অন্তর্লীন পাখিরা আপনাকে ডাকছে

আনিসুল হক (১৯৫২—২০১৭)
আনিসুল হক (১৯৫২—২০১৭)

আনিসুল হক আমাদের কাছে ছিলেন তারকা। আমরা থাকতাম রংপুরে, সাদাকালো টিভি দেখতাম, তখন তিনি উপস্থাপন করতেন ‘এখনই’ নামের একটা অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে মজা থাকত, রসিকতা থাকত, আর তিনি সুযোগ পেলেই সুন্দর কণ্ঠে, অননুকরণীয় ভঙ্গিতে শোনাতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। আমার কানে এখনো বাজে তাঁর সেই উচ্চারণ, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি।’ একবার তাঁর একটা অনুষ্ঠানে বালিশ নিয়ে মল্লযুদ্ধ করছিলেন দুজন, তিনি নিজে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন, আমি মুগ্ধ। সেই থেকে আমি জানি, উপস্থাপক নিজে যদি প্রাণ খুলে হাসেন, সেটা দর্শকদের মধ্যে সংক্রমিত হয়। পরে আব্দুন নূর তুষারকে আমি বলেওছিলাম, ‘তুষার, ক্যামেরার সামনে হাসবে, ভালো লাগে।’

আনিসুল হক ‘আনন্দমেলা’ উপস্থাপন করেছিলেন; উপস্থাপন করেছিলেন ‘সবিনয়ে জানতে চাই’, যাতে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের নেতারা নাগরিকদের কাঠগড়ায় হাজির হয়েছিলেন।

নিজের পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন কষ্টের মধ্য দিয়ে। প্রথম আলোর অদম্য মেধাবী বৃত্তি প্রদানের অনুষ্ঠানে এসে গত বছরও তিনি তাঁর সেই সংগ্রামের গল্প শুনিয়েছিলেন। আমরা চোখ মুছছিলাম, বেদনায় নয়, গৌরবের আবেগে। ছোট থেকে বড় হয়েছেন, অনেক বড়, আমাদের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা, বিজিএমইএর নেতা, সার্ক চেম্বারের নেতা। এত ধনবান মানুষ, কিন্তু ভালোবাসতেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের। আমাদের ডাকতেন তাঁর বাসায়। তিনি যখন ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাটে থাকেন, তখনো তাঁর বাসায় গেছি। যখন বনানীতে সুন্দর বাসা বানালেন, তখনো তাঁর বাড়িতে নৈশভোজে যোগ দেওয়া ছিল প্রায় নিয়মিত ব্যাপার। নানান উপলক্ষ থাকত। মেরিল-প্রথম আলোর উপস্থাপক হয়েছিলেন একবার। তার আগে রোজ তাঁর বাড়িতে বসতে হতো, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আব্দুন নূর তুষার, ছড়াকার রোমেন রায়হান প্রমুখ থাকতেন সেখানে। এর বাইরে, বিদেশ থেকে কোনো কবি এসেছেন, কী তিনি নির্বাচন করবেন, কী তিনি টেলিভিশন স্টেশন আরম্ভ করবেন, তাঁর সান্ধ্যভোজে আমাদের ডাক পড়ত। সেই ডাক ছিল আন্তরিক, বন্ধুর মতো ডাকতেন, বড় ভাইয়ের মতো আদেশ করতেন, আর পরামর্শ শুনতেন ছোট ভাইয়ের মতো।

একবার আমাদের ডাকলেন। আমি, মালেকা আপা, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার—এ রকম কয়েকজন—কী ব্যাপার, না, আমরা নাকি পুরস্কার পেয়েছি। সেবার আমি পেয়েছিলাম বাংলা একাডেমি পুরস্কার, অন্যরা আরও গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাঁর বাসায় সংবর্ধনার মতন দেওয়া হলো আমাদের, তিনি আর রুবানা আপা আমাদের হাতে তুলে দিলেন লেখা আর পোর্ট্রেট মিলিয়ে আঁকা ছবি। হামিদুজ্জামান স্যারের আঁকা।

সমরেশ মজুমদার এসেছেন, আনিসুল হকের বাসায় সন্ধ্যায় আড্ডা। একবার তো রুবানা আপারা ঢাকায় সার্ক লিটারেরি ফেস্টিভ্যালও করেছিলেন। কাজেই সন্ধ্যার পরে তাঁর বাসায় লেখক আড্ডা। এ-ই চলছিল।

একটা ঘটনা কোনো দিনও ভুলব না। ১৯৯৫ সাল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সান্ধ্য আড্ডা। মেরিনার তখন অ্যাডভান্সড স্টেজ। পদ্য জন্ম নেবে কিছুদিন পর। আমরা ফিরব ওয়ারীর বাসায়। আনিসুল হক ভাই বললেন, চলেন, নামিয়ে দিয়ে আসি, বলে নিজে গাড়ি চালিয়ে বাংলামোটর থেকে ওয়ারী পর্যন্ত গিয়ে নামিয়ে দিয়ে এলেন।

তাঁকে ফোন করলেই পাওয়া যেত। তিনিও ফোন করতেন। প্রতিটা উপলক্ষে উৎসবে পার্বণে শুভেচ্ছা পাঠাতেন এসএমএস করে।

আমাদের নামের মিল ছিল। এটা নিয়ে রসিকতা করতেন। বলতেন, লোকে বলে আজকের লেখাটা ভালো ছিল, আমি অস্বীকার করি না, বলি, আর ভাই লেখা...

আমি বলি, লোকে আমার বই কেনে, আর বলে, দারুণ উপস্থাপক, কেনো কেনো, বই কেনো। আমিও কিছু বলি না, বাসায় গিয়ে লেখকের ফটো দেখে হতাশ হবে।

মেয়র হওয়ার পরে তিনি সত্যি সত্যি ঢাকা শহরটাকে পাল্টে দিয়ে সুন্দর করতে চেয়েছিলেন। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড পরিষ্কার করার কঠিন কাজটা করলেন। আমাদের বলতেন, ‘সবচেয়ে বড় বাধা আসে দল থেকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমাকে সবুজ সংকেত দিয়েছেন, কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না।’

গাবতলীর রাস্তাটা পরিষ্কার করা যাবে, কে ভেবেছিল। তিনি করেছিলেন। ঢাকা উত্তরে টয়লেট বানিয়েছেন, ঝকঝক করছে। কারওয়ান বাজার সাফ করার কাজ অর্ধেক হয়েছিল, তিনি থাকলে বাকিটা হতো। উত্তরার রাস্তাঘাট সুন্দর করে ফেলেছিলেন। বিমানবন্দর সড়কের দুই ধারের দেয়ালগুলো ভেঙে দিগন্ত বড় করেছেন, সবুজ করেছেন। ওই সড়কটায় ইউলুপ বসানোর কাজ হাতে নিয়েছিলেন, যাতে যানজট না থাকে। একবার একটা বাড়িতে আগুন লাগল, তিনি সারা রাত সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

চিকনগুনিয়া নিয়ে যখন তাঁর সমালোচনা হলো, এটা তিনি মানতেই পারছিলেন না। আমাদের সঙ্গে অভিমান করেছিলেন। তার কিছুদিন আগে হোটেল সোনারগাঁওয়ে আমরা তাঁর কাজকর্মের ভিডিও দেখলাম, তাঁর পরিকল্পনা দেখলাম। সেটার ইতিবাচক প্রচার আমরা দিয়েছিলাম। তাঁর বড় সাক্ষাৎকার আমাদের কাগজে প্রকাশ করা হয়েছিল। সর্বশেষ আমরা, প্রথম আলোর ঈদ আয়োজনে, তাঁর স্টাইল নিয়ে বিশেষ আয়োজন করেছিলাম। তিনি সময় দিয়েছিলেন। আমাদের কর্মীকে গাড়ি চালিয়ে বনানী থেকে গ্রিন রোডে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।

তারও আগে ‘শিল্পীর পাশে আমরা’ কর্মসূচি শুরু করলেন। শিল্পীদের হাতে চেক তুলে দেওয়া হলো। আমরা গিয়েছিলাম। তাঁর পাশে পাশে ছিলাম। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বিশেষ রকমের ভক্ত ছিলেন, আব্দুন নূর তুষারকে স্নেহ করতেন, আর আমাদের করতেন আদর।

আর এর চিকিৎসা, ওর দুস্থতা, আমার চাঁদাবাজির তালিকায় প্রথম নামটি ছিল আনিস ভাইয়ের। ‘এ’ দিয়ে নাম শুরু হওয়ার এ এক বিপদ বটে।

তাঁকে আমার মনে হতো একজন সুন্দর মানুষ। সুন্দর মানুষ মানে ভালো মানুষ। সুন্দর করে থাকেন, সুন্দর করে কথা বলেন। চারপাশের মানুষেরা সুন্দর থাকুক, এটা চান। আর চান দেশটা সুন্দর হোক। শহরটা সুন্দর হোক।

দেশ টিভিতে একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম। দুই আনিসুল হক। বিনয়ী মানুষ। রাজি হয়েছিলেন।

আর কী লিখব। তাঁর দেওয়া ছবিটা দেয়ালে টাঙানো আছে। আর আছে তাঁর স্বপ্নময় কথাগুলোর স্মৃতি। তিনি সিটি করপোরেশন থেকে দুর্নীতি সাফ করতে চেয়েছিলেন। বলতেন, তিনি আসলে ঝাড়ুদার।

তাঁর অসুস্থতার খবর শোনার পর থেকেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, এত পরিশ্রম, এত মানুষকে ভালো রাখার দায়িত্ব বোধ হয় তার মস্তিষ্কে চাপ তৈরি করে ফেলেছিল।

আসলে তো রাজনীতিবিদ ছিলেন না। সৎ মানুষ, পরিকল্পনা আছে, সাহস আছে, আন্তরিক চেষ্টা আর পরিশ্রম আছে, কেন তিনি পারবেন না? এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। রাজনীতিবিদেরা সমালোচিত হলেও শান্তিতে ঘুমাতে পারেন, কিন্তু সামান্য সমালোচনাও তাঁর ঘুম নষ্ট করত, আমাদের বলতেন, এটা কেন হচ্ছে বলুন তো, আমি তো এই এই উদ্যোগ নিয়েছি।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে বললাম, স্যার, আনিস ভাই কিন্তু অভিমান করছেন। স্যার তাঁর কাছে গেলেন। তাঁকে বোঝালেন, ‘যে কাজ করে, তারই সমালোচনা হয়। যে কাজ করে না, তার সমালোচনা হয় না। তুমি এই সব কথায় মন খারাপ কোরো না।’

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার দুর্ঘটনায় পড়লেন। পায়ের হাড় ভেঙে গেল। আনিস ভাই ছুটে এলেন। জোর করে তাঁকে বিদেশে পাঠালেন। আমাদের সহকর্মী কবির বকুল অসুস্থ। মধ্যরাতে আনিস ভাই এলেন হাসপাতালে।

আমি বারবার করে বলব, তাঁর মতো হৃদয়বান সুন্দর মানুষ, ভালো মানুষ, কর্মোদ্যোগী মানুষ খুব কম আছে এই শহরে।

মেয়র এই শহরে আরও আসবেন, যাবেন, কিন্তু এত সুন্দর মানুষ আমরা কই পাব, যাকে যেকোনো সময় ফোন করে বলতে পারব, আনিস ভাই, এটা যে একটু করে দিতে হয়। কিংবা কিছু না বলে শুধু হাসব ফোনের দুই প্রান্তে দুই জন, কী ভাই, কী বুঝছেন...?

রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় ছিল। প্রিয় আনিস ভাই, রবীন্দ্রনাথের এই গানটা আমার মাথায় গুঞ্জরন তুলছে—আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে, ভোরের আলো মেঘের ফাঁকে।

আপনার ঢাকা শহরে ভোর হচ্ছে। ঢাকা শহরের মেঘ আলো রোদ্দুর আপনাকে ডাকছে। এই শহরের বিলীয়মান সবুজ, শাখায় শাখায় অন্তর্লীন পাখিরা আপনাকে ডাকছে। তারা কাকে খুঁজছে। তারা কাকে খুঁজছে!

আমার প্রাণের ভিতর সে কে থেকে থেকে

বিদায়প্রাতের উতলাকে পিছু ডাকে...

আনিস ভাই, বাংলাদেশের মানুষ আপনাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছিল। বাংলাদেশ আজ বিষণ্ন, আপনার ঢাকা শহর এখন আপনার জন্য কাঁদছে। কবি সৈয়দ শামসুল হক, আপনার নির্বাচনের নাগরিক কমিটির প্রধান, তিনিও তো নেই, তাঁর কবিতার ভাষায় বলতে হয়—

এখন আমার কাছে এ শহর ধূসর ধূসর বলে মনে হয়...

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।