চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা কমাতে স্বাস্থ্যবিমার বিকল্প নেই

স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যয়ের বড় একটি অংশ সেবাগ্রহীতার পকেট থেকে যায়। সরকার থেকে খরচের পরও সেবাগ্রহীতা নিজ পকেট থেকে যে অর্থ ব্যয় করেন, তাকে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার বা বাড়তি খরচ বলা হয়। আমাদের দেশে দিন দিন এ ব্যয় বাড়ছে। রোগীর জন্য তা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ খরচ বাড়তে থাকবে, যতক্ষণ না আমরা কার্যকর একটি স্বাস্থ্যবিমা চালু করতে পারছি। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা চিকিৎসা গ্রহণে মানুষের আগ্রহ বাড়াবে এবং খরচের বোঝা কমে যাবে। স্বাস্থ্যবিমার জন্য সরকারি-বেসরকারি ও সেবাগ্রহীতার সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য রক্ষায় স্বাস্থ্যবিমার বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন

বিভিন্ন গবেষণা ও বিশ্বব্যাংক গত বছরের শেষ দিকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইন ফোকাস: ক্লাইমেট অ্যাফ্লিকশন’ শীর্ষক প্রকাশনায় জানিয়েছে, আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচারের বৈশ্বিক গড় ৩২ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে রোগীরা স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয়ের ৭৪ শতাংশ নিজস্ব উৎস থেকে মেটায়। এর মধ্যে ৬৩ শতাংশ খরচ হচ্ছে ওষুধে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গ্লোবাল হেলথ এক্সপেন্ডিচার ডেটাবেইস বলছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে স্বাস্থ্যসেবায় অর্থায়নের সিংহভাগ আসে রোগীর পকেট থেকে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। চিকিৎসকের পরামর্শের ফি, ওষুধ, রোগ নির্ণয়, পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ বাড়তি ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত। চলতি অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ। আগের অর্থবছরের চেয়ে মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। বাজেটে অন্যান্য খাতের মতো স্বাস্থ্য তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না।

সরকারি অবকাঠামোগত স্বাস্থ্যসেবাও জনগণের বাড়তি ব্যয় কমাতে পারছে না। গত নভেম্বরে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট জানিয়েছে, সরকারি হাসপাতাল থেকে ওষুধ পান মাত্র ৩ শতাংশ রোগী আর প্রায় ১৫ শতাংশ রোগী রোগ নির্ণয়ের সুযোগ পান। ২০১২ সালে বাড়তি ব্যয় ছিল ৬৩ শতাংশ। ‘স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশল: ২০১২-২০৩২’ অনুযায়ী, ২০৩২ সালের মধ্যে এ ব্যয় ৩২ ভাগে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। তবে চিকিৎসায় রোগীর নিজস্ব খরচ তুলনামূলক বেড়েছে।

সবার জন্য বৈষম্যহীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে বিমার বিকল্প নেই। আমরা জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিমা কার্যক্রম শুরু করতে পারি। এনআইডি কাজে লাগিয়ে ব্যক্তির ইলেকট্রনিক মেডিকেল রেকর্ড বা ইএমআর তৈরি করতে পারি। এতে রোগীর বংশগত রোগ, পরিবারের অন্য সদস্যদের রোগের ইতিহাস, নিজের রোগ ও শারীরিক অবস্থা সংরক্ষণ করা হবে। হাসপাতালে বহির্বিভাগে টিকিট কাটার সময় ব্যক্তির এনআইডি নম্বর নিয়ে এসব তথ্য ইএমআরে যুক্ত করা হবে। শক্তিশালী সার্ভারের মাধ্যমে সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হবে। এরপর কোথাও চিকিৎসার জন্য গেলে ব্যক্তির এনআইডি নম্বর দিলেই তার স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য পাওয়া যাবে।

আরও পড়ুন

দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাধারণত ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের কোনো না কোনো রোগ থাকে। কিছু রোগের চিকিৎসা ব্যয় অনেকের সামর্থ্যের বাইরে। স্বাস্থ্যবিমার জন্য তা চারটি ভাগ করা যেতে পারে। এতে মানুষ সহজে স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা পাবে। যেমন কিডনি রোগ, হৃদ্‌রোগ, ক্যানসার, মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহের বিঘ্নতা বা স্ট্রোক, নিউরোসার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারিসহ বেশ কিছু জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। কিডনি অকেজো হলে তা প্রতিস্থাপন করতে হবে অথবা সারা জীবন ডায়ালাইসিস করতে হয়। সপ্তাহে দু-তিনবার ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।

ডায়ালাইসিস করলে ওই রোগীর আয় কমে যায়, তাতে রোগী আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ে। হার্টের রোগের ক্ষেত্রে বাইপাস সার্জারি, অ্যানজিওপ্লাস্টি ও স্টেনটিং করতে হয়। ক্যানসারের জন্য কেমোথেরাপি-রেডিওথেরাপি দিতে হয়। বয়স্কদের মধ্যে নিউরো ও অর্থোপেডিক সার্জারিও বেশি হচ্ছে। এমন আরও অনেক জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যক্তি বছরে বা মাসে নির্দিষ্ট টাকার প্রিমিয়াম দিয়ে বিমা করবে। তাতে চিকিৎসার সময় ব্যয়ের বড় অংশ এখান থেকে মেটাতে পারবে। কেউ কর্মজীবনের প্রথমে বছরে নির্দিষ্ট অঙ্কের প্রিমিয়াম দেওয়া শুরু করলে বৃদ্ধ বয়সে এক থেকে দুই লাখ টাকা মূল্যমান বা তার বেশি চিকিৎসা নিতে পারবে। স্বাস্থ্যবিমার শর্ত অনুযায়ী, যেকোনো বয়সে সেবা পাবে। এতে সরকার, সংশ্লিষ্ট বিমাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অংশগ্রহণ থাকবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এসব ব্যয়বহুল চিকিৎসা মানুষের নাগালের বাইরে ছিল। তারা গত কয়েক বছর আগে বিমার আওতায় এসেছে।

কিছু অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ যুগ যুগ ধরে চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ভিটামিন ডি ডেফিসিয়েন্সি, হাইপোথাইরয়েডিজমের (জন্মগত বামনত্ব, পেশির কাঠিন্য ও মানসিক জড়তা) মতো রোগ। এসবের চিকিৎসা রোগীর পরিবারের সদস্যদেরও খরচ বাড়ায়। একটা প্রিমিয়াম নিয়ে বিমা শুরু করলে মানুষকে চিকিৎসার দীর্ঘমেয়াদি খরচ থেকে বাঁচানো যাবে। একই সঙ্গে মানুষ রোগ প্রতিরোধে উদ্যোগী হবে। এতে প্রতিরোধ সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়বে।

দেশে সংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার বেশি ছিল। এসব রোগ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় সরকারের বহু ব্যবস্থা রয়েছে। বেসরকারি সংস্থাও (এনজিও) কাজ করে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিমা ততটা জরুরি নয়। এরপরও কিছু ক্ষেত্রে সংক্রামক রোগের চিকিৎসা বিমার আওতায় আনা যেতে পারে।

ইমিউনাইজেশন বা টিকাদান কার্যক্রম, দুর্ঘটনা ও মহামারিতে জরুরি চিকিৎসাকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তারা জাতীয় পরিচয়পত্রধারী যে কাউকে সেবা দিতে বাধ্য থাকবে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের সময় সরকার এ শর্ত দেবে। সরকারিভাবে স্বল্প মূল্যে বেসরকারিকে দিয়েও চিকিৎসা সম্ভব। দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ৬৫ শতাংশই বেসরকারি খাতে। করোনা নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসায় আমরা সফল। তবে স্বাস্থ্যবিমা চালু থাকলে রোগীর খরচ কমত।

চিকিৎসাসেবায় বিশ্বের মডেল কিউবা, স্বাস্থ্যবিমা নাগরিকের চিকিৎসার শতভাগ খরচ বহন করে। যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্যবিমা ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ বহন করে। বাকিটা রোগীকে বহন করতে হয়। ভারতে সম্প্রতি ‘আয়ুষ্মান ভারত’ নামে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫ থেকে ৩০ কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা হয়েছে। ১৩০ কোটি মানুষের দেশটির সবাইকে বিমার আওতায় আনতে সময় লাগবে। ভারতে সরকারি বরাদ্দ, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সেবাগ্রহীতার অংশগ্রহণে প্রিমিয়াম তৈরি হয়। ভরতে ওই সব অঞ্চলে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান অর্ধেক মূল্যে সেবা দেয়। বাংলাদেশেও কয়েকটি বিমাপ্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যবিমা কার্যক্রম রয়েছে। তবে ১ শতাংশ জনগোষ্ঠীও বিমার মধ্যে আসেনি। দেশে স্বাস্থ্যবিমার বড় সম্ভাবনায় রয়েছে। চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ বিমার মধ্যে আনতে পারি। সম্পূর্ণ খরচ বা বিনা মূল্যে বিমার সুবিধা দেওয়া হলে নীতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডের সুযোগ থাকবে। রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা, ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যয়ের ২৫ শতাংশ রোগীকে বহন করতে হবে।

নাগরিকের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। স্বাস্থ্যবিমার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র ও ইলেকট্রনিক মেডিকেল রেকর্ডের মাধ্যমে শক্তিশালী স্বাস্থ্যসম্পর্কিত তথ্যভান্ডার তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। এ কার্যক্রম দিয়েই শুরু হোক স্বাস্থ্যবিমার প্রস্তুতি। পৃথিবীর সবকিছুর শুরুটা জটিল বা কঠিন হলেও পরবর্তী সময়ে তা ত্রুটিমুক্ত হয়েছে। সবকিছুরই খারাপ দিক রয়েছে। কঠোর নজরদারির মাধ্যমে নীতিবিরুদ্ধ, অপব্যবহার ও জালিয়াতি রোধ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি খাত ও এনজিওর সমন্বিত প্রচেষ্টায় স্বাস্থ্যবিমা করার সময় এখনই। নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্বাস্থ্যবিমার পাইলট প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। করোনা মহামারির সময় জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা নিতে কেউ বিদেশে যায়নি। এখানেই সবাই চিকিৎসা নিয়েছে। আমরা এখন প্রায় সব চিকিৎসা দিতে পারি।

ডা. এ এম শামীম ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
[email protected]