কারা সেই 'রাঘববোয়াল'?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

পনেরো আগস্টের বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার মুখে ‘রাঘববোয়াল’ জড়িত থাকার কথা শুনে ভারতের উত্তর প্রদেশের গুনমানি বাবা ওরফে ভগবানজির কথা মনে পড়ল। গুনমানি বাবা একজন অজ্ঞাতনামা সাধু, যিনি ১৯৮৫ সালে ফৈজাবাদে মারা যান। অনেকেরই বিশ্বাস ছিল, তিনি ছিলেন ১৯৪৫ সালে নিখোঁজ বা নিহত হওয়া বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের আরেক প্রবাদপুরুষ নেতাজি।

 প্রধান বিচারপতির কথায় তাঁকে মনে পড়ার কারণ হলো, গত বছর এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশে বিচারপতি বিষ্ণু সাহাইয়ের নেতৃত্বাধীন এক সদস্যের কমিশন গঠিত হলো। এর লক্ষ্য হলো, ওই সাধু বাবার প্রকৃত পরিচয় খুঁজে বের করা। এর আগে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মনোজ মুখার্জির নেতৃত্বে কমিশন করেছিল। তার লক্ষ্য ছিল, নেতাজির মৃত্যুর কারণ উদ্‌ঘাটন করা।

দেখার বিষয় হলো, ৭১ বছর পরও যদি সত্য জানতে বিচার বিভাগীয় কমিশন ভারতে হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশে তা হবে না কেন। টুঙ্গিপাড়া নিবাসী শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র হিসেবে জাতির জনককে খুন করা হয়নি। একটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেই তাঁর হত্যা মামলার বিচার হয়েছে। সেটাও পূর্ণাঙ্গ নয় বলে প্রধান বিচারপতির কথায় ইঙ্গিত মেলে। আর তাই সেই ঘটনাবলির দেশি-বিদেশি পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির স্বরূপ উদ্‌ঘাটন করার কোনো বিকল্প নেই।

মরণোত্তর বিচার সত্যানুসন্ধানের জন্যও হয়ে থাকে। সেটা দুরূহ হলেও এটা অনস্বীকার্য যে, খোন্দকার মোশতাক, জিয়া, কর্নেল আবু তাহেরসহ অন্যদের পঁচাত্তরের ভূমিকার তথ্যানুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়নি। নতুন প্রজন্মের কাছে রাষ্ট্রের এই দায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। 

বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের সূচনা কবে কোথায় শুরু হয়েছিল, তা আমাদের জানা নেই। তবে এ বিষয়ে দেশি-বিদেশি কোনো যোগসূত্রের কথা যখনই মনে পড়ে, তখন কয়েকটি প্রশ্নে সব সময় আন্দোলিত হই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট হিসেবে আলোচিত কিছু জনপ্রিয় ভাষ্যকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেই ভাষ্যগুলো হচ্ছে, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, এক বিয়ের অনুষ্ঠানে মেজর ডালিমের হেনস্তা হওয়া, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চালু করা একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল এবং জাসদের প্রতিষ্ঠা ও তাদের তৎপরতার যোগফল হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড।

কিন্তু এর সব কটি ঘটনার আগেই আমরা দেখতে পাই খুনি চক্রের প্রধান নায়ক সৈয়দ ফারুক রহমান ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে হাজির হয়েছেন। ফারুক রহমান ১৯৭২ সালেই ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৩ সালে দুই ভায়রা (ফারুক-রশিদ) গিয়ে কর্মকর্তাদের অবাক করে বলেছেন, জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন অস্ত্র ক্রয় কমিটির পক্ষে তাঁরা অস্ত্র কিনতে এসেছেন। কিন্তু ওই কাজে সেখানে তাঁদের যাওয়ার কথা নয়। কারণ, জিয়ার নেতৃত্বে ওই কমিটি হয়নি। 

আবার সৈয়দ ফারুক রহমানের ১৯৭৪ সালের মে মাসে নেওয়া একটি উদ্যোগের সঙ্গে ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে হেনরি কিসিঞ্জারের ঢাকা সফরের কোনো যোগসূত্র ছিল কি? সেই প্রশ্নও তোলা যায়। ১৯৭৪ সালের মে মাসে ফারুক রহমান সরাসরি ঢাকায় একজন মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুজিব সরকারের উৎখাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চেয়েছিলেন। যদিও ১৯৭৫ সালের আগস্টে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বাংলাদেশ ডেস্কে কর্মরত স্টিফেন আইজেন ব্রাউন দাবি করেছেন, মুজিববিরোধী একটি সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সতর্ক করে দিয়েছিল।

১৯৭৫ সালের মার্চে ঢাকার মার্কিন মিশন থেকে অন্তত অর্ধডজন তারবার্তা গেছে, যার বিষয় একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান। একটির শিরোনাম: সিআইএ এবং বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান। এর বিষয়বস্তু পাইনি। তবে এটা যে ফেলনা ছিল না, তার সমর্থনে বলা যায়, এই তারবার্তাটির একটি কপি তখন মিসর সফররত কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এরপর ’৭৫-এর ২১ মে বঙ্গবন্ধুর ওপর গ্রেনেড হামলার একটি খবর ২৩ মে ওয়াশিংটনে পাঠান (তারবার্তা নম্বর ১৯৭৫ ঢাকা ০২৫৩৫) তৎকালীন রাষ্ট্রদূত বোস্টার। মার্কিন কূটনীতিক (তথ্যবিষয়ক) আলপার্ন বিষয়টি জেনেছিলেন একজন সাংবাদিকের সূত্রে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা ইউনিটে কর্মরত একজন উপপুলিশ সুপার দূতাবাসের বাঙালি রাজনৈতিক সহকারীকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ আমাদের নিশ্চিত করেছেন যে, মার্কিনরা মুজিবকে সতর্ক করেছেন, এটা তাঁদের অজানা। আইজেন ব্রাউন বলেছিলেন, তাঁর এসব দাবির সপক্ষে দলিলপত্র যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাফেজখানায় পাওয়া যাবে। ২০১২ সালে মেরিল্যান্ডের কলেজপার্কে টানা দুই মাস বাংলাদেশ-সংক্রান্ত কয়েক হাজার নথিপত্র খুঁজে দেখেছি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত নথির হদিস মেলেনি। তবে এটা বুঝেছি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং আনুষ্ঠানিক সহযোগিতা ও সমর্থন ব্যতীত এই চেষ্টা কোনো ব্যক্তির পক্ষে চালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। বহু দলিল রয়েছে, যা অবমুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো কালো কালিতে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে। কোথাও মুছে ফেলা হয়েছে। তবে এসব অংশ মার্কিন ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্টের আওতায় নির্ধারিত ফরম ও পদ্ধতি অনুসরণ করে তা সরবরাহ করার অনুরোধের পথ খোলা আছে। তবে তা এতই ব্যাপক যে এই দরখাস্ত করার বিষয়টি কোনো একটি ছোটখাটো গ্রুপের পক্ষে ও অল্প সময়ে সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব। আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে বলা যায়, বাংলাদেশ যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব তথ্য সংগ্রহের যথা উদ্যোগ গ্রহণ না করে, তাহলে ব্যক্তির পক্ষে তা আহরণের চেষ্টা খণ্ডিত এবং অসম্পূর্ণ থাকতে বাধ্য।

অনেকেরই জানা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ঢাকার বইয়ের দোকান, নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের স্তূপে এখন পর্যন্ত নতুন প্রজন্মের কাছে বিদেশিদের লেখা দুটি বই কালেভদ্রে চোখে পড়ে। এর একটি মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের আনফিনিশড রেভল্যুশন এবং অন্যটি হলো অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের এ লিগ্যাসি অব ব্লাড। কোনো কাকতালীয় যোগাযোগ আছে কি না, জানি না। ঢাকার ফুটপাতে কেন জানি অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের এ লিগ্যাসি অব ব্লাড বইটি লিফশুলজের বইটির চেয়ে বেশি বিক্রি হয়।
একটু তাকালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, নীলক্ষেত, পাবলিক লাইব্রেরি ও চারুকলার সামনে কিছু পুরোনো বইয়ের স্তূপের মধ্যে সহজেই এ লিগ্যাসি অব ব্লাড-এর বাংলা তর্জমা অপেক্ষাকৃত জোগানটা বেশি।   সিআইএর একটা সম্পৃক্তার বিষয়ে লিফশুলজ আগাগোড়া স্থির বিশ্বাসে অটল আছেন। অন্যদিকে ম্যাসকারেনহাস যথেষ্ট রহস্যজনকভাবে ফারুক-রশিদের জবানিতে পাঠকদের কাছে একটি তথ্য বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। সেটি হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের আগে ফারুক-রশিদদের সঙ্গে কোনো মার্কিন যোগাযোগ ছিল না।

‘প্রথমা’ থেকে প্রকাশিত মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড বইটি অন্তত অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেছে যে ম্যাসকারেনহাস-সমর্থিত ফারুক-রশিদের ওই দাবি মিথ্যা ছিল। সুতরাং এটা খুঁজে বের করা দরকার যে ম্যাসকারেনহাসের ওই বইটি প্রকাশনায় জেনারেল এরশাদ সরকারের ভূমিকা কী ছিল। এ বিষয়ে আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করি। খুনিদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন যেমন, তেমনি এই বিতর্কিত বইটি প্রকাশ ও প্রচারে তাঁর ভূমিকার ব্যাপকতা চিহ্নিত করা অপরিহার্য।

অন্যদিকে এই প্রশ্নেরও একটা উত্তর খুঁজে বের করা যে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন শীর্ষ নেতাদের জানিয়েছিল, মুজিব হত্যা সিআইএর কাজ নয়।

আশির দশকে সাবেক কংগ্রেস সদস্য স্টিফেন সোলার্জ ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে একটি তদন্ত অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে মার্কিন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এই তদন্ত কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও অনুরোধ করা যেতে পারে। কারণ, তাদের মনোভাব বদলেছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পেছনে বাকশাল গঠনকে তুলে ধরা হলেও এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যে ফারুক-রশিদের ১৯৭৩ সাল-পূর্ববর্তী মার্কিন দূতাবাসে গমন এবং ১৯৭৫ সালে ব্যাংককে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার আপ্রাণ চেষ্টা এবং তাঁদের প্রতি হেনরি কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত সহানুভূতি সমর্থনের মধ্যে একেবারেই কোনো যোগসূত্র নেই, তা হলফ করে বলা যায় না। আবার এ ব্যাপারে হয়তো কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলারও সুযোগ নেই।

তাই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে একটি তদন্তের অনুরোধ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নথিপত্র সংগ্রহে সরকারের দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে আশা করব, দেশ-বিদেশের রাঘববোয়ালদের খুঁজে বের করতে একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি হবে। প্রধান বিচারপতি আক্ষেপ করেছেন যে, ‘তদন্তে ত্রুটির’ কারণে তাঁরা রাঘববোয়ালদের বিচারে সোপর্দ করতে পারেননি। কিন্তু তাঁরা কারা? তাঁদের বিচারে সোপর্দ করার নির্দেশনা রায়ে আছে। প্রধান বিচারপতি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম রায়দানকারী। তাই সর্বোচ্চ আদালতের এই পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমরা ভবিষ্যতে এ নিয়ে আদালতের যথা নির্দেশনা কি আশা করতে পারি না? এলাহাবাদ হাইকোর্ট যা পারলেন, আমাদের সুপ্রিম কোর্ট অধিকতর জোরালো যুক্তিতে তা নিশ্চয় পারবেন।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷