গণমাধ্যমের সামনে কী কী বাধা, মুক্তি কিসে

ইসরায়েল–ফিলিস্তিনিদের সংঘর্ষের সময় আহত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক, ২০১৮ সাল
ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতা বড় ধরনের সংকটে আছে। এর মধ্যে কিছু সংকট বৈশ্বিক, অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের সামাজিক–রাজনৈতিক পার্থক্য সত্ত্বেও কিছু সংকট সর্বত্রই আছে। অন্যদিকে কিছু সুনির্দিষ্ট সংকট নির্দিষ্ট দেশের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট। আমরা বৈশ্বিকভাবে সাংবাদিকতার তিনটি চ্যালেঞ্জকে সহজেই চিহ্নিত করতে পারি।

বৈশ্বিকভাবে সাংবাদিকতার প্রধান সংকট হচ্ছে আস্থার সংকট। অতীতে শ্রোতা-দর্শক-পাঠকেরা সাংবাদিকতাকে সঠিক তথ্য বা ফ্যাক্ট-এর প্রধান উৎস বলে বিবেচনা করেছে। কিন্তু এখন সেখানেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিছু বিষয় যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে, যেগুলোকে আমরা বলতে পারি ‘কমন ফ্যাক্ট’, সেই নিয়েই সংশয় তৈরি করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি যে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এ সত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রবণতা লক্ষণীয়।

২০২১ সালের গোড়াতে ‘প্রেস গেজেট’ বলে একটি সংবাদ পোর্টাল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকদের কাছে প্রশ্ন করেছিল, ২০২১ সালের চ্যালেঞ্জগুলো কী। তার উত্তর দিতে গিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট–এর নির্বাহী সম্পাদক মার্টি ব্যারন বলেছিলেন, সাংবাদিকতাকে একসময় ফ্যাক্ট বা প্রকৃত তথ্যের মধ্যস্থতাকারী বলেই মনে করা হতো; বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা এবং সর্বোপরি প্রমাণের ওপরে ভিত্তি করে সাংবাদিকতা কী সত্য আর কী মিথ্যা তার মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করত। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই, অন্ততপক্ষে এ বিষয়ে সংশয়-সন্দেহ তৈরি করা হচ্ছে। মিথ্যা এবং ষড়যন্ত্রের কথা প্রচার করা এখন আর্থিকভাবেই কেবল লাভজনক তা নয়, রাজনৈতিকভাবেও তা পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে। এ কারণেই এ সময়কে ফেক নিউজের যুগ বলে আমাদের বিবেচনা করতে হচ্ছে।

ফেক নিউজের প্রচার এবং প্রসারে যোগাযোগপ্রযুক্তির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে আর এর প্রধান বাহন হয়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যম। গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাজনীতিতে ভিন্নমত এবং বিভক্তি কোনো নতুন বিষয় নয়। কিন্তু এখন সমাজে এ ধরনের ভিন্নমতকে এমন একপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যা সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। কেননা ভিন্নমতের আড়ালের উদ্দেশ্যটি হচ্ছে সত্যকে অস্বীকার ও সত্য প্রকাশে বাধা দেওয়া। সাংবাদিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে সে কারণেই। কেননা সাংবাদিকতার অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে প্রশ্ন করা, সাংবাদিকতার কাজ হচ্ছে জনস্বার্থে জবাবদিহি নিশ্চিত করা। ক্ষমতা বা ক্ষমতার বাইরে যারাই জবাবদিহির ধারণাকে পরাস্ত ও একটি ভাষ্যকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তারাই এ ধরনের প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত হয়।

সাংবাদিকতার স্বাধীনতার ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। ফ্রিডম হাউস এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসেবেই দেখা যাচ্ছে যে সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্রের যখন উল্টো যাত্রা হচ্ছে, সেই সময়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে স্বাধীন গণমাধ্যম। শুধু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা হচ্ছে তা নয়, সাংবাদিকেরা যাতে সত্য প্রকাশ করতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

দ্বিতীয় সংকট হচ্ছে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। ফ্রিডম হাউস এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসেবেই দেখা যাচ্ছে যে সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্রের যখন উল্টো যাত্রা হচ্ছে, সেই সময়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে স্বাধীন গণমাধ্যম। শুধু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা হচ্ছে তা নয়, সাংবাদিকেরা যাতে সত্য প্রকাশ করতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা, ক্ষেত্রবিশেষে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন নির্বাচনের মাধ্যমে, এমনকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই, তাঁদের মধ্যেও এ প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেছে। নতুন কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা এমন সব আইন তৈরি করেছেন, যেগুলো সাংবাদিকের কাজের পরিধিকে সীমিত করে দেয়, তাঁদের ওপরে নজরদারির ব্যবস্থা চালু করে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে কোভিড-১৯ অতিমারির অজুহাতে পৃথিবীর ১৭টি দেশে এমন সব আইন করা হয়েছে, যেগুলো দৃশ্যত ফেক নিউজ বা বিভ্রান্তিকর সংবাদ মোকাবিলার জন্য করা, কিন্তু এসব আইনের মর্মবস্তু ভালো করে লক্ষ করলেই দেখা যায়, এগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জন্য প্রচলিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কথা উল্লেখ্য। তুরস্কে ২০১১ সাল থেকেই এ ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক আইনের সূচনা হয়।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গণমাধ্যমের মালিকানার হাতবদল এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপরে আইনি এবং আর্থিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেও সংবাদমাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে। এর জন্য মালিকানা এমন সব ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়া হয়, যারা সরকারি ভাষ্যকেই প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত থাকে। হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবান, সার্বিয়ার আলেক্সান্ডার ভুচিক নিজ নিজ দেশের গণমাধ্যমের ওপরে তাঁর সমর্থকদের মালিকানা এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলে সেই সব দেশে আর কিছু নেই। হাঙ্গেরির সংবাদমাধ্যমগুলোর ৯০ শতাংশ এখন সরকার সমর্থকদের হাতেই। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে তুরস্কের সবচেয়ে বড় মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ডোগান মিডিয়া কোম্পানি সরকারের সমর্থকেরা কিনে নেওয়ার পরে তুরস্কে এখন কার্যত বিরোধী কোনো বড় সংবাদমাধ্যম নেই। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মালিকানাবিষয়ক গবেষণায় দেখা গেছে যে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বিশেষত অধিকাংশ টেলিভিশনের মালিকানা এখন ক্ষমতাসীনদের সমর্থকদের হাতেই (আলী রীয়াজ ও মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান, ‘বাংলাদেশে মিডিয়ার মালিক কারা?’ ; সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ, জানুয়ারি ২০২১)।

সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের আরেকটি পথ হলো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমকে নির্দেশনা প্রদান কিংবা সাংবাদিককে হুঁশিয়ার করা। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে আনীত এ ধরনের অভিযোগ যে কেবল পাকিস্তানেই সীমিত, তা মনে করার কারণ নেই।

তৃতীয় সংকট হচ্ছে সাংবাদিকতার ওপরে প্রত্যক্ষ আক্রমণ। এ আক্রমণগুলো কখনো কখনো হয় মৌখিক। ২০১৭ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকতাকে ‘জনগণের শত্রু’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। ২০২০ সালেই তিনি কমপক্ষে ৬৬২টি টুইট করেছেন, যেগুলো সাংবাদিকতার জন্য হুমকি। তাঁর এসব বক্তব্য সাংবাদিকতার ব্যাপারে তাঁর সমর্থকদের মধ্যে কেবল বিরূপ মনোভাবই তৈরি করেনি, একধরনের আগ্রাসী আচরণেরও সূচনা করে।

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট–এর হিসাবে দেখা যায়, ২০২০ সালে সারা পৃথিবীতে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের কারণে আটক হয়ে কারাগারে আছেন ২৭৪ জন। সাংবাদিকদের আটক করার এ হিসাব ২০১৬ সালের সর্বোচ্চ হিসাবকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২০ সালে যে ৩২ জন সাংবাদিক মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে ২২ জন হত্যার শিকার হয়েছেন তাঁদের দায়িত্ব পালনের কারণে। গত বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে আক্রমণ এবং হেনস্তার ঘটনা কেবল সরকারের পক্ষ থেকেই করা তা নয়, অনেক সময় সেই কাজটি তুলে দেওয়া হয় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের হাতে।

এই তিন সংকটের বাইরেও সাংবাদিকতাকে অন্যান্য ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কিন্তু এ চ্যালেঞ্জগুলো সারা বিশ্বেই সাংবাদিকতার জন্য এত বড় হয়ে উঠছে যে এগুলো মোকাবিলা করা ছাড়া অন্য সংকটগুলো মোকাবিলা করা যাবে বলে মনে হয় না। যেটা লক্ষণীয় তা হচ্ছে এ সংকটগুলো তৈরি হচ্ছে বিরাজমান শাসনব্যবস্থার কারণে। এ সংকটগুলোর বিভিন্ন দিক আলোচনার সময়ে এটা বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই যে অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, জবাবদিহি যার একটি অনিবার্য উপাদান, তা যেখানেই দুর্বল হয়েছে, সেখানেই এ সংকটগুলো ব্যাপক রূপ নিয়েছে। ফলে এ সংকট মোকাবিলার জন্য দরকার এর উৎস যেখানে, সেখানে মনোযোগ দেওয়া।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট