আফগানরা চায় খাবার, যুক্তরাষ্ট্র কী চায়

নজিরবিহীন খাদ্যসংকটে পড়েছে আফগানিস্তান
ছবি: এএফপি

আফগানরা গত চার দশকে মরেছে গুলি, বোমা, বিমান হামলায়; এখন মরছে অনাহারে, ডাকাতিয়া শীতে। প্রকৃতির নির্মমতায় তাও পিঠ ঠেকিয়ে কোনোরকমে বাঁচার আশা থাকে, খাদ্যের অভাব অন্য কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়। খাদ্যের বিকল্প খাদ্যই। পেটে সইলে তবে না পিঠে সয়। অনাহারী আফগানরা তাই শীতের মারে আরও কাবু হয়ে পড়ছে। প্রকৃতির ওপর কারও হাত নেই, কিন্তু আফগানদের খাদ্যসংকটের দায় পশ্চিমারা এড়াতে পারে না।

একাধিক হিসাবমতে, আফগানিস্তানের অর্ধেক জনগোষ্ঠী খাদ্যের অভাবে মরতে বসেছে। অথচ দেশটির ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে সংরক্ষিত আফগানিস্তানের প্রায় সাত বিলিয়ন ডলারের অর্ধেক ৯/১১ হামলার শিকার পরিবারের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার ‘মহৎ’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন জো বাইডেন। অথচ চার কোটি আফগানের থালা শূন্য। জাতিসংঘ হিসাব কষে বলছে, দেশটির ৯৭ শতাংশ মানুষের জীবনমান শিগগিরই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। সাধু শব্দবন্ধ ‘দারিদ্র্যসীমা’–এর সাধারণ মানে হলো, সে অবস্থায় তাদের তিনবেলা খাবারও ঠিকঠাক জুটবে না। তালেবানের হাতে পরাজয়ের ক্ষতে দেওয়ার মতো ‘মলম’ আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নেই। তাই যন্ত্রণা ভুলতে তারা যেন সাধারণ আফগানদের ‘গিনিপিগ’ বানাতেও দ্বিতীয়বার ভাবছে না!

আরও পড়ুন

২.

আফগানিস্তানে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ভাষায় ‘ঈশ্বর নির্দেশিত’ সামরিক অভিযানের এমন ভরাডুবি কি যুক্তরাষ্ট্র ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পেরেছিল? সাড়ে চার দশক আগে ভিয়েতনাম থেকে লেজ গুটিয়ে পালানোর দুঃসহ স্মৃতি তাদের মন থেকে ফিঁকে হয়ে আসছিল হয়তো। এ অবস্থায় আফগানিস্তান থেকে অপমানজনক বিদায়ের বিষাদ, আগের শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতও খুঁচিয়ে কাঁচা করে ছেড়েছে। অবশ্য ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া আর তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের ‘ঐশ্বরিক দায়’—দুটি ভিন্ন বিষয় বলে পশ্চিমা বিজ্ঞাপনে উদ্ভাসিত (সৌজন্যে পশ্চিমা মিডিয়া)। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দুই ক্ষেত্রেই রণে ভঙ্গ দেওয়ার তাৎপর্য কিন্তু অভিন্ন। বিপদে বন্ধুকে বন্দুকের নলের সামনে ফেলে যাওয়া তাদের ‘মজ্জাগত’। এই তো আড়াই বছর আগে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দিদের তুর্কি বাহিনীর ‘খোরাক’ বানিয়ে সটান সটকে পড়েছিল তারা।

আরও পড়ুন

সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র আশরাফ গনির মন্তব্য যেন তারই প্রতিধ্বনি। গত ১৫ আগস্ট তালেবানের কাবুল দখলের আগে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পাওয়ার গনির অকপট স্বীকারোক্তি, যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সহযোগী দেশগুলোকে বিশ্বাস করাই ছিল তাঁর একমাত্র ভুল (বিবিসি বাংলা, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১)।

তাই সায়গন থেকে মার্কিনিদের পড়িমরি ছুট দেওয়ার দৃশ্যের কাবুলে হুবহু পুনর্মঞ্চায়ন, যাকে ইতিহাসের নির্মম পুনরাবৃত্তি বললে বেশি দোষের হয় না।

সন্ত্রস্ত্র সাধারণ আফগানদের যুক্তরাষ্ট্রের বিমানে ওঠার মরিয়া চেষ্টার উত্তরও আরেক দফায় খোলাসা হয় দুনিয়ার সামনে। দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র যে ‘শান্তির বীজ’ আফগানিস্তানের মাটিতে পুঁতে পরিচর্যা করেছে, তা এতটুকু মাথা তো তোলেইনি বরং তালেবানই মহিরুহ হয়ে উঠেছে, দিনে দিনে। সেই বিষবৃক্ষের তলায় সাধারণ আফগানদের জন্য কোনো ছায়া নেই; তার ফল ভক্ষণে বাঁচার আশা নেই। বিশ্ববাসীর সামনে ক্রমে তা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে, সপারিষদ যুক্তরাষ্ট্রই কেবল তা না দেখার ভান করছে।

৩.

আফগানিস্তানে চরমতম ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশে ভিন্ন ভিন্ন সূত্র ব্যবহারে পৃথক চিত্র হয়তো তুলে ধরা যায়, (যেমনটা জো বাইডেন তুলেও ধরেছেন) কিন্তু মিত্রের প্রতি অবিশ্বস্ততার যে বিশালকার ‘স্ট্যাচু’ কাবুলে দাঁড় করিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র, তা বিশ্বের সব কোণ থেকেই দৃশ্যমান। ‘ইউনাইটেড স্টেটস : দ্য কান্ট্রি হয়্যার/লিবার্টি ইজ আ স্ট্যাচু’—কবি নিকানোর পাররার লেখা কথাটিকে একটু ঘুরিয়ে কি বলা যায়—যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতাও আদপে ‘স্ট্যাচু’; তাতে হার্দিক স্পন্দন নেই!

৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার পর আফগানিস্তানে মিত্র ন্যাটোকে নিয়ে সর্বাত্মক সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ হিসেবে জর্জ বুশের জবানিতে উচ্চারিত হয়েছিল ‘ঈশ্বেরর নির্দেশের’ কথা। সেই মতো আল-কায়েদাসহ যত কিসিমের ইসলামি চরমপন্থী, মৌলবাদী শক্তি আছে, তা ঝাড়ে-বংশে বিনাশ করা ছিল তাদের প্রথম মনোযোগ। দ্বিতীয়ত, দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, যা বৃহত্তরভাবে বিশ্বশান্তিরও অংশ। দুটি বিষয়েই তাদের ‘অর্জন’ এখন প্রকাশ্যে, কেউ কেউ যার সরল তর্জমা করছেন এভাবে—বিশ্বের বুকে সুদীর্ঘকাল ধরে এককভাবে ছড়ি ঘোরানোর দিন ঢলে পড়ছে পশ্চিমাদের। জোর করে ব্যক্তিবিশেষকে বন্দী রাখা যায়, গোটা জাতির চেতনা নিয়ে জবরদস্তি চলে না, এই উপলব্ধি একটুখানি হলেও হয়েছে তাদের। জো বাইডেনের মুখ থেকে তাই বুঝি শোনা গেছে, আফগানিস্তানে ‘জাতি গঠন’ তাদের কাজ নয়।

আফগানিস্তানে যুগপৎ সামরিক ও রাজনৈতিক পরাজয় যুক্তরাষ্ট্রের অভিভাবকত্ব, কর্তৃত্ব-নেতৃত্বকে যতটা মাটিতে মিশিয়েছে, তালেবানও ঠিক ততটাই শক্ত পায়ে মাটিতে দাঁড়ানোর মওকা পেয়েছে। দুঃস্বপ্ন হলেও যুক্তরাষ্ট্রকে মানতেই হচ্ছে, তালেবান কত দিন রাজ করবে, তার কোনো ‘অনুমিত হিসাব’ও এই মুহূর্তে তাদের টেবিলে নেই।

তাই শুধু পরাজয় নয়, অপমানও হজম করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। ‘বোনাস’ হিসেবে তারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে ততটাই, যতটা একজন মিত্রের ভরসা নষ্টের জন্য যথেষ্ট। একে কি মুখে চুনকালি-মাখার সঙ্গে তুলনা করা চলে—যে তালেবানকে একদা উৎখাত করেছিল, সেই তালেবানের সঙ্গে এখন ‘সন্ত্রাসী’ মারতে চায় যুক্তরাষ্ট্র!

৪.

২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও তার দোসরদের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৯ লাখ মানুষ। এ জন্য খরচ করেছে তারা ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট আরও বলছে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে চালানো ড্রোন ও বিমান হামলায় ব্যক্তিদের প্রায় চার লাখই সাধারণ মানুষ। হুদাই মরে যাওয়া এসব মানুষের হাতে না ছিল অস্ত্র, না মনে ছিল ‘সন্ত্রাসবাদ’।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা এয়ারওয়ার্সের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, সোমালিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন আর পাকিস্তানে প্রায় এক লাখ বিমান ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে পেন্টাগন। গত বছরের ৩০ আগস্ট কাবুলে একই পরিবারের ৬ শিশুসহ ৯ জন নিরপরাধ ব্যক্তিকে বোমা ফেলে হত্যা করে ‘সন্ত্রাসীর পিছু নেওয়া’ড্রোন। পরে অবশ্য ‘ভুল’ হয়েছে বলে ধুলা ঝাড়ার মতো দায়ও ঝেড়ে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র।

আফগান সরকারকে বাদ দিয়ে তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে এটা পরিষ্কার হয়, একটা দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষকে (মার্কিন সুতায় বাঁধা পুতুল সরকার পড়া যাবে) বাদ দিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তালেবানের সঙ্গে করা চুক্তি আফগানিস্তানে আজকের বিপর্যয়কেই ‘ডাক’ পাঠিয়েছিল। বাইডেন সেই চুক্তিকে মান্যতা দিয়ে ডাকটাকে বুলন্দ করেছেন। তাই মানবাধিকার, বিশেষ করে নারী অধিকার ধুলায় লুণ্ঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্বশীল সরকার না হওয়া, বরং উল্টো ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হওয়া ইত্যাদি নিয়ে যতই গেল গেল রব তোলা হোক, এক মিনিট নীরব থেকে ভাবলে উত্তর পাওয়া যায়—এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা ছিল না।

তালেবান শাসনের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদকালের কথা বিশ্বনেতাদের মনে না থাকার কারণ নেই। তার আগে রাশিয়ার দেড় দশকের আগ্রাসনে কাহিল হয়েছিল পড়েছিল আফগানিস্তান। এর আমেরিকার দুই দশকে দেশটিকে ঝাঁঝরা করে ছেড়েছে। এমন একটি দেশে সহায়তার অর্থের জোগান যত দীর্ঘ বন্ধ রাখা হবে, সাধারণ মানুষের দুর্দশা তত বাড়বে। তালেবানকে চাপে ফেলতে আফগান জনগোষ্ঠীকে ‘ভাতে মারার’ বন্দোবস্ত তালেবানকেই বরং আরও ‘লাইফ’ দেবে; তাদের রাজত্ব আরও পোক্ত করবে।

৫.

চলমান ইউক্রেন সংকট ঘিরে রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে জো বাইডেন কাঠখড় পোড়াতে কোনো কার্পণ্য করছেন না। সুতরাং মুরব্বির পিছু পিছু পশ্চিমা মিডিয়ারও চোখ এখন সেদিকে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম যা দেখে না, বাদ বাকি দুনিয়াও তা দেখে না।

এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভাবমূর্তি’ থেকে আফগান যুদ্ধে পরাজয়ের কালিঝুলির অনেকটাই ঝাড়পোছ করে নেওয়া যাবে। পশ্চিমাদের দিন ঢলে পড়েনি, তা প্রমাণের এ এক দারুণ মওকা যুক্তরাষ্ট্রের সামনে। কিন্তু তাই বলে কাবুলে স্থাপিত তাদের ‘অবিশ্বস্ততার মূর্তি’ এখনই ধসে পড়ছে না। যুদ্ধ-যুদ্ধ ডামাডোল কমতেই এটি আবার সবার সামনে স্পষ্ট ফুটে উঠবে। তখন কীভাবে তা আড়াল করবে যুক্তরাষ্ট্র? তত দিনে অবশ্য খাদ্যের অভাবে আফগানদের ‘গণমৃত্যুর রেকর্ড’ও হয়ে যেতে পারে। তাহলে তো কিস্তিমাত!

হাসান ইমাম সাংবাদিক
[email protected]