ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে কৌশলগত পরাজয়ের মুখে যুক্তরাষ্ট্র

পূর্ব ইউক্রেনীয় অঞ্চলের দনবাসের স্লোভিয়ানস্ক শহরে রুশ হামলায় বিধ্বস্ত হওয়া একটি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং থেকে বের হচ্ছেন এক নারী। এই যুদ্ধে তাঁর মাথা গোঁজার ঠাইঁটুকুও এখন আর নেই। ৩১ মের ছবি।
ছবি: এএফপি

এক শ দিন পার হয়ে গেল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের। এর প্রভাবে সারা বিশ্বেই জ্বালানি থেকে ভোজ্যতেল—সবকিছুরই দাম ঊর্ধ্বমুখী। ইউক্রেনের ৬৯ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। রাশিয়া হুমকি দিয়েছিল, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই কিয়েভ দখল করে তাঁবেদার সরকার গঠন করবে। কিন্তু রাশিয়া কিয়েভ দখল করতে পারেনি। পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে রাশিয়া কিয়েভ দখলের পরিকল্পনা থেকে পিছু হটেছে। কিন্তু সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে, রাশিয়া কিয়েভ দখল করতে পারেনি না বলে বলা উচিত কিয়েভ দখল করেনি। আদৌ কিয়েভ দখলের পরিকল্পনা ছিল মনে হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার ফাঁদে পা দিয়েছে পশ্চিমারা।

ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে নানা ধরনের তথ্য পাই আমরা। একদিকে পশ্চিমারা দাবি করছে, এই যুদ্ধে রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা স্ট্রিংগার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার আর্টিলারি ও বিমানবাহিনীর প্রভূত ক্ষতি সাধন করে রীতিমতো পঙ্গু করে দিয়েছে ইউক্রেনীয়রা। রাশিয়ার হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়েছেন। নিহতের তালিকায় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় জেনারেলও আছেন। কিন্তু ভাবনার বিষয়, এত ক্ষয়ক্ষতি ও প্রতিরোধের মুখেও রাশিয়ার বাহিনী ইউক্রেনের ২০ শতাংশ এলাকা দখলে নিয়েছে। লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, মারিউপোল হয়ে খেরসন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রাশিয়ার বাহিনী। পশ্চিমারা প্রতিদিনই কমবেশি ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিলেও রাশিয়ার দখল থেকে ইউক্রেনীয়রা নিজেদের সার্বভৌম ভূমিকে রক্ষা করতে পারেনি।

আরও পড়ুন

যুদ্ধে কোনো পক্ষই প্রকাশ্যে পরাজয় স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু ১০০ দিনের যুদ্ধ শেষে বলা যায়, রাশিয়া স্পষ্টতই এগিয়ে আছে। রাশিয়া ইউক্রেনের সার্বভৌম অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলনস্কি। এই ১০০ দিনের যুদ্ধকৌশল যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে প্রপাগান্ডা চালিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের আগেই ইউক্রেনসহ পশ্চিমারা রাশিয়ার যুদ্ধকৌশলের কাছে বিভ্রান্ত হয়েছে। রাশিয়া প্রথমেই সফলতার সঙ্গে প্রচারণা চালিয়েছে যে তারা কিয়েভ দখল করবে এবং সেই অনুযায়ী সামরিক প্রস্তুতিও রেখেছিল। সবার মনযোগ ছিল কিয়েভকেন্দ্রিক। আর ওদিকে একটু একটু করে রাশিয়া ইউক্রেনের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল দখল করেছে। রাশিয়ার বাহিনী এখন ওডেসা বন্দরের কাছাকাছি খেরসন এলাকা পর্যন্ত চলে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার থেকে শুরু করে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টে আপসের পক্ষে বড় বড় সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞরা কলাম লিখছেন। এখনই আপসের আলোচনা শুরু করলে অন্তত ওডেসা বন্দর রক্ষা করা যাবে। ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরে প্রবেশের একটি পথ নিদেনপক্ষে খোলা থাকবে। মূলত এই ধারণা থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার সফট পাওয়ার, মানে বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহার করতে চাইছে।

সম্ভবত ওডেসা বন্দর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা রাশিয়া দখলে নিতে পারলেই ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে। কারণ, মারিউপোল থেকে ওডেসা বন্দর পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকা রাশিয়া দখল করলে ইউক্রেন একটি ল্যান্ডলক দেশে পরিণত হবে। ফলে কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের আর কোনো দখলস্বত্ব থাকবে না। এ ক্ষেত্রে ন্যাটোর কাছে ইউক্রেন গুরুত্ব হারাবে। ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার মূল উদ্দেশ্যই ছিল কৃষ্ণসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তার বাড়ানো। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী পোল্যান্ড ও বাল্টিক দেশগুলোও ন্যাটোর সদস্য। কিন্তু এসব দেশের ন্যাটোভুক্তি নিয়ে রাশিয়া সব সময় অসন্তোষ প্রকাশ করলেও তাদের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোভুক্তির জন্য আবেদন করলেও রাশিয়া মৌখিকভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করে কূটনৈতিক আচার-আচরণের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের মূলে ছিল কৃষ্ণসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় রাশিয়ার প্রভাব বজায় রাখা।

আরও পড়ুন

বিশ্ব সমুদ্র বাণিজ্যে প্রবেশের ক্ষেত্রে কৃষ্ণসাগর রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক নৌপথ। উত্তর মহাসাগরে আর্কটিক নৌপথ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু জমাট বরফ ঠেলে সমুদ্রপথ বজায় রাখা ব্যয় ও কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। ওই পথ দিয়ে চীন, জাপান হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আফ্রিকা ও এশিয়ার পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও নৌ বাণিজ্যের জন্য কৃষ্ণসাগর সব সময়ই রাশিয়ার জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করেছে। এই সাগর রাশিয়ার সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। নভোরসসিস্ক বন্দর দিয়ে রাশিয়া দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ করে। ওদিকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো এই বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করে থাকে। এই অংশকে রাশিয়া কোনোভাবেই পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে যেতে দেবে না।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, রাশিয়া সব উপকূলীয় এলাকা দখলে নিয়ে ল্যান্ডলক দেশে পরিণত করার পরও ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে পারে? সেখানে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হতে পারে। পূর্ব ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতেও যুক্তরাষ্ট্র ক্ষেপণাস্ত্রসহ নানা ধরনের সামরিক অস্ত্র মোতায়েন করে রেখেছে। কিন্তু এসব অস্ত্রের প্রয়োগের শঙ্কা খুবই কম। কারণ, বিপরীতে রাশিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাক করে তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানা ঠিক করে রেখেছে। তাই ল্যান্ডলক ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঝুঁকি প্রশমনের পথ রাশিয়ার আছে। কিন্তু কৃষ্ণসাগর রক্ষার কোনো বিকল্প রাশিয়ার ছিল না।

কৃষ্ণসাগর নিয়ে রাশিয়ার সতর্কতা মধ্যযুগ থেকেই লক্ষ করা যায়। রাশিয়া সব সময়ই কৃষ্ণসাগরকে ভূ-অর্থনৈতিক কৌশলের জায়গা থেকে বিবেচনা করেছে। ১৭৮৩ সালের রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলের মাধ্যমে প্রথম উষ্ণ জলের বন্দর তৈরি করে, যাতে সারা বছরই আমদানি–রপ্তানির কাজ অব্যাহত রাখা যায়। উত্তরের বন্দরগুলো মূলত গ্রীষ্মকালেই কর্মক্ষম ছিল ওই সময়। ক্রিমিয়া দখলের পর কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার প্রভাব–প্রতিপত্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ওই সময় থেকে গত শতকের নব্বই দশক পর্যন্ত স্নায়ুযুদ্ধকালে তুরস্ক কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে সক্রিয় ছিল। প্রথমে অটোমানদের তুরস্ক, পরে ন্যাটোর সদস্য তুরস্কও রাশিয়ার স্বার্থের বিপরীতে প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু বর্তমানের তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বর্তমানে বেশ উষ্ণ। রাশিয়া তুরস্কের কাছে এস৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করছে। গ্যাস ও তেল সরবরাহের জন্য তুর্ক স্ট্রিম পাইপলাইন নির্মাণ করেছে।

কিন্তু রাশিয়া কৃষ্ণসাগর দখলে মরিয়া হলেও কিছু সমস্যা রয়েছে। কৃষ্ণসাগর থেকে বের হলেই ভূমধ্যসাগর। এখানে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। আর ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ পথ হচ্ছে বসফরাস চ্যানেল ও দার্দেনেলিস প্রণালি। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে তুরস্ক। অতীতে তুরস্ক রাশিয়ার প্রতিপক্ষ হলেও এরদোয়ান–শাসিত তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক নেহাত খারাপ নয়। বিশেষ করে ২০১৬ সালে এরদোয়ানবিরোধী ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার পর রাশিয়া-তুরস্কের সম্পর্ক অনেকটাই উষ্ণ হয়েছে। রাশিয়া এই সম্পর্ককে ব্যবহার করে সিরিয়া, মিসর, লিবিয়া, তিউনিসিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। রাশিয়া মূলত এই নৌপথ ব্যবহার করেই যুদ্ধের সময়ে সিরিয়ার বন্দরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল, যা পরে সিরিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতিকেই বদলে দেয়।

এ সবকিছু বিবেচনা করেই রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে ন্যাটোর প্রভাব আর বাড়তে দিতে রাজি না। ইতিমধ্যেই কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী দেশ রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া ন্যাটোভুক্ত হয়েছে। ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তি রাশিয়াকে আরও কোণঠাসা করে দেবে। তাই রাশিয়া কিয়েভ দখলের হুমকি দিলেও কার্যত ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল দখল করেছে। ওই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে এখন ওডেসার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ওডেসা দখল সম্পন্ন হলে রাশিয়া নিজেই ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিতে পারে। এবং আলোচনা শুরু হলে রাশিয়া নিঃসন্দেহে চীন, ইরান, তুরস্ক, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সমর্থন পাবে। এমনও হতে পারে, এই কয়েকটি দেশের উপস্থিতিতে রাশিয়া-ইউক্রেনের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে।

সম্ভবত এমন পরিণতি আঁচ করতে পেরেই যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীরা ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে আপস করার পরামর্শ দেওয়া শুরু করেছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এই আপসের অংশীদার হতে চায়। ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত কৌশলগত পরাজয়ের মুখে। এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার থেকে শুরু করে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টে আপসের পক্ষে বড় বড় সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞরা কলাম লিখছেন। এখনই আপসের আলোচনা শুরু করলে অন্তত ওডেসা বন্দর রক্ষা করা যাবে। ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরে প্রবেশের একটি পথ নিদেনপক্ষে খোলা থাকবে। মূলত এই ধারণা থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার সফট পাওয়ার, মানে বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহার করতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু এতে করেও শেষ রক্ষা না–ও হতে পারে। এত দূর এসে রাশিয়া এই সুযোগ সহজে হারাতে চাইবে না। কারণ, এখন পর্যন্ত রাশিয়া তার কৌশলে সফল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক