
আমরা জানি, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী অতর্কিতে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় নির্বিচার গণহত্যা। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বাঁকবদলের রাত। কিন্তু তার একটি পটভূমি আছে। এ দেশের মানুষের মনোজাগতিক পরিবর্তন হয়েছিল প্রবলভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগুনঝরা ভাষণ শুনে। এই ভাষণের ব্যবচ্ছেদ চলছে পাঁচ দশক ধরে, নানাভাবে।
৭ মার্চকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা ঠিক হবে না। এরও আছে একটি বিস্তৃত প্রেক্ষাপট। কেমন করে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বাঁধনটা আলগা হয়ে গেল এবং সম্পর্কের শেষ সুতাটুকুও ছিঁড়ে গেল, তা বুঝতে হলে আমাদের আরেকটু পেছনে তাকাতে হবে। তাহলে আমরা ৭ মার্চের প্রাসঙ্গিকতা, অনিবার্যতা ও গুরুত্ব বুঝতে পারব।
নানা ঘটনা ও প্রক্রিয়ার পরম্পরায় এসেছিল ৭ মার্চ। যেমন ১ মার্চ না হলে ৭ মার্চ হতো না। ১ মার্চ বেলা ১টায় বেতারে ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা হয়েছিল। রেকর্ডকৃত ঘোষণাটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নামে দেওয়া হলেও প্রেসিডেন্ট এতে কণ্ঠ দেননি। প্রেসিডেন্টের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘শাসনতন্ত্র কোনো সাধারণ আইন নয়, বরং এটি হচ্ছে একত্রে বসবাস করার একটি চুক্তিবিশেষ। অতএব, একটি সুষ্ঠু ও কার্যকর শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়ের পর্যাপ্ত অংশীদারি থাকা প্রয়োজন।... শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে যুক্তিসংগত সমঝোতায় উপনীত হওয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের আরও কিছু সময় দেওয়া উচিত।’ এর পরপর ঢাকায় মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল আর্চার ব্লাড ওয়াশিংটনে পাঠানো বার্তায় বলেন, ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়ার পর ঐক্যের সম্ভাবনা এখন ০:১০০।’
তার মানে, ১ মার্চেরও একটি প্রেক্ষাপট আছে। ইতিপূর্বে শেখ মুজিব ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ছয় দফা, অর্থাৎ পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে কোনো আপস করবেন না। এটি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ইয়াহিয়া ভেবেছিলেন, মুজিব ছয় দফা পরিমার্জন করবেন। কিন্তু ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তাঁর সেই আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
ভুট্টো বিরোধী দলের নেতা হয়ে দিন কাটাতে চাননি। ২০-২১ ফেব্রুয়ারি করাচিতে তাঁর দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এক সভায় তিনি আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া সিদ্ধান্ত নেন, তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করবেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এস এম আহসান এবং আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে বলেন, অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণাটি যেন মুজিবকে ২৮ ফেব্রুয়ারি জানানো হয়, তার আগেও নয়, পরেও নয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) আহসান, ইয়াকুব ও রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ হয়। খবরটি শুনে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি অনুরোধ করেন, যদি অধিবেশন স্থগিত করতেই হয়, একই সঙ্গে নতুন একটি তারিখ যেন অবশ্যই ঘোষণা করা হয়। তাহলে তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন (সূত্র: খাদিম হোসেন রাজা, আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি)।
শেখ মুজিব বুঝতে পারলেন, পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশে এবং দলের ভেতরে স্বাধীনতাকামী তরুণদের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাসায় আসেন। মুজিব তাঁকে বলেছিলেন, তিনি অনেক বছর পাকিস্তানের জেলে বন্দী ছিলেন। যদি দেশের ঐক্য ধরে রাখা না যায়, তাহলে গুলির মুখোমুখি হতে তিনি পিছপা হবেন না। তাঁকে যদি আবারও জেলে নেওয়া হয় কিংবা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়, তবু তিনি জনগণের দেওয়া ম্যান্ডেট থেকে সরে আসবেন না। তিনি বিচ্ছিন্নতা চান না, তিনি চান একটি কনফেডারেশন, যেখানে বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পাবে। এসব কথা উঠে এসেছে ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তারবার্তায়। ওই দিনই বিকেলে ভুট্টো ঘোষণা করেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত না করলে তিনি খাইবার থেকে করাচি পর্যন্ত দেশ অচল করে দেবেন।
শেখ মুজিব ছিলেন একজন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। দেশের মানুষের মন তিনি পড়তে পারতেন এবং অন্য কুশীলবদের তৎপরতা সম্পর্কেও যথেষ্ট খোঁজখবর রাখতেন। তথ্য সংগ্রহ ও কাজ করার জন্য তাঁর অনেকগুলো হাত ছিল। প্রত্যেকেই ভাবত, তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ফেব্রুয়ারির গোড়াতেই দলের নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণার সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করেছিলেন। একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে তিনি ও তাজউদ্দীন আহমদ সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করেছিলেন। কামাল হোসেনের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। আমি তাজউদ্দীন আহমদের পরামর্শ অনুযায়ী খসড়া তৈরি করি। খসড়ায় আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছিল, যেখানে স্বাধীনতা ঘোষণার কারণ হিসেবে ব্রিটিশরাজের অবিচারের কথা বলা হয়েছিল। তাজউদ্দীন ভাইকে কাছে রেখে মতিঝিলে আমার শরীফ ম্যানশনের অফিসে আমি দুদিন কাজ করি। ঘোষণাপত্রটি আমি নিজেই টাইপ করি। খুব গোপনে এটি করা হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি আমরা এটি বঙ্গবন্ধুর হাতে দিই এবং তিনি এটি তাঁর কাছে রেখে দেন’ (সূত্র: কামাল হোসেন, কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস)। ১৩ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন যে ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। ফলে তখনকার মতো বিষয়টি চাপা পড়ে যাবে।
১ মার্চ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা শুনে লাখো মানুষ পথে বেরিয়ে আসে। জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেয়, পুড়িয়ে ফেলে পাকিস্তানি পতাকা। ২ মার্চ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়। ৩ মার্চ শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে পল্টনে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’। সভার প্রস্তাবে প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামের আগে লেখা হয় ‘জাতির পিতা’। মানুষ তখন ফুঁসছে। শেখ মুজিব অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেন। তিনি বলেন, যা বলবার, তা তিনি ৭ মার্চ বলবেন।
৬ মার্চ ধানমন্ডির বাসায় শেখ মুজিব দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, কামারুজ্জামান ও কামাল হোসেন। আলোচনা হয় যে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সামরিক বাহিনী হামলা করার অজুহাত পেয়ে যাবে। সুতরাং এটি করা ঠিক হবে না। বরং ইয়াহিয়ার ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি বিবেচনা করেন (সূত্র: ওই)।
৬ মার্চ সন্ধ্যার পর ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের টেলিফোনে কথা হয়। ইয়াহিয়া মুজিবকে অনুরোধ করেন এমন কিছু না বলতে, যেখান থেকে আর ফেরার উপায় থাকবে না (সূত্র: জি ডব্লিউ চৌধুরী, দ্য লাস ডেইজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান)।
৭ মার্চের জনসভাটি ছিল পূর্বনির্ধারিত। ওই দিন শেখ মুজিব কী বলবেন, তা নিয়ে অনেক জল্পনা ছিল। স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় তিনিই ছিলেন একমাত্র বক্তা। তাঁর ১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট, ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে ষড়যন্ত্র এবং নিরস্ত্র জনতার ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের কথা উল্লেখ করে ২৫ মার্চ নতুন করে নির্ধারিত হওয়া তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য চারটি শর্ত দেন। শর্তগুলো হলো: সামরিক আইন তুলে নিতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, জনতার ওপর গুলিবর্ষণের তদন্ত করতে হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, আবার ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা’র আহ্বান জানান এবং ‘যার যা আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা’ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। ভাষণে তিনি ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’—এই শব্দাবলি উচ্চারণ করেন দুবার। জনসভায় তিনি কী বলেছেন, তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তিনি কী বলেননি।
শেখ মুজিব জানতেন কী পরিণতি ধেয়ে আসছে। তিনি মনে মনে এ জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তবে তিনি নিজে থেকে আলোচনার পথ বন্ধ করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, সামরিক কর্তৃপক্ষের একটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিষয়টির সুরাহা হোক। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি চেয়েছি ওরাই আগে আক্রমণ করুক।’ (সূত্র: মহিউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগ: যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১)।
মেঠো রাজনীতিবিদের মতো তিনি স্বাধীনতার প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে পারতেন। অনেকেই এ রকমটি চেয়েছিলেন। কিন্তু জনগণের ব্যাপক ম্যান্ডেট তাঁকে অধিকতর দায়িত্বশীল করে তুলেছিল। ৭ মার্চের ভাষণে এই রাষ্ট্রনায়কোচিত দায়িত্বশীলতার প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি নেগোশিয়েটেড সেটেলমেন্ট চেয়েছিলেন। তবে শেষরক্ষা হয়নি। সামরিক জান্তা আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com