ডায়রিয়ার চাপ, না চাপের ডায়রিয়া?

ডায়রিয়া রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে আইসিডিডিআরবি
ছবি: শিশির মোড়ল

‘সময়ের’ এক মাস আগেই এবার মহাখালীর কলেরা হাসপাতালে (আইসিডিডিআরবি) শামিয়ানা টানিয়ে চিকিৎসা শুরু হয়েছে। ২২ মার্চের হিসাব নিয়ে প্রথম আলো জানিয়েছিল প্রতি ঘণ্টায় ৫০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে। ২৩ মার্চ ইংরেজি ডেইলি স্টার খবরের হালনাগাদ করে বলেছে, ঘণ্টায় ৫৩ জন। আইসিডিডিআরবি বলছে, প্রতিষ্ঠানের ৬০ বছরের ইতিহাসে এত রোগীর চাপ তারা দেখেনি। ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশের এলাকায় রোগী এখানে আসে। রোগীর চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় দ্বিতীয় শামিয়ানা ফেলতে হয়েছে। হয়তো রোগী আরও বাড়বে। অতিরিক্ত অস্থায়ী তাঁবু বা শামিয়ানা সাধারণত শেষ বা মধ্য এপ্রিলের চাহিদা হয়ে থাকে। এবার আগেভাগেই সেটা শুরু করতে হয়েছে। স্মরণকালের মধ্যে ২০১৮-তে বেশ বেড়েছিল ডায়রিয়া রোগী। তখন প্রতিদিন গড়ে এক হাজারের মতো রোগী আসত চিকিৎসা নিতে। সেবার এক দিনে সর্বোচ্চ এসেছিল ১ হাজার ৪৭ জন। কিন্তু এই প্রথম ১ হাজার ২০০ জন ছাড়িয়ে গেছে।

সব মিলিয়ে ১৬ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত এক সপ্তাহে ৮ হাজার ১৫২ জন রোগী এ হাসপাতালে ডায়রিয়ার চিকিৎসা নেয়। রাজধানীর সব জায়গা থেকেই রোগী এলেও যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, দক্ষিণখান থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত মানুষ বেশি আসছে। প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব হাসপাতালে বছরে এক লাখের বেশি ডায়রিয়া রোগীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়। নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতালে রোগী আসছে নগরীর পাইকপাড়া, জলারপাড়, বাবুরাইল, নিতাইগঞ্জ, নয়াবাজারসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকা থেকে। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে চিকিৎসার জন্য আসছে শতাধিক রোগী। গত এক সপ্তাহে প্রায় এক হাজার রোগী ডায়রিয়া ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিয়েছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে মাত্র ৯টি শয্যা থাকায় হাসপাতালে করিডরে দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা। অধিক সংখ্যক রোগী আসায় হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ডায়রিয়ার চাপের পেছনে অর্থনীতির চাপ কতটা ভয়ানক, সেটাও আমাদের গবেষণা করে দেখতে হবে। চিন্তা করতে হবে শুধু বড় বড় হাসপাতাল বানিয়ে রোগ নিরাময়ের দিকে ঝুঁকব, না জীবন–জীবিকার ন্যায্য ব্যবস্থা আর সুলভে নিরাপদ পানির ছায়া দিয়ে মানুষকে রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখব?

ধরনেও তফাত?

সময়ের তফাতের সঙ্গে সঙ্গে রোগীর বয়স এবং রোগের ধরনেও তফাত লক্ষ করা যাচ্ছে। কলেরা হাসপাতালের প্রধান বাহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেছেন, রোগীদের সিংহভাগ বয়স্ক। তবে রোগীদের ৩০ শতাংশ তীব্র ডায়রিয়া বা কলেরায় আক্রান্ত। অন্য সময় শিশু বয়সের রোগীর হার বেশি থাকলেও এবারের চিত্রটা ভিন্ন। তবে ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জ ছাড়া অন্য যেসব অঞ্চল থেকে আগাম ডায়রিয়ার খবর আসছে, সেসব জায়গায় তুলনামূলকভাবে শিশু রোগীর সংখ্যায় বেশি। আগে কখনো কলেরার কথা উচ্চারণ করতেন না হাসপাতালের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে কোনোমতে বলতেন, ‘সিভিয়ার ডায়রিয়া’। শুনিয়ে দিতেন নানা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাল কিংবা পরজীবী সংক্রমণের কথা। এবার প্রথম আলোকে প্রথম দিনই কলেরার কথা বলেছেন হাসপাতালের প্রধান। জানিয়েছেন, ভর্তি হতে আসা ২৩ শতাংশ রোগীই কলেরায় আক্রান্ত। এটা খুবই ভয়ংকর খবর।

কলেরা হাসপাতালে কেন এত চাপ

আইসিডিডিআরবি রোগী নিয়ে হিমশিম খেলেও অন্য হাসপাতালগুলোতে তেমন চাপ নেই। ঢাকার অন্য হাসপাতালের চিত্র স্বাভাবিক সময়ের মতোই। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক রশিদ উন নবী জানিয়েছেন, তাঁদের হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়েনি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘এটার জন্য কলেরা হাসপাতালেই সবাই যায়। সেখানেই রোগীরা যাচ্ছে, এখানে বাড়েনি।’ ঢাকায় অনেকগুলো সরকারি হাসপাতাল থাকলেও মহাখালীর কলেরা হাসপাতাল ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে মানুষের প্রথম পছন্দ। চিকিৎসার মান নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই। ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জের বেশির ভাগ রোগীই আসছে কম আয়ের বসতি অঞ্চলগুলো থেকে।

ডায়রিয়া বা কলেরা থেকে মুক্ত থাকার উপায় কী

এ প্রশ্নের উত্তর তখনই আমরা সঠিকভাবে দিতে পারব, যখন জানতে পারব কেন মার্চে কলেরার দশা হচ্ছে? হতে পারে এটা জীবাণুর রোগতত্ত্বগত আচরণের কারণে বা নিরাপদ পানির অভাবে অথবা যেমন দু-একজন গবেষক বলেছেন, ‘আমরা ধারণা করছি, কোভিড কমে যাওয়ায় মানুষ বেপরোয়া হয়ে গেছে। হাত ধোয়ার অভ্যাসটা একদমই কমে গেছে। এটাই আমার মনে হয় একটি বড় কারণ।’ তবে গবেষণা ছাড়া কোনোটাই হলফ করে বলা যাবে না, বলা উচিতও হবে না। নগরের রোগীর মধ্যে পূর্ণবয়স্কদের সংখ্যা বেশি আর মফস্বলে শিশুরা কেন বেশি? সঠিক কিন্তু ত্বরিত গবেষণা ছাড়া এসব জরুরি প্রশ্নের উত্তর মিলবে না।

ডায়রিয়ার চিকিৎসক ও গবেষকেরা একবাক্যে বলছেন, ‘ডায়রিয়া উপশমের পদ্ধতি আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু তাতে রোগ নিরাময় হলেও প্রতিরোধ হবে না।’ তাই তাঁরা সবাইকে পরামর্শ দিচ্ছেন ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ডায়রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে পানি ফুটিয়ে খেতে হবে।’ গোল বেঁধেছে এখানে পানি ফুটানো দূরে থাক, মানুষ এখন বাসি খাবার গরম করে খাওয়ার কথাও ভাবতে পারছে না। আমাদের এক বন্ধু নামকরা এক ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। যানজটে আটকা পড়ে গাড়ির চালকের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলছিলেন। বাকিটা তাঁর বয়ানেই শুনি, ‘জ্যামে বসে আছি। সময় পার করার জন্য আমার ড্রাইভার হাসানের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছি। একপর্যায়ে হাসান হতাশা নিয়ে জানাল, গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম এই সপ্তাহে ১ হাজার ৫৫০ টাকা করা হয়েছে। গত সপ্তাহে ছিল ১ হাজার ৪৫০ টাকা। কয়েক মাস আগেও তার সংসারে এক মাসে দেড় সিলিন্ডার গ্যাস লাগত। অর্থাৎ, তখন মাসে হাসানের গ্যাস বাবদ খরচ হতো ২ হাজার ১৭৫ টাকা! উপায় না দেখে হাসান আর তার বউ বুদ্ধি করে তিন দিনের রান্না এখন এক সাথে করে। যখন খায়, গরম করে খায়। এভাবে তারা কোনোমতে মাসে এক সিলিন্ডারে কাজ চালিয়ে নেয়। এখন তার মাসে গ্যাস বাবদ খরচ হবে ১ হাজার ৫৫০ টাকা। হাসানের কর্তা আমি। আমার মাসে ডাবল বার্নার বাবদ গ্যাসের বিল ৯৫০ টাকা। আর হাসানের খরচ ১ হাজার ৫৫০ টাকা।’ এখন বলুন তো হাসান পানি ফুটিয়ে খাবে কীভাবে?

ডায়রিয়ার চাপের পেছনে অর্থনীতির চাপ কতটা ভয়ানক, সেটাও আমাদের গবেষণা করে দেখতে হবে। চিন্তা করতে হবে শুধু বড় বড় হাসপাতাল বানিয়ে রোগ নিরাময়ের দিকে ঝুঁকব, না জীবন–জীবিকার ন্যায্য ব্যবস্থা আর সুলভে নিরাপদ পানির ছায়া দিয়ে মানুষকে রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখব?

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

[email protected]