আমরা যেমন, তেমন নেতাই পাই

চরিত্রটিকে মনে পড়ে? খেপে গেলেও বুক থাবড়ায়, ডর দেখাতেও থাবা মারে বুকে। তার ভাষায় একটাই শব্দ ‘আমি’। জি, ঠিক ধরেছেন। আমি গরিলা রাজা কিং কংয়ের কথাই বলছি। বুক থাবড়ে সে বলে নিজের মুক্তির কথা। বিপুল তার শক্তি, আঙুল দিয়ে বিমান ফেলে দেয়, ঘুষি মেরে ভাঙে বিশাল ভবন। গরিলা রাজত্বে তিনিই রাজা, অনুগতদের দেন আস্থা আর শত্রুকে দেন শাস্তি। কিন্তু মানুষের সমাজে ভয় ছাড়া কিং কংয়ের দেওয়ার কিছু নেই। তারপরও শাসকের মধ্যে আমরা কিং কংয়ের আদল খুঁজি। আমরা চাই, তিনি তাঁর অতিকায় ভাবমূর্তি আর কঠোর শাসন দিয়ে মানুষকে বশে রাখবেন।
ইতালীয় রাজনৈতিক দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি তাঁর দ্য প্রিন্স বইটায় দুর্দান্ত শাসকের জন্য কিছু পরামর্শ রেখেছিলেন। শাসক তাঁর জনগণের কাছে কী বেশি চাইতে পারেন, ভালোবাসা নাকি ভয়মিশ্রিত সমীহ? ম্যাকিয়াভেলি বলছেন, ভালোবাসার চেয়ে ভয় বেশি নিরাপদ। ভালোবাসার মধ্যে যে দায় থাকে, স্বভাবসুলভভাবে আপন সুবিধার খাতিরে মানুষ তা এড়ায়। কিন্তু ভয় শাস্তির আতঙ্ক জাগিয়ে আপনাকে ঠিক রাখবে। এই আতঙ্ক অব্যর্থ।
আতঙ্কের শাসন বিপুল সমারোহে ফিরে আসছে দুনিয়ায়। ট্রাম্পের কথা ভাবুন, পুতিনের কথা ভাবুন, ভাবুন মোদি, নেতানিয়াহু কিংবা এরদোয়ানের কথা। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রতিপক্ষকে দুরমুশ করতে চান, জনগণকে উত্তেজিত করে তোলেন জাতীয় ‘শত্রু’র বিরুদ্ধে। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ দেশে দারুণ জনপ্রিয়। কেউ কম কথা বলেন, কেউবা বেশি।
কিন্তু তাঁরা বুঝিয়ে দেন, ‘আমিই তো সব করছি, আমিই তো করব, আমি না থাকলে কে তোমাদের বাঁচাবে!’ তাঁদের উত্থানের ঘটনাকে এখন বলা হচ্ছে জনতুষ্টিবাদ বা পপুলিজম। পপুলিস্ট শাসন অতি কড়া হলে তাকে বলা হয় ফ্যাসিবাদ। তার আগে তা দেখা দেয় কর্তৃত্ববাদের চেহারায়। দেশে দেশে এখন কর্তৃত্ববাদেরই জয়ভেরী বাজছে। বিরাট নেতা আর খুদে জনগণ হলো পপুলিজমের লক্ষণ। কখনো তাঁরা হন নির্বাচিত, কখনোবা নির্বাচন ছাড়াই তাঁরা পেয়ে যান উচ্চ ক্ষমতার সিঁড়ি।
কর্তৃত্ববাদের মুখোশটা পাতলা। অল্প সময়েই তা আপন চেহারাটা দেখিয়ে ফেলে। কিন্তু যাঁরা এ ধরনের কর্তৃত্ববাদের ভক্ত, সেই আমজনতা, সেই জনগণ নামক বিমূর্ত লোকসমষ্টি আসলে কারা? ব্রিটেনে ব্রেক্সিট হওয়ার আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোয় একটা জরিপ হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ব্রিটেনের প্রায় অর্ধেক ভোটারই কর্তৃত্ববাদের পক্ষে। ডেনমার্কে তাঁদের হার ৪৭ শতাংশ, নেদারল্যান্ডসে ৫৫, ফ্রান্সে ৬৩, পোল্যান্ডে ৭৮ এবং রুমানিয়ায় সবচেয়ে বেশি ৮২ শতাংশ।
সুইজারল্যান্ডের মতো ধনী ও জ্ঞানভিত্তিক দেশ আছে পঞ্চম অবস্থানে। সবচেয়ে কম লিথুয়ানিয়া ও জার্মানিতে, যথাক্রমে শূন্য ও ১৮ শতাংশ। গতিটা অসহিষ্ণুতা বাড়ার দিকে, কমার দিকে না। এই জরিপকে অকাট্য প্রমাণ করে এরপরে ব্রেক্সিট হলো, ফ্রান্সের আসন্ন নির্বাচনেও উগ্র জাতীয়তাবাদীরাই জয়ী হবে বলে জানাচ্ছে সব জরিপ। সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ইতালি, হাঙ্গেরির মতো দেশে তারাই প্রধান বিরোধী দল। অচিরেই আমরা এসব দেশে নতুন নতুন ডোনাল্ড ট্রাম্প দেখতে যাচ্ছি।
ভারতে ডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এখন ক্ষমতায়। এই মার্চ মাসের রাজ্যসভা নির্বাচনে তারাই ছিল এগিয়ে। নেহরুর সময়ের কংগ্রেস যত রাজ্য শাসন করত, বিজেপি এখন প্রায় সেখানেই। উত্তর প্রদেশে একজন সাম্প্রদায়িক ধর্মগুরু যোগী আদিত্যনাথ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

>আমরা যখন প্রকৃত স্বাধীনতা সহ্য করতে পারি না, তখনই আমরা অধীন হওয়ার পথে যাই। আমাদের বাসনা থেকেই জন্ম নেয় দুঃশাসনের। আমরা যেমন, তেমন নেতাই পাই

ওদিকে ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর মতো আগ্রাসী ব্যক্তি হুমকি দিচ্ছেন, মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে পুনরায় বিজয়ী হয়ে তিনি সব সমালোচনার জবাব দেবেন, দরকার হলে শেষ পর্যন্ত যাবেন। ডান পন্থার এই বিপদ, তারা সবকিছুর শেষ দেখতে চায়। এই শেষ দেখার প্রত্যয়ে তুরস্কে নতুন গণভোট হতে যাচ্ছে, যাতে করে এরদোয়ান আরও ক্ষমতাশালী হতে পারেন। বাংলাদেশে যেহেতু জরিপের বালাই নেই, তাই বলা যাচ্ছে না আমরা কোন ধাপে আছি।
প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য দুখানেই এই ডান পন্থার প্রধান শত্রু হলো ‘অপর’, যারা নাকি স্বধর্ম, স্বজাতি, স্ববর্ণের ও রঙের লোক নয়। ব্রেক্সিট হওয়ার একটা কারণ ছিল শরণার্থীভীতি, যারা প্রধানত আরব মুসলিম। কমেডিয়ান ডোনাল্ড ট্রাম্প খুব হাসতেন ও হাসাতেন। কিন্তু কিং কং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুখ কঠোর, থমথমে। তিনিও মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের খেপিয়ে তুলছেন। তবে, বাড়তি একটা জুজু তিনি পেয়ে গেছেন: মেক্সিকান।
ফরাসি উগ্র জাতীয়তাবাদী লো পেনের জনপ্রিয়তার জ্বালানিও ওই মুসলিম শরণার্থীবিদ্বেষ। ভারতেও মোটামুটি তা-ই, সেখানে শুরু হয়েছে মুসলিমবিদ্বেষী মাংস নিরোধ অভিযান। রাজ্যে রাজ্যে মুসলিমবিরোধী কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। তাঁরা সবাই খাঁটি জাতি বানাতে চান। সেই জাতি হবে বহিরাগতমুক্ত, মুসলিমমুক্ত। একেবারে ব্র্যান্ড নিউ ন্যাশন তাঁদের স্বপ্ন। তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহযোগী হচ্ছে আইএসের মতো মুসলিম সন্ত্রাসবাদ।
এসব জাতীয়তাবাদী নেতা বিশ্বায়ন মানেন না, তাঁদের মানবাধিকার কেবল নিজেদের লোকের জন্য প্রযোজ্য। তাঁরা অভিবাসী ঠেকাতে রাষ্ট্রের সীমান্তে দেয়াল আর সমাজ, ধর্ম বা জাতির গায়ে কাঁটাতার তুলে রাখা জরুরি মনে করেন। গণতন্ত্র তাঁরা ততদূর মানেন, যতদূর পর্যন্ত সেটা তাঁদের বিজয়ী করে। একবার বিজয়ী হয়েই তাঁরা মুখোশটা খুলে ফেলেন। তাঁরা আবার পরস্পরের বন্ধুও।
মোদি ট্রাম্পের ভক্ত, ট্রাম্প ভক্ত পুতিনের, পুতিন বন্ধু এরদোয়ানের; আর ফ্রান্সের হবু রাষ্ট্রপ্রধান লো পেনও তা–ই। তাঁদের অনুসারীরাও তা–ই। ইহুদিবাদী আর হিন্দুত্ববাদীর সখ্য নতুন নয়। সৌদি মৌলবাদ আর ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদের তো হাতে হাত। সৌদি যুবরাজ ট্রাম্পকে দারুণ তোয়াজ করলেন কদিন আগে।
ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? কর্তৃত্ববাদ বলি, জনতুষ্টিবাদ বলি, ডান পন্থা বলি, এরা মোটামুটি সবাই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রের কবর রচনা করছে। নির্বাচন ও গণতন্ত্রের মধ্যে যখন এমন দা-কুড়াল সম্পর্ক, তখন বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্রের ত্রুটি নিয়ে কথা–চালাচালি হচ্ছে। বেশির ভাগ কিং কং নেতা জয়ী হয়েছেন অর্ধেকের চেয়েও কম ভোটে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের চেয়েও কম ভোটে।
গণতন্ত্রকে বলা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, কিন্তু দেখা যাচ্ছে সংখ্যায় কম ভোটেই তাঁরা বাজিমাত করতে পারছেন। ভারতে মোদি মাত্র ৩১ শতাংশ ভোটারের পছন্দে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির ধনিকশ্রেণির গণতন্ত্র কর্তৃত্ববাদ ঠেকাতে অক্ষম। তারপরও গণতন্ত্রের অভাব মেটাতে পারে আরও বেশি এবং আরও সহি গণতন্ত্র।
ইতিহাস সাক্ষী, যখনই কর্তৃত্ববাদ, ফ্যাসিবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হয়; গরিব-মেহনতি মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। বৃহৎ পুঁজিপতি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লাগামছাড়া হয়।
প্রতিপক্ষের শেষ দেখতে চেয়ে এরা নতুন নতুন যুদ্ধে নিজ ও অন্য জাতির গরিবদের নিকেশ করে। আর নিজ দেশে তারা দাবি করে সীমাহীন আনুগত্য। সেই দাবি মেটাতে জনগণকে দীর্ঘ সংগ্রামে পাওয়া অনেক মৌলিক অধিকার হারিয়ে রাজনৈতিকভাবে লিলিপুট হয়ে যেতে হয়।
লিলিপুট আমরাও হচ্ছি। কোনো জরিপ হলে বাংলাদেশে এখন ঘৃণাই এগিয়ে থাকবে। আমরা কি ঘৃণা করি না অন্য সম্প্রদায়, জাতি, ধর্ম এবং অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে? চোখের বদলে চোখ নিতে গিয়ে অন্ধত্বকেই অনিবার্য করে তুলছি না আমরা?
জঙ্গিবাদ, বন্দুকযুদ্ধ এবং খারিজিপনায় কি দুর্বল হচ্ছে না দেশ? প্রতিপক্ষের শেষ দেখার ইচ্ছা কি নেই আমাদের কোনো কোনো নেতা–নেত্রীর? যারা আমাদের মতো নয়, তাদের মানবাধিকার কি আমরা স্বীকার করি? আমরাই কি চাইনি মহান একনায়কতন্ত্রকে?
এক ড্রাগনভক্ত দিনমান ড্রাগন দেবতাকে ডাকে। তো ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে ড্রাগনদেব একদিন দেখা দিলেন। সে কী বিকট মূর্তি, সে কী লেলিহান শিখা তার জিবে! তা দেখে ভক্ত ভয়ে দৌড়ে পালাল। আমাদের অন্ধভক্তিই জন্ম দেয় ভয়ের। তখন সেই ভয়ের আসরে পড়ে আমরা স্বাধীনতা চাই না, অধিকার চাই না; আমরা চেয়ে বসি এমন কাউকে, যে আমাদের বশ করবে।
মনোবিজ্ঞানী এরিক ফ্রম ফ্যাসিবাদী নেতা ও তাঁর অনুসারীদের ওপর গবেষণা করে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, ‘নিজের ওপর ভরসার অভাবে, স্বাধীনতার যোগ্য না হওয়ায়’ আমরা পরাক্রমশালী নেতার দ্বারা চালিত হতে চাই। আমরা যখন প্রকৃত স্বাধীনতা সহ্য করতে পারি না, তখনই আমরা অধীন হওয়ার পথে যাই। আমাদের বাসনা থেকেই জন্ম নেয় দুঃশাসনের। আমরা যেমন, তেমন নেতাই পাই।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
faruk.wasif@prothom-alo.info