জনগণের করের টাকায় আমলাদের বিদেশ সফর কতটা ফল দেয়?

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সরকার অতি সম্প্রতি যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম হলো বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করা। সিদ্ধান্তটি দেশের আপামর মানুষ খুব ইতিবাচকভাবে নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ, গণমাধ্যমে এ–সংক্রান্ত যেসব খবর প্রকাশিত হয়, তাতে এটা স্পষ্ট যে কনফারেন্স, সেমিনার, শিক্ষাসফর, কর্মশালার মোড়কে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের একটা অংশই প্লেজার ট্রিপ বা আনন্দভ্রমণ। কারও হয়তো কাজ এক দিনের, তিনি গিয়ে রইলেন সাত দিন, কারও কাজ তিন দিনের, তিনি ফিরলেন ১৩ দিন পর। দেখা গেল কিছু সেমিনার বা কনফারেন্সে মধ্যপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার দায়িত্ব রয়েছে, সেখানে একটা ছুঁতো বের করে চলে গেলেন বড় পর্যায়ের এক হালি কর্মকর্তা, যেখানে কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নেই অথবা ভূমিকা একেবারেই আলংকারিক। আর যত বড় কর্মকর্তা, তত বেশি বিজনেস ক্লাস, তত বেশি খরচ। জনগণের কষ্টার্জিত আয় থেকে দেওয়া করের টাকার শ্রাদ্ধ আর কাকে বলে!

এসব বিদেশ সফরের জন্য সরকারি আদেশ (জিও) পেতেও ঝুটঝামেলা বিশেষ হয় বলে শুনি না, কারণ, যিনি আদেশে সই করছেন তিনি নিজেও একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন।

যেহেতু ডলার বাঁচানোর জন্য সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বাতিল করেছে, অতএব, একটা বিশেষসংখ্যক বিদেশ সফরের মধ্যে গলদ আছে, তাতে আর সন্দেহ কি! দেশের জন্য, দশের জন্য খুব বেশি প্রয়োজন যদি থাকত, তবে তো আর শুরুতেই এর ওপর খড়্গ নেমে আসত না। মনে প্রশ্ন আসে, শুধুই কি রাষ্ট্রীয় কোষাগার রক্ষার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত? এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিদেশ সফরের নামে অর্থ পাচারের অভিযোগ বিস্মৃত হই কি করে! কোনো বিরোধী দলীয় রাজনীতিক নয়, স্বয়ং এ অভিযোগ তুলেছিলেন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেছিলেন, রাজনীতিবিদেরা নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকুরেরা। গোপনে কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশিদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই দিন বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’

তবে ওই অভিযোগের পর এ বিষয়ে আর কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানা যায় না। এটুকু মনে করা নিশ্চয়ই অসংগত হবে না যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের সঙ্গে টাকা পাচারের অভিযোগেরও একটা সাজুয্য আছে। প্রশ্ন হলো, এসব সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিলব্ধ উপার্জন বন্ধে প্রশাসনের তরফ থেকে কতটা শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়? দুদক কতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, কতজন গ্রেপ্তার হয়েছেন? এসব প্রশ্ন তোলা খুব জরুরি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছেন এক কোটিরও বেশি প্রবাসী। তাঁরা বিদেশের মাটিতে মেহনত করছেন আর সেই অর্থ পাঠাচ্ছেন দেশে। এ দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে পোশাক কারখানাগুলো। রপ্তানি আয়ের বড় অংশটি আসছে এই খাত থেকে। অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে এ দেশের কৃষি। করোনাকালে কৃষকেরা দারুণভাবে ফসল ফলিয়ে কৃষি অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। খাদ্যসংকট হতে দেননি। দেশের মানুষের কষ্টার্জিত আয়ের একটি পয়সাও অপাত্রে দান করার সুযোগ নেই।

২.

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সব সময়ই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। দেশের গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ দিতে হয়, তারা এসব বিষয় সামনে এলে বিনা প্রশ্নে ছেড়ে দেয়নি। আবার গণমাধ্যমের চোখে ধুলো দিয়েও অনেক কিছু ঘটে, ঘটছে। দেশের উন্নয়নে দক্ষ, গতিশীল ও প্রযুক্তিগতভাবে উৎকর্ষ কর্মকর্তা-সমৃদ্ধ প্রশাসন গড়ে তোলা দরকার। কর্মকর্তাদের বৈশ্বিক মানের দক্ষতা অর্জনে বিদেশ সফরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু সে সফর হতে হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থে। কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে দেশের জনগণ কতটুকু লাভবান হচ্ছে—এ প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যায়। কারণ, এসব বিদেশ সফরের একটি বড় অংশের খরচ মেটানো হয় জনগণের করের টাকায়।

কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা পর্যালোচনা করা জরুরি। দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনে কর্মকর্তাদের বিদেশ পাঠানোর ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা হয় কতটুকু? দেখা যাচ্ছে, একই কর্মকর্তা বারবার বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। এক দেশ থেকে ঘুরে এসে আবার অন্য দেশ যাচ্ছেন। আবার অনেক কর্মকর্তা সারা কর্মজীবনে একবারও বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পান না। তাহলে কি তাঁর দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই? একবার বিদেশ সফর করে আসার পর তিনি দুই বছর সরকারি সফরে যেতে পারবেন না—এমন নীতিমালা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

অন্যান্য দেশের সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের কর্মজীবনে সংখ্যায় কতটা সরকারি সফর করেন, সেটি বিবেচনা করা দরকার। আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারতের কর্মকর্তারা এত বিদেশ সফর করেন বলে জানা যায় না। আবার অন্য দেশের কর্মকর্তারা আমাদের দেশে ততটা আসেন বলেও তেমন শোনা যায় না। তাহলে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কেন এত বিদেশ সফরপ্রীতি?

সরকারি কর্মকর্তারা যেসব সেমিনার, সম্মেলনে যোগ দিতে বিপুল অর্থ খরচ করে ইউরোপ, আমেরিকা বা অন্য দেশে যান, এই যাওয়া বা যোগদান কতটা ফলপ্রসূ হয়, তা নিরূপণের কোনো ব্যবস্থা পরবর্তী সময় হয় কি? এ বিষয়ে কোনো জরিপ বা গবেষণা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করেছে কি?

আরও পড়ুন

৩.

সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিইডি) জ্যেষ্ঠ সচিব হেলাল উদ্দিন আহমেদের বিদেশ সফর। তিনি সরকারি খরচে নেদারল্যান্ডস ও স্পেনে ‘শিক্ষাসফর’ শেষে যেদিন দেশে ফেরেন, এর পরের দিন ছিল তাঁর শেষ কর্মদিবস। এরপর তিনি চলে যান এলপিআরে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, একজন আমলা হিসেবে কর্মজীবনের শেষ সময়ে এই শিক্ষাসফর সরকারের কি কাজে আসবে? তাঁর ১০ দিনের এই সফরের সম্পূর্ণ খরচ বহন করা হয়েছে ‍সরকারের তিনটি প্রকল্পের তহবিল থেকে। এ বিষয়ে যথার্থই বলেছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এটা অনৈতিক ছিল। তিনি এটা করতে পারেন না। তাঁর তো শিক্ষাসফরের দরকার নেই। এটা নতুন কর্মকর্তাদের জন্য প্রয়োজন, যাতে তাঁরা সেই শিক্ষা নিয়ে দেশের জন্য অবদান রাখতে পারেন।

এই জ্যেষ্ঠ সচিব ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন। শিক্ষাসফর প্রসঙ্গে তিনি গণমাধ্যমে বলেন, তাঁর অভিজ্ঞতা চাইলে ওয়াসা ও এলজিইডি কাজে লাগাতে পারে। প্রশ্ন হলো, ১০ দিনের শিক্ষাসফরে একজন ব্যক্তি কীভাবে যেকোনো বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠতে পারেন? জনাব হেলাল উদ্দিনের উচিত ছিল, এ ধরনের সফর থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করা। অন্তত কর্মজীবনের শেষ সময়টা নিজেকে বিতর্কের বাইরে রাখা।

আরও পড়ুন

কেবল এলজিইডির এই জ্যেষ্ঠ সচিব নন, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফরের বহু খবর আমরা গণমাধ্যমে পড়েছি, পড়ছি। ‘এসির বাতাস খেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা মালয়েশিয়ায়!’, ‘পুকুর খনন শিক্ষা গ্রহণে বিদেশ সফর’, ‘নলকূপ খনন প্রশিক্ষণে একাধিক কর্মকর্তার বিদেশ সফর’, ‘একটি ক্যামেরা কিনতে তিনজনের বিদেশ ভ্রমণ’, ‘লিফট ক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফর’, ‘নিরাপদ পানি সংরক্ষণ প্রক্রিয়া প্রশিক্ষণে উগান্ডা গমন’ ইত্যাদি অনেক সফরের কথা গণমাধ্যমের প্রতিবেদন মারফত শুনে আসছি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছেন এক কোটিরও বেশি প্রবাসী। তাঁরা বিদেশের মাটিতে মেহনত করছেন আর সেই অর্থ পাঠাচ্ছেন দেশে। এ দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে পোশাক কারখানাগুলো। রপ্তানি আয়ের বড় অংশটি আসছে এই খাত থেকে। অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে এ দেশের কৃষি। করোনাকালে কৃষকেরা দারুণভাবে ফসল ফলিয়ে কৃষি অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। খাদ্যসংকট হতে দেননি। দেশের মানুষের কষ্টার্জিত আয়ের একটি পয়সাও অপাত্রে দান করার সুযোগ নেই। সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্যই বিদেশে যাবেন, তবে তা অতি জরুরি প্রয়োজনে। আর যেসব সেমিনারে বা সম্মেলনে অনলাইনে যুক্ত হওয়া যায় সেখানে রাষ্ট্রের অর্থ খরচ করে যাওয়ার দারকার কী।

• কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]