জনসংখ্যা আর কত বাড়লে সরকার সজাগ হবে?

বিপুল জনসংখ্যা অনেক সমস্যার কারণ
বিপুল জনসংখ্যা অনেক সমস্যার কারণ

বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা কী? কেউ বলবেন রাজনীতি, কেউ বলবেন শিক্ষার দুরবস্থা, কারও মতে জঙ্গিবাদের উত্থান। আবার কেউ জলবায়ুর পরিবর্তনকে এই মুহূর্তে জ্বলন্ত সমস্যা হিসেবে দেখতে চাইবেন। এসব সমস্যা অস্বীকার করছি না। কিন্তু সব সমস্যার মূলে রয়েছে বর্ধিত জনসংখ্যা। আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৪তম। আর জনসংখ্যার দিক দিয়ে সপ্তম। অর্থাৎ ভূমির অনুপাতে জনসংখ্যা ১৩ গুণেরও বেশি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যার গভীরতা বুঝতে এই একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট।
বিশ্বের তাবৎ অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, জনসংখ্যাবিদ জনসংখ্যাকে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও আমাদের নীতিনির্ধারকেরা সেটি মানতে চান না। তাঁরা মনে করেন, বিপুল জনসংখ্যা বোঝা নয়, সম্পদ। প্রশ্ন হলো, বর্ধিত জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশে আছে কি না? মাঝেমধ্যে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কথায় ধন্দে পড়ে যাই যে, বর্ধিত জনসংখ্যা যদি সম্পদই হয়, তাহলে কি সেই সম্পদ বাড়ানোর কাজেই আমরা নিয়োজিত থাকব? তাহলে কি বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে?
বাংলাদেশের আয়তন ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি। কোনো কোনো গবেষকের মতে আরও বেশি। বিশ্ব জনসংখ্যার ২ দশমিক ১৯ শতাংশ বাংলাদেশে বাস করলেও ভূমির পরিমাণ সহস্র ভাগের এক ভাগেরও কম। পাঠক এই লেখাটি পড়তে যদি পাঁচ মিনিট সময় নেন, দেখবেন এরই মধ্যে বাংলাদেশে ৪০টি শিশু জন্ম নিয়েছে। প্রতি মিনিটে আটটি। এই যে পাঁচ মিনিটে ৪০টি শিশু জন্ম নিল, তার খাদ্য, পুষ্টি, বস্ত্র, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বাসস্থানের ব্যবস্থা কি আমরা করতে পারব? যদি না পারি, তাহলে ওই মানবসন্তানেরা আমাদের অভিশাপ দেবে। ইতিমধ্যে যেসব আশরাফুল মাখলুকাতকে আমরা মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করছি, তারাও অভিশাপ দিচ্ছে। একজন আয়লানের সমুদ্রে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা সারা বিশ্বে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে যে কত আয়লান পানিতে ডুবে, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে, তার খোঁজ আমরা রাখি না। গেল শতকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় প্রতিটি শিশুর জন্য বিশ্বকে তার বাসযোগ্য করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও আমরা সব শিশুর জন্য বাংলাদেশকে বাসযোগ্য করতে পারিনি। এই অক্ষমতার জবাব কী?
স্বাধীনতার পরপর এ দেশে মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) ছিল ৬ বা তার কাছাকাছি। অর্থাৎ একজন নারী গড়ে প্রায় ছয়টি সন্তান জন্ম দিতেন। এখন টিএফআর ২.৩। এটা বড় সাফল্য বলে সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করেন। কিন্তু খুব শিগগির টিএফআরকে প্রতিস্থাপন পর্যায়ে অর্থাৎ ২.১ করতে না পারলে ২০৩০ সালে জনসংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে—তারা কি তা ভেবে দেখেছেন? বেকারত্ব থেকে পরিবেশদূষণ, মাদকাসক্তি থেকে জঙ্গিবাদের উত্থান—সবার মূলে রয়েছে জনসংখ্যার আধিক্য। দুঃখের কথা, মধ্য আয়ের দেশের স্বপ্নে বিভোর সরকারও সাত বছর আগে বর্ধিত জনসংখ্যার বিপদ আঁচ করতে পারেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দিনবদলের সনদ নামে যে ইশতেহার ঘোষণা করেছিল, তাতে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, ২০২১ সাল নাগাদ দেশের জনসংখ্যা হবে ১৬ দশমিক ৫ কোটি; শ্রমশক্তি হবে ১০ দশমিক ৫ কোটি। কিন্তু ২০১৬ সালের মাঝামাঝি এসে জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি ছাড়িয়েছে। বছরে যদি ন্যূনতম ২০ লাখ মানুষ যোগ হয়, ২০২১ সালে জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৭ থেকে ১৮ কোটি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য অতি সামর্থ্যবান আওয়ামী লীগ ওরফে মহাজোট সরকারেরও নেই।
১৯৯০ সালে যেখানে বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে ৮ নম্বরে ছিল, ২০১০ সালে সেটি একধাপ এগিয়ে ৭ নম্বরে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের ওপরের জনসংখ্যার দেশগুলো হলো চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল ও পাকিস্তান। আয়তনে রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হলেও জনসংখ্যায় বাংলাদেশের নিচে (১৪ কোটি ৩৪ লাখ)। যেসব দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে ছোট ও অত্যধিক ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ভারতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৩৬২ জন, বাংলাদেশে ১ হাজার ১২৬ জন। আমাদের পুবের প্রতিবেশী মিয়ানমারের আয়তন বাংলাদেশের পাঁচ গুণ। অথচ জনসংখ্যা তিন ভাগের এক ভাগ।
একটি দেশে জনসংখ্যা তখনই সম্পদ হয়, যখন প্রত্যেকটি কর্মক্ষম নাগরিককে জনশক্তি হওয়ার সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় এবং সেই শক্তি কাজে লাগানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত রাখা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, বাংলাদেশের কোনো সরকারই এ ব্যাপারে সুচিন্তিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তাদের উন্নয়ন নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় সমগ্র মানুষ নেই। আছে খণ্ডিত একটি জনগোষ্ঠী। তাঁরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে জোর আওয়াজ তোলেন, কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল সবাই পাচ্ছেন কি না সেসব নিয়ে মাথা ঘামান না। উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। সমাজের উঁচুতলার কিছু মানুষ অঢেল ধন–সম্পদের মালিক হলেও বিপুল জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে সব ধরনের সুযোগ সুবিধার বাইরে। সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী নামে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়, তার উদ্দেশ্য দরিদ্র–কর্মহীন মানুষের কাছে খয়রাতি সাহায্য পৌঁছে দেওয়া। তাদের কর্মসংস্থান বা ভাগ্যোন্নয়ন নয়। আবার এই কথিত সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর নামে প্রতিবছর যে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, তার কতটা ওই দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে, আর কতটা স্থানীয় টাউট-বাটপারদের পকেটে যায়, তা বলা কঠিন। তথ্যমন্ত্রী সত্য কথা বলেও একবার ফিরিয়ে নিয়েছেন।
একদা যে দেশটিতে ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি ছিল, সেই দেশটি এখন সবার মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে পারছে। এটি নিঃসন্দেহে আনন্দের কথা। কিন্তু মানুষ তো কেবল দুমুঠো খাবার পেলেই দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হয় না। সে জন্য চাই উপযুক্ত বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান। আমরা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে যতই আহ্লাদিত হই না কেন, এরও সীমা আছে। একদিকে মানুষ বাড়ছে, অন্যদিকে সেই মানুষের খাবার জোগাবে যে কৃষিজমি, তার পরিমাণ কমছে। জনসংখ্যার বিষয়ে এখনই আমরা সজাগ না হলে অদূর ভবিষ্যতে সেই খাদ্যশস্যও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি যে ‘মহাপ্রলয়’ নিয়ে আসছে, ঢাকার রাস্তায় নামলে তা কিছুটা টের পাওয়া যায়। শহরের বস্তি, ফুটপাত, রেললাইন, কাঁচাবাজার, টার্মিনাল, আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক এলাকা—সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। আগে জনসভা হতো নির্দিষ্ট স্থানে, এখন যেকোনো স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত জনসভা ঘোষণা করা যেতে পারে। নগরবিদেরা মনে করেন, ঢাকা শহরের যে আয়তন ও অবকাঠামো, তাতে ৩০ লাখ মানুষ মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারে। কিন্তু ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা এখন দেড় কোটিরও বেশি। ৩০ লাখ মানুষের অবকাঠামো দিয়ে তাদের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়।
ঢাকা শহরের জনসংখ্যা নিয়ে বছর দুই আগে প্রথম আলোয় শিশির মোড়লের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রতিদিন ১ হাজার ৪১৮ জন মানুষ বাড়ছে। বছরে যুক্ত হচ্ছে গড়ে ৫ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ মানুষ৷ বর্তমানে ঢাকা শহরে দৈনিক যুক্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। এই হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে আগামী পাঁচ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যা বছরে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ হারে বাড়লেও শহর এলাকায় এই হার ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। এই বর্ধিত মানুষের চাপ ঢাকা শহর বইতে পারছে না। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশও পারবে না।
দেশের শিশু ও বয়স্ক নারী-পুরুষের একটি বড় অংশ মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। গত সাত বছরে দারিদ্র্যসীমার হার অনেক কমিয়ে আনার পরও ২৩ শতাংশ মানুষ তার নিচে বাস করছে। এর অর্থ, আমাদের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশকে জীবনধারণের ন্যূনতম যে উপাদান তা আমরা সরবরাহ করতে পারছি না। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও বাসস্থান সমস্যার কথাও কেউ ভাবছে না।
সরকারের দাবি অনুযায়ী শিক্ষার হার ৬০ শতাংশ। এর অর্থ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর ৪০ শতাংশ মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। কিন্তু যে ৬০ শতাংশ মানুষ শিক্ষা লাভ করেছে, তাদের কি আমরা কাজ দিতে পেরেছি? পারিনি বলেই বেকার তরুণেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তাঁদের অনেকে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মারা পড়ছেন, কেউ বা ধূসর মরুভূমিতে হারিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলেও চাকরি পান না। চাকরি পেলেও বেতন পান না। কয়েক দিন আগে প্রথম আলোতে সৌদি আরবে কর্মরত ১ হাজার ৬০০ জন শ্রমিকের আট মাস ধরে বেতন না পাওয়ার কাহিনি ছাপা হয়েছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে এ রকম কত যে বেদনা ও কষ্টের কাহিনি আছে, তার হিসাব কর্তাব্যক্তিরা রাখেন না।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার জন্য যে শিক্ষা প্রয়োজন, আমরা তার জোগান দিতে পারছি না। আবার উচ্চশিক্ষার নামে প্রতিবছর যে লাখ লাখ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর জনশক্তি তৈরি করছি, তারা দেশের কিংবা পরিবারের কোনো কাজে আসছে না।
আজ আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জনসংখ্যাকে বড় সমস্যা হিসেবে দেখেন না। কিন্তু ৪১ বছর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটিকে বাংলাদেশের পয়লা নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেষ ভাষণে তিনি জনসংখ্যার সমস্যার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রত্যেক বছর ৩৩ লাখ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের প্রত্যেক বছর ৩৩ লাখ লোক বাড়ে, তাহলে ২৫-৩০ বছরে বাংলার কোনো জমি থাকবে না চাষ করার জন্য। বাংলার মানুষ মানুষের মাংস খাবে। সে জন্য আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে।’ (সূত্র: বাঙালির কবি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ)
জনসংখ্যা আর কত বাড়লে সরকার সজাগ হবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com