ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিষ্ঠুরতা ও মন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমন কিছু ধারা আছে, যা কেবল নাগরিক অধিকার খর্ব করে না, সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের সুযোগও মারাত্মকভাবে সংকুচিত করেছেছবি : প্রথম আলো

গত ১১ জুন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত আলোচনা সভায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাঁরা হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাঁদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।

ভুক্তভোগী রুমা সরকারসহ কয়েকজন ভুক্তভোগীর কথা শোনার পর মন্ত্রী বলেন, ‘রুমার সঙ্গে যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি একটি স্বাধীন দেশে একটি মা তার দুই সন্তানকে সকাল পর্যন্ত তার ঘরে থাকার অধিকারটুকু দেয়নি। রাষ্ট্র এমন একটি আচরণ করেছে, এ জন্য আমি ক্ষমা চাই। এই রাষ্ট্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। আমি মনে করি, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবার ঘটনাই দুঃখজনক। একদিক থেকে যদি বলেন, তবে আমার হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়া উচিত।’ (প্রথম আলো, ১২ জুন ২০২২)

এই উপলব্ধির জন্য মন্ত্রী মহোদয়কে ধন্যবাদ জানাই। যখন তাঁর অন্য সহকর্মীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের স্তুতি গাইছেন, তখন মোস্তাফা জব্বার হয়তো বিবেকের তাগিদে ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে অন্য কোনো ব্যক্তি এ ধরনের মন্তব্য করলে তাঁর বিরুদ্ধে আবার একই আইনে মামলা হওয়াও অস্বাভাবিক ছিল না। এ প্রসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর করিতকর্মা সদস্যদের কৃতিত্বের একটি উদাহরণ দিই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সেনা শাসনামলে প্রখ্যাত সাময়িকী সমকাল এ আবুল ফজলের একটি গল্প ছাপা হয়। ‘মৃতের আত্মহত্যা’ নামের এই গল্পের মূল কথা ছিল, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী যখন জানতে পারে তার স্বামী মানুষ খুন করেছে, সে ভেতরে-ভেতরে মানসিক পীড়ন বোধ করে এবং তার সন্তান খুনির সন্তান হবে, এটা কোনোভাবে মানতে পারেনি। গল্পটি লেখা হয়েছিল ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন সমকাল অফিসে গিয়ে সম্পাদকের কাছে জানতে চান, গল্পের লেখক আবুল ফজল কে? তাঁর ঠিকানা কী? জবাবে সম্পাদক জানান, তিনি সরকারের একজন উপদেষ্টা এবং সচিবালয়ের ভেতরেই বসেন। এরপর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আর রা করেননি। বেজার মুখে সেখান থেকে চলে যান।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমন কিছু ধারা আছে, যা কেবল নাগরিক অধিকার খর্ব করে না, সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের সুযোগও মারাত্মকভাবে সংকুচিত করেছে। আইনটির সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো এর বেশির ভাগ ধারা অজামিনযোগ্য। অর্থাৎ, বিচার করার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া। কারাগারে থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষে মামলা মোকাবিলা করা কিংবা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা কঠিন।

জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা পদে থেকেও আবুল ফজল বিবেকের তাড়নায় মৃতের আত্মহত্যা লিখেছিলেন। মোস্তাফা জব্বারও বিবেকের তাড়নায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় কতজনের কাছে যাবেন? গত তিন বছরে এই আইনে কয়েক হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, শত শত মানুষকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

মন্ত্রী মহোদয় যখন রুমা সরকারের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘এই রাষ্ট্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি’, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না রাষ্ট্রে নাগরিকদের অবস্থান কোথায়। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে জনগণের জন্য সাম্য, সামাজিক-মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেই ঘোষণা অধরাই থেকে গেছে। নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের ন্যূনতম দায়বোধ থাকলে কোলের দুই শিশুসন্তানকে বিচ্ছিন্ন করে মধ্যরাতে একজন নারীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যেতে পারতেন না।

রুমা সরকার একটি কলেজের শিক্ষক। ফেসবুকে একটি মন্তব্য করার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা হয় এবং পুলিশ রাতে তাঁর বাড়িতে হানা দিয়ে গ্রেপ্তার করে। সেই গ্রেপ্তারের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অনুষ্ঠানে রুমা সরকার বলেন, ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘরের দরজা ভেঙে দুই সন্তানের সামনে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তিনি অনুরোধ করেছিলেন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। কিন্তু দুই সন্তানকে এক প্রতিবেশীর কাছে রেখে তাঁকে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রায় আড়াই মাস কারাগারে বন্দী থাকার পর গত ডিসেম্বরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। এই মামলার কারণে তিনি শিক্ষকতা পেশায় ফিরতে পারছেন না।

সেই অনুষ্ঠানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের রসরাজ দাস, সুনামগঞ্জের ঝুমন দাশ, মুন্সিগঞ্জের স্কুলশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল, কুমিল্লার শিক্ষক শংকর দেবনাথ, রংপুরের টিটু রায় ও পটুয়াখালীর জয়দেব শীলও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তাঁদের কথায় আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নিষ্ঠুরতাই প্রকাশিত হয়েছে। দরিদ্র জেলে রসরাজ দাস মুঠোফোন ব্যবহার করেন না। অথচ তার নামে কে বা কারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তাঁকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। সরকার সেই দুর্বৃত্তদের ধরতে না পেরে রসরাজকে পাকড়াও করেছে। ২০১৬ সালে যখন এই ঘটনা ঘটে, তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছিল না। মামলা হয়েছিল আইসিটি আইনে। পরে আইসিটি আইনের কয়েকটি ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তাঁর বিরুদ্ধে সেই আইনে মামলা করা হয়। রসরাজকে মামলায় হাজিরা দিতে এখনো প্রতি মাসে চট্টগ্রামে যেতে হয়।

এই আলোচনা সভায় যাঁদের হাজির করা হয়, তাঁরা সবাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য। এতে জনমনে এই ধারণা হতে পারে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষই শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভুক্তভোগী। অথচ তথ্য-উপাত্ত যাচাই করলে দেখা যায়, সব সম্প্রদায়ের মানুষই এই আইনের শিকার হয়েছে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের অবমাননায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২ বছরে ২০০-র বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলার বাদীদের বড় অংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। প্রথম ১৫ মাসে গড়ে ৬০ জনের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়। পরবর্তী ৯ মাসে গড়ে মামলা হয় ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে। রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই মামলা প্রয়োগ করা হচ্ছে বেশি।

প্রধানমন্ত্রীর অবমাননার অভিযোগে এই সময়ে মামলা হয় ৯৮টি। এর মধ্যে ১৩টি মামলা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাকি ৮৫ জনের মধ্যে সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত ৫০ জন। এসব মামলায় আটক হয়েছেন ৫৮ জন। একই সময়ে মন্ত্রীদের অবমাননার অভিযোগে মামলা হয়েছে ৫১টি। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৩টি মামলা করেছে। মন্ত্রী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা করেছেন ৪টি, বাকি ৪৪টি মামলা করেছেন অন্যরা। রাজনৈতিক নেতাদের অবমাননার অভিযোগে মামলা হয়েছে ৭৫টি। সংক্ষুব্ধ রাজনীতিবিদেরা মামলা করেছেন ৪০টি। এই সময়ে ২৫৪ জন রাজনীতিবিদ ও ২০৭ জন সাংবাদিক এই মামলায় আসামি হয়েছেন। ফেসবুকে মন্তব্য করার জন্য মামলা হয়েছে ৫৬৮টি। এর মধ্যে ফেসবুকে হয়রানি ও আর্থিক জালিয়াতির জন্য মামলা হয় মাত্র ৮০টি। অন্যদিকে ৮৫টি মামলা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে এবং ৩৯৯টি মামলা ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় মামলা করা হয়।

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জানুয়ারি ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত ২৬ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া ৮৯০টি মামলা হয়। প্রথম ১৫ মাসে গড়ে ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

আরও পড়ুন

পরবর্তী ৯ মাসে গড়ে ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে। মামলার বিবাদী হলেন সাংবাদিক, শিক্ষক, এনজিও ও অধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদ, ছাত্র, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, ধর্মীয় নেতাসহ অন্য পেশাজীবীরা। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। ‘অন্তহীন দুঃস্বপ্ন-বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮’ নামের এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিঙ্গুইশড প্রফেসর ও সিজিএসের উপদেষ্টা আলী রীয়াজ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমন কিছু ধারা আছে, যা কেবল নাগরিক অধিকার খর্ব করে না, সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের সুযোগও মারাত্মকভাবে সংকুচিত করেছে। আইনটির সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো এর বেশির ভাগ ধারা অজামিনযোগ্য। অর্থাৎ, বিচার করার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া। কারাগারে থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষে মামলা মোকাবিলা করা কিংবা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা কঠিন।

কয়েক দিন আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের সঙ্গে কথা হয় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে। তাঁর বিরুদ্ধে কেবল মামলা হয়নি, বছর দুই আগে বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার পথে হাতিরপুলে তিনি অপহৃত হন। প্রায় আট মাস পর তাঁকে পাওয়া যায় বেনাপোল সীমান্তে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি বৈধ কাগজপত্র ছাড়া সীমান্তের ওপারে গিয়েছিলেন। কিন্তু শফিকুল ইসলাম জানান, তিনি কখনোই ভারতে যাননি। যাঁরা তাঁকে হাতিরপুল থেকে অপহরণ করেছিলেন, তাঁরাই আট মাস আটকে রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন। অথচ তিনি তাঁর ফেসবুকে নিজে কিছু লিখেননি। একটি স্ট্যাটাস শেয়ার করেছেন মাত্র। তবে শফিকুল মনে করেন, কেবল সংসদ সদস্য নন, এই মামলার পেছনে আরও ক্ষমতাবান ব্যক্তি আছেন। তিনি জানান, ডিজিটাল আইনে মামলা ও অপহরণের কারণে তিনি সর্বস্বান্ত। এখন সংসার চালানোর মতো টাকাপয়সাই তাঁর নেই। পত্রিকা চালাবেন কী করে?

আরও পড়ুন

সম্প্রতি উচ্চ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে আনা মামলাগুলোর কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। কিন্তু শফিকুলের দাবি, মামলা প্রত্যাহার করা হোক। তিনি কোনো অন্যায় না করেও কেন ব্যক্তিবিশেষের প্রতিহিংসার শিকার হবেন। এ রকম বহু পরিবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার হয়ে সবকিছু হারিয়েছে; যাঁদের কয়েকজন নির্মূল কমিটির আলোচনা সভায় উপস্থিত থেকে নিজেদের কষ্ট ও যন্ত্রণার কথা বলেছেন। এর বাইরেও অসংখ্য নিরীহ মানুষ এই আইনের শিকার হয়ে কাতরাচ্ছেন, যাঁদের কোনো সেমিনারে গিয়ে কথা বলারও উপায় নেই।

মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের কথায় মনে হলো, আইনটি করার উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি মানুষকে হয়রানি ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজেই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। আইনটি সংশোধন না, আমরা পুরোপুরি বাতিল দাবি করছি।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    [email protected]