গুমের শিকার কারা ভূমধ্যসাগরে হারিয়ে গেছেন

গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা ‘মায়ের ডাক’ নামের যে সংগঠন গড়ে তুলেছেন, সেই সংগঠনের এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। তাঁরা গুম হওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে দুই মন্ত্রীর ওই বক্তব্যকে ‘মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ অভিহিত করেছেন। নাগরিক ঐক্য, জাসদ, বাম জোটসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। যেসব মন্তব্য নিয়ে এসব প্রতিবাদ, তাতে কী ছিল?

উভয় মন্ত্রীই গত শনিবার একই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পর জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত থাকার প্রশ্নে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার জবাবে ওই মন্তব্য করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, জাতিসংঘ নয়, জাতিসংঘের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের একটি তালিকা দিয়েছিল। পরে দেখা গেল, ভূমধ্যসাগরে অনেক লোকের সলিলসমাধি হয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন যা বলেছেন, তা সম্পূর্ণ নতুন তথ্য, আগে কেউ কখনো এমন কথা বলেনি। তবে ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হওয়া বাংলাদেশিদের মধ্যে গুমের শিকার দাবি করা কতজন আবিষ্কৃত হয়েছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা এখনো প্রকাশ করেননি। মায়ের ডাক সংগঠনের কেউ জানতে পারেননি যে সরকার তাঁদের মধ্যে কার সন্তান, ভাই বা স্বামীর সন্ধান পেয়েছে। তাঁরা তো কয়েক বছর ধরে সেই আকুতিই জানিয়ে আসছিলেন যে তাঁদের স্বজন বেঁচে আছে না মারা গেছে, সেটা যেন জানানো হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বা তার নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ দলগুলোও তাদের জিজ্ঞাসার জবাবে এমন কোনো তথ্য পেয়েছে বলে আমরা শুনিনি। আমরা কি তাই যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন করতে পারি না, কবে ওই তথ্য প্রকাশ করা হবে?

এ ধরনের নাটকীয় দাবি জানানোর সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কণ্ঠে কি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান ও তার হয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ দলগুলোর প্রতি কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুর ছিল? না হলে তিনি যেগুলোকে ‘জাতিসংঘের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান’ বলেছেন, তাদের উপর্যুপরি জিজ্ঞাসার জবাব দিতে এত অনীহা কেন? গত ডিসেম্বরেও গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রকাশনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালের একটি ঘটনা ছাড়া আর কোনোটির বিষয়ে তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়নি।

সরকারের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলে থাকেন যে বাংলাদেশে গুম বা এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স বলে কোনো শব্দ নেই। তাঁরা সম্ভবত এটি বলেন যেহেতু বাংলাদেশ এখনো গুমবিরোধী জাতিসংঘ সনদ বা কনভেনশন সই বা অনুমোদন করেনি। কিন্তু সনদে অংশ না নিলেও এ রকম গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বিশ্বের দৃষ্টি থেকে আড়াল করা সহজ নয় এবং তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না। গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজন কিংবা অভিযোগকারী ব্যক্তি বা সংগঠনকে ভীতি প্রদর্শন বা হয়রানি থেকে সুরক্ষা দেওয়ার কথাও যে সনদে আছে, সেটাও আমাদের স্মরণে রাখা দরকার, না হলে এসব লঙ্ঘনেই দেশের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানো বিবৃতিটি যেদিন পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে, সেদিনেই খবর এসেছে, ভূমধ্যসাগরে ঠান্ডায় প্রাণ হারানো সাত বাংলাদেশির দুজনের মরদেহ আগামী সপ্তাহে দেশে আসবে। যে নৌযান ডুবে যাওয়ায় এই ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, ওই নৌকায় যাত্রী ছিলেন ২৮৭ জন, যাঁদের মধ্যে ২৭৩ জনই বাংলাদেশি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যদি তথ্য থাকে যে এই সাম্প্রতিকতম দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যেও গুমের তালিকার কেউ আছেন, তাহলে সেটাও প্রকাশ করা হোক।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তালিকায় গুমের শিকার হিসেবে যাঁদের নাম-পরিচয় দেওয়া আছে, তাঁদের মধ্যে কার কার ভূমধ্যসাগরে তলিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সরকার নিশ্চিত হতে পেরেছে, তা প্রকাশ করতে না পারলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি স্বজনহারানো পরিবারগুলোর কাছে দুঃখ প্রকাশ করবেন? তাঁর মন্তব্য শুধু যে গুমের শিকার পরিবারগুলোর জন্য বেদনাদায়ক তা-ই নয়, জীবিকার অন্বেষণে সাগর ও মহাদেশ পাড়ি দেওয়া অভিবাসনকামীদের জন্যও পীড়াদায়ক। ভূমধ্যসাগরে যেসব বাংলাদেশির প্রাণ গেছে, তাঁরা কেউ শখ করে বিনোদনমূলক ভ্রমণে যাননি। সরকারের উন্নয়ন দর্শন ও কৌশল তাঁদের জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে না পারায় তাঁরা জীবন গড়তে কাজের সন্ধানে পরিবার ও মাটির মায়া ত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। ভূমধ্যসাগরের এই বিপজ্জনক পথে যাওয়া থেকে নাগরিকদের নিবৃত্ত করতে সরকার কতটা সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা রেখেছে?

তিনটি ইউরোপীয় সংবাদ সংস্থা ফ্রান্স মেডিয়াস মন্ডে, ডয়চে ভেলে ও ইতালিয়ান প্রেস এজেন্সি আনসার যৌথ গবেষণায় তৈরি সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, গত বছরে অবৈধ পন্থায় ৮ হাজার ৬৬৭ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। ইউরোপীয় বর্ডার এজেন্সি, ফ্রন্ট্যাক্সের প্রকাশিত পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, তাঁদের মধ্যে ৭ হাজার ৫৭৪ জন ভূমধ্যসাগরের কেন্দ্রীয় রুট এবং ৬০৪ জন ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলীয় রুট ধরে ইউরোপে গেছেন। আর বলকান অঞ্চল দিয়ে ঢুকেছেন ৪৩৭ জন। তাঁদের সবার পছন্দের গন্তব্য ইতালি এবং তাঁরা এ অভিবাসনযাত্রায় জনপ্রতি খরচ করেছেন চার থেকে ছয় হাজার ইউরো। ভূমধ্যসাগরে হারিয়ে যাওয়া প্রত্যেক বাংলাদেশির সন্ধান করা এবং মরদেহ না পাওয়া গেলেও তাঁর পরিচয় ও সর্বশেষ অবস্থান নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় উদ্‌ঘাটন না করে, তাঁদের নিয়ে রাজনৈতিক অজুহাত তৈরি করা ও গুমের অভিযোগ আড়াল করার চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আরও পড়ুন

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক অবস্থায় মারা যাওয়া বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর তাঁর মেয়ে প্রকাশ করার ঘটনাকে তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। অথচ কেউ কখনো দাবি করেনি যে হারিছ চৌধুরীকে গুম করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশ আমন্ত্রিত না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোকে গণতন্ত্র সম্মেলনে ডেকেছে, যে কারণে আমন্ত্রিতদের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। তখন লিখেছিলাম যে আমরা তাঁর সৃজনশীলতায় মুগ্ধ হচ্ছি। কিন্তু এখন বলতে হচ্ছে, যে দেশটিতে তিনি প্রায় তিন দশক কাটিয়েছেন, সেই যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো বিকল্প সত্য তৈরি করার গুণটি তিনি আয়ত্ত করতে চলেছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অবশ্য আগের মতোই বলেছেন, ‘আমরা সব সময় বলি, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। যেখানেই গুম হচ্ছে, সেখানেই আমরা কিছুদিন পরেই তাকে পাচ্ছি। নানা কারণে আত্মগোপন করে থাকে, সেগুলোকে গুম বলে চালিয়ে দেয়। বাংলাদেশে কেউ গুম হয় না।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ মন্তব্য পুনরাবৃত্তি মাত্র, যা প্রায় এক দশক ধরেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। ২০১৯ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সংকলিত গুমের শিকার ৮৬ জনের কতজনকে কোথায়, কবে পাওয়া গেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি সেই তালিকা প্রকাশ করতেন, তাহলে কিন্তু এত বিতর্ক ও সমালোচনার অবকাশ থাকে না। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি যখন বলছেন গুম হওয়া ব্যক্তিদের কিছুদিন পরই তাঁরা পাচ্ছেন, তাহলে কেন খুঁজে পাওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় সরকারিভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে না?

আরও পড়ুন

সরকারের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলে থাকেন যে বাংলাদেশে গুম বা এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স বলে কোনো শব্দ নেই। তাঁরা সম্ভবত এটি বলেন যেহেতু বাংলাদেশ এখনো গুমবিরোধী জাতিসংঘ সনদ বা কনভেনশন সই বা অনুমোদন করেনি। কিন্তু সনদে অংশ না নিলেও এ রকম গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বিশ্বের দৃষ্টি থেকে আড়াল করা সহজ নয় এবং তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না। গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজন কিংবা অভিযোগকারী ব্যক্তি বা সংগঠনকে ভীতি প্রদর্শন বা হয়রানি থেকে সুরক্ষা দেওয়ার কথাও যে সনদে আছে, সেটাও আমাদের স্মরণে রাখা দরকার, না হলে এসব লঙ্ঘনেই দেশের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হবে।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক