আমেরিকা ও চীনের অসুখী সম্পর্ক কীভাবে জোড়া লাগবে

১৯৭২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি চীন সফরে এলে রিচার্ড নিক্সনকে শুভেচ্ছা জানান মাও সে–তুং
এএফপি

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের আধুনিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী চলছে এ মাসে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকে বহনকারী বিমান বেইজিং বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁরা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে–তুংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁদের এ সফর ভূরাজনৈতিক ভূমিকম্প বলে পরিচিতি পায়। নিক্সন এ সফরকে বলেছিলেন ‘দুনিয়াকে বদলে দেওয়া এক সপ্তাহ’।

এ ঐতিহাসিক পুনর্মিলন গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ও আমেরিকার মধ্যকার আগের দুই দশকের শত্রুতার অবসান ঘটিয়েছিল। এর আগে বেশির ভাগ আমেরিকানের কাছে চীন লাল অথবা কমিউনিস্ট চীন হিসেবে পরিচিত ছিল। এ শত্রুতার মূল পোঁতা হয়েছিল চীনের গৃহযুদ্ধকালে। সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্টবিরোধী জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন দিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে যুদ্ধে হেরে গিয়ে তারা ফরমোজা (তাইওয়ান) পালিয়ে যায়। পরবর্তী বছরগুলোতে কোরীয় যুদ্ধে চীন ও আমেরিকার সৈন্যরা একে অপরকে হত্যা করে।

১৯৬০-এর দশকে চীন ও সোভিয়েত উত্তেজনা সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটা কূটনৈতিক দরজা খুলে যায়। নিক্সন ও কিসিঞ্জার এবং মাও সে–তুং ও চৌ এন লাই এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাদের সাধারণ প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা শুরু করে। ১৯৬৯ সালে সীমান্তে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর চীন তাদের একসময়কার বন্ধু সোভিয়েতের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার আকুতি জানায়। চীনের সঙ্গে এ আঁতাত সোভিয়েতের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা দিয়েছিল। একই সঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধও দ্রুত শেষ হয়েছিল। এ ঘটনা ছিল ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ এ প্রবাদ বাক্যের ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত।

স্বার্থের এ ঐক্য সত্ত্বেও দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাঁকবদল খুব সহজ ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে ও চীন সরকার তাদের অনেক মতপার্থক্য মিটিয়ে ফেলার বদলে সেগুলো মানিয়ে নিতে সম্মত হয়েছিল। নিক্সনের সফর শেষে খুব সতর্কতার সঙ্গে দুই দেশ একটা যৌথ বিবৃতি ঘোষণা করেছিল। সেখানে দুই দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও বিদেশনীতির পার্থক্যগুলো স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে তাইওয়ান ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়। চীন নিজেদের অবস্থান বিবৃত করে বলেছিল, মূল ভূখণ্ডের কমিউনিস্ট সরকার একমাত্র বৈধ সরকার এবং তাইওয়ান চীনের একটা প্রদেশ। অন্যদিকে এ বিতর্কের শান্তিপূর্ণ সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র মুখে চীনের অবস্থান স্বীকার করে নিলেও বাস্তবে সেটা সমর্থন করে না।

২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের প্রবেশের পর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আরও গতি পায়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের অন্তর্ভুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়েছিল। কেননা তারা মনে করেছিল এতে করে আরও বাজারনির্ভর উদার চীনের জন্ম হবে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদি একটা বাজি ধরেছিল এবং কিছুদিনের জন্য মনেও হয়েছিল সেটা সম্ভব। কিন্তু গত এক দশকে সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীনের অর্থনীতিতে চীন সরকারের ভূমিকা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যও একতরফাভাবে বেড়েছে। এখন দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি শত বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে।

শীতল যুদ্ধের সমাপ্তি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের আগপর্যন্ত পরবর্তী দুই দশক চীন ও আমেরিকার সম্পর্ক আঠার মতো এঁটে ছিল সোভিয়েতের প্রতি দুই দেশের যে শত্রুতার সূত্র ধরে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও চীন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দর–কষাকষির মধ্য দিয়ে নতুন যৌক্তিক সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করে। দুই দেশই একে অপরের বাজারে প্রবেশের চেষ্টা শুরু করে। ১৯৯০ সালে যেখানে দুই দেশের বাণিজ্য ছিল ২০ বিলিয়ন ডলারের, এক দশকের ব্যবধানে সেটা বেড়ে ১২০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছায়।

২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের প্রবেশের পর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আরও গতি পায়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের অন্তর্ভুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়েছিল। কেননা তারা মনে করেছিল এতে করে আরও বাজারনির্ভর উদার চীনের জন্ম হবে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদি একটা বাজি ধরেছিল এবং কিছুদিনের জন্য মনেও হয়েছিল সেটা সম্ভব। কিন্তু গত এক দশকে সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীনের অর্থনীতিতে চীন সরকারের ভূমিকা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যও একতরফাভাবে বেড়েছে। এখন দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি শত বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে।

একইভাবে রাজনৈতিকভাবে চীন উদারীকরণের পথে যাবে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন আশা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। সি চিনের নেতৃত্বে চীন মাও জমানার চেয়েও বেশি নিপীড়নমূলক হয়ে উঠেছে। চীনের কেন্দ্রীয় সরকার হংকংয়ের গণতন্ত্র গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, ইন্টারনেট কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। ১০ লাখ উইঘুরকে জোর করে প্রশিক্ষণশিবিরে পাঠিয়েছে, যাতে করে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় মুছে দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া চীন বহির্বিশ্বে নিজেদের শক্তির প্রদর্শন বাড়িয়েছে। তারা দক্ষিণ চীন সাগরকে সামরিক ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। ভারতের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করেছে। তাইওয়ান ও জাপানকে হুমকি দেওয়ার জন্য বারবার করে সমরসজ্জা করছে। এর ফলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন একটা শীতল যুদ্ধ পরিস্থিতির শুরু হয়েছে।

অর্ধশতাব্দী আগে, চীন-সোভিয়েত বিভাজনে সাড়া দিয়েছিল এমন একটা বিদেশনীতি নিয়ে যেটা ছিল সৃজনশীল এবং বাস্তবায়নযোগ্য। নিক্সনের কূটনৈতিক অভ্যুত্থান এটা নিশ্চিত করেছিল যে শীতল যুদ্ধ শীতলই হতে হবে এবং সেটা পশ্চিমাদের পক্ষে যেতে হবে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন শ্যাম্পেন দিয়ে নয়, বরং সম্পর্ক পুনর্জাগরণের একটা বুদ্ধিদীপ্ত পথ খুঁজে বের করার মাধ্যমে করতে হবে। দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার যে পার্থক্য, সেটা স্বীকার করেই সেই পথ খুঁজতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • রিচার্ড হাস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট