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, প্রয়াত রাজনীতিক আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদসহ আরও বেশ কয়েকজনের সহযোগিতা পেয়েছেন, যা তাঁকে নিশঙ্কচিত্তে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
আন্দোলন চলাকালে শহীদসন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ’৭১-এর প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকার জিপিওর সন্নিকটবর্তী তাহের মিলনায়তনে প্রত্যক্ষ করেছি জাতীয় সমন্বয় কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির সভার সভাপতি জাহানারা ইমাম কী দৃঢ়তার সঙ্গে সামাল দিয়ে চলেছেন নানা পথ ও মতের নেতাদের। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে তাঁর নিজের বাড়ি ‘কনিকা’য় চলত সভার পর সভা। সেখানে উপস্থিত থাকার অনুমতি ছিল বিধায় আরও কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি দৃঢ়চেতা নেতা জাহানারা ইমামকে। তাঁর নেতৃত্বের আরেকটি বিশেষ দিক হলো, তিনি এই আন্দোলনে নবীনদের সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়াকে শুধু প্রাধান্যই দিতেন না, তাদের ভাবনাকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণ করতেন।
আন্দোলনের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা বাদল খানের দেওয়া কমলা রঙের ভক্স ওয়াগনে চড়ে শহীদজননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে ঢাকার এখানে-সেখানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে যাঁদের, তাঁদের মধ্যে আমিও একজন। তাই গাড়িতে জাহানারা ইমাম আমাদের সঙ্গে প্রয়োজনানুযায়ী অনেক কথা বলতেন। ফলে শুধু নেতা নয়, ব্যক্তি জাহানারা ইমামের সংস্কৃত-মনের আভাসও পেয়েছি। একই সঙ্গে রুচিশীল, উদারহৃদয় জাহানারা ইমামের রুদ্র রূপও প্রত্যক্ষ করেছি। আন্দোলনের জন্য হুমকি হতে পারে এমন যেকোনো বিষয়ে তিনি ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠ। আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি সফল করতে তিনি যেমন প্রেরণাদায়ী কথা বলতেন, তেমনই প্রয়োজনমতো কঠোর স্বরেও কথা বলতেন। কর্নেল নুরুজ্জামানের সঙ্গে আলোচনার সময় তাঁকে একাধিকবার রাগতস্বরে প্রতিবাদ করতে দেখেছি। বাসায় ফোনালাপের সময় আন্দোলন নিয়ে লেখক হ‌ুমায়ূন আহমেদের মনোভঙ্গিতে জাহানারা ইমামকে দেখেছি ভীষণ ক্ষিপ্ত হতে এবং কষ্ট পেতে। ১৯৯৪-এর প্রথম দিকে হঠাৎ কর্নেল শাহেদ আহমেদ যশোর আদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে বসেন, যা জাহানারা ইমামকে উদ্বিগ্ন ও অস্থির করে তোলে। চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় তিনি সেখান থেকে চিঠি ফ্যাক্স করে জানতে চাইতেন কেন এসব হচ্ছে। তাঁর কথা ছিল পরিষ্কার, এই আন্দোলনের মূল দাবি ফৌজদারি আদালত নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
যাই হোক, স্বল্পপরিসরে জাহানারা ইমামকে নিয়ে লেখা কষ্টসাধ্য কাজ। তাঁর মৃত্যুর পর বিস্মিত হয়ে দেখেছি যাঁরা তাঁকে গালমন্দ করেছেন তাঁদের অনেকেই রং পাল্টে নিজের স্বার্থে জাহানারা ইমামের কত কাছের মানুষ ছিলেন, তা প্রমাণ করতে মরিয়া হয়েছেন। জানি, এতে মহান নেতা জাহানারা ইমামের কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না, কেননা, তিনি সব কূপমণ্ডূকতা, সংকীর্ণতা জয় করে নেতৃত্ব দিয়েছেন ‘আলোর পথযাত্রীদের’ এবং তাঁর এই আন্দোলনের যোগ্যতম সমান্তরাল রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ইস্পাত-দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঐতিহাসিক ঘটনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। আজ জাহানারা ইমামের জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করছি।
তৌহীদ রেজা নূর: প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, প্রজন্ম ’৭১ (মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তান)।