আফগানিস্তানে আমেরিকার এখন যা করা উচিত

আফগানিস্তানের অর্ধেক জনগোষ্ঠী এখন খাদ্যের অভাবে মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধে হেরে গেলেও, তারা সেখানে শান্তি উদ্ধারে ভূমিকা পালন করতে পারে। আফগানিস্তান যাতে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত না হয়, সে জন্য দেশটির ওপর যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে, সেটা প্রত্যাহার করতে হবে। এর পরিবর্তে দেশটির ধসে পড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে জোরেশোরে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই একটা পথরেখা তৈরি করতে হবে, যাতে তালেবানশাসিত সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার পথ খোলে। যুক্তরাষ্ট্র চাক কিংবা না চাক, আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ অনেক দিন পর্যন্ত তালেবানের হাতেই থাকছে।

গত গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়। তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর বাইরের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন সেখানকার দুর্দশা আরও বেড়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক মনোযোগ সে মাত্রায় পাচ্ছে না। বিগত আফগান সরকারকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা দেশটির বাজেটের ৭৫ শতাংশ জোগান দিত। দেশটির বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৪০ শতাংশ আসত বৈদেশিক সাহায্য থেকে। এ সহযোগিতা তুলে নেওয়ায় সেখানে শোচনীয় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দেশটির অর্ধেক জনগোষ্ঠী (প্রায় চার কোটি) এখন খাদ্যের অভাবে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে আফগানিস্তানের ৯৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জীবনমান শিগগিরই আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচে (প্রতিদিন ১ দশমিক ৯০ ডলার) নেমে যাবে।

তালেবানকে এমন একটা সরকার গঠন করতে হবে, যেখানে নারী, বিভিন্ন গোত্র ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব যেন থাকে। গত দুই দশকে আফগানিস্তান পাল্টে গেছে, রাজনৈতিকভাবে সফল হতে হলে তালেবানকে নতুন সামাজিক বাস্তবতা রপ্ত করে নিতে হবে। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে, এমন একটা দেশে সামাজিক স্থিতিশীলতা কেবল অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব।

আফগানিস্তানের এ বিপর্যয় সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভালোভাবেই সচেতন। সেখানে যাতে মানবিক কার্যক্রম বাড়ানো যায়, সে জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তহবিল বাড়ানোর চেষ্টা করছে। জাতিসংঘ আফগানিস্তানের মানবিক সহায়তার জন্য ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার জোগাড়ের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এটা একক কোনো দেশের জন্য সবচেয়ে বড় প্যাকেজ। কিন্তু আফগানিস্তান পুনরুদ্ধারে এ অঙ্কটা যথেষ্ট না-ও হতে পারে। দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনায় এ মানবিক সহযোগিতা শুধু প্রলেপ মাত্র, উপশম নয়।

তালেবানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, তাদের স্বীকৃতি না দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের আন্তর্জাতিক সহযোগীরা সঠিক কাজটাই করেছিল। আফগানিস্তানের স্থগিত ১০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ খুলে দেওয়াই এখন একমাত্র সমাধান। এ তহবিল বিতরণের জন্য জাতিসংঘের উচিত কাবুলে একটি তদারকি সংস্থা করা, যাতে অর্থনৈতিক তারল্য নিশ্চিত করা যায় এবং সরকারি মন্ত্রণালয় ও জরুরি নাগরিক সেবার সঙ্গে জড়িত কর্মীদের বেতন-ভাতা শোধ করা যায়। এ তহবিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ, অন্য অরাজনৈতিক সরকারি চাকরিজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক ও আফগানিস্তানের জরুরি নাগরিক সেবার সঙ্গে যুক্ত অন্য কর্মীদের মাধ্যমে ব্যয় করতে হবে। তালেবান নেতাদের হাতে যেন সেই টাকা না যায়, সেটা জাতিসংঘের তদারকি সংস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে।

এ ধরনের ব্যবস্থা করে ওঠা খুব কঠিন, তবে অন্য জায়গায় এর নজিরও আছে। হুতি নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনের কিছু অংশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় খুব সফলতার সঙ্গে এ রকম তহবিল জনগণের কাজে ব্যবহার করছে। উল্লেখ্য, ইয়েমেনে বিদ্রোহীরাই দৃশ্যত দেশটি শাসন করে। গাজা উপত্যকায় একইভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে হামাস। ইসলামি এ সংগঠন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে পরিচিত। জাতিসংঘ হামাসকে ছাড়াই সেখানকার অধিবাসীদের সরাসরি খাদ্যসহায়তা দেওয়া, বিদ্যালয় ও হাসপাতাল পরিচালনা এবং অবকাঠামো নির্মাণে তহবিল ব্যয় করছে।

আফগান বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রতিনিধি করে তোলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবানকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে পারে। যদিও তালেবান বিদেশিদের এ প্রচেষ্টায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। কেননা, আফগানিস্তান যত ব্যর্থ রাষ্ট্র হবে, শাসন করার জন্য তালেবানের জন্য ততই সুবিধা হবে।

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যে ইচ্ছা প্রকাশ করছে, সেটা তালেবানের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মৌন সম্মতি জোগাবে। জাতিসংঘের মাধ্যমে জব্দ করে রাখা তহবিল বণ্টন করাই হতে পারে আফগানিস্তানকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর অস্থায়ী পদক্ষেপ। তালেবানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা কীভাবে ওঠানো যাবে, তা নিয়ে স্পষ্ট মানদণ্ড তৈরি করতে হবে।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একঘরে অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে একটা স্বাভাবিক কূটনৈতিক পরিস্থিতিতে পৌঁছাতে তালেবানকে তিনটি বিষয় অর্জন করতে হবে। প্রথমত, আল-কায়েদা, আইএসসহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিরাপদ স্বর্গভূমি হিসেবে আফগানিস্তানকে যেন ব্যবহার করতে না পারে। তালেবান এরই মধ্যে আইএসের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে, কিন্তু তারা আল-কায়েদার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্ক রেখে চলেছে। তাদের এ সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এসব গোষ্ঠীর তথ্য সরবরাহ করতে তারা যে ইচ্ছুক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সেই বার্তা দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মানবাধিকার বিবেচনায় সব ধরনের আন্তর্জাতিক রীতি তালেবানের মেনে চলতে হবে। আফগানিস্তান যাঁরা ছাড়তে চান, তাঁদের সেই অনুমতি দিতে হবে এবং মেয়েদের বিদ্যালয় ও কলেজ আবার খুলে দিতে হবে। আগের শাসনামলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের সংস্থাগুলোকে হেনস্তা বন্ধ করতে হবে।

তৃতীয়ত, তালেবানকে এমন একটা সরকার গঠন করতে হবে, যেখানে নারী, বিভিন্ন গোত্র ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব যেন থাকে। গত দুই দশকে আফগানিস্তান পাল্টে গেছে, রাজনৈতিকভাবে সফল হতে হলে তালেবানকে নতুন সামাজিক বাস্তবতা রপ্ত করে নিতে হবে। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে, এমন একটা দেশে সামাজিক স্থিতিশীলতা কেবল অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব।

  • চার্লস এ কাপচান মার্কিন কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র ফেলো

  • ডগলাস লুট মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল