তাইওয়ান চীনের কবজায় চলে যাওয়ার মানে...

স্বেচ্ছায় কিংবা খুব কম বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাইওয়ানকে চীন যদি কবজা করতে পারে, তাহলে এটা চীনকে পৃথিবীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তির তকমা পাইয়ে দেবেছবি : রয়টার্স

‘স্ট্র্যাটেজিক এমবিগিউটি’ বা কৌশলগত অস্পষ্টতা হচ্ছে তাইওয়ান প্রশ্নে আমেরিকার ঘোষিত নীতি। চীন যদি সামরিকভাবে তাইওয়ানকে দখল করে নিতে চায় (চীনের ভাষায় ‘পুনরেকত্রীকরণ’), তাহলে আমেরিকা সামরিকভাবে তাইওয়ানকে রক্ষার চেষ্টা করবে কি না, এই প্রশ্নে আমেরিকা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোনো জবাব স্পষ্টভাবে দেয় না। এটাই ‘স্ট্র্যাটেজিক এমবিগিউটি’।

আমেরিকার সব প্রেসিডেন্ট এই নীতি মেনে চললেও জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অন্তত তিনবার এই অস্পষ্টতা থেকে সরে গিয়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন, চীন তাইওয়ানে আগ্রাসন শুরু করলে আমেরিকা সামরিকভাবে সেটা প্রতিহত করবে। এর সর্বশেষটি করেছেন তিনি কিছুদিন আগেই জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরের সময়। অবশ্য এটাও এখানে যুক্ত করে রাখা দরকার, বাইডেনের বক্তব্যের পরপরই আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে আবার বলা হয়েছে, তাইওয়ান প্রশ্নে আমেরিকার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

এদিকে সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে নিরাপত্তা সম্মেলন ‘সাংগ্রি-লা ডায়ালগের’ মধ্যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন। এই বৈঠকে এবং সম্মেলনের বক্তৃতায় চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেঙ্গহি স্পষ্টভাবে খুব কঠোর ভাষা ও দেহভঙ্গিতে বলেন, তাইওয়ান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে চীন যেকোনো মূল্যে যুদ্ধ করে তাইওয়ান দখল করে নেবে। এটা অবশ্য ফেঙ্গহি পুনরুল্লেখ করেছেন মাত্র, কয়েক বছর আগেই চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং স্বয়ং একই ঘোষণা দিয়েছিলেন।

স্বেচ্ছায় কিংবা খুব কম বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাইওয়ানকে চীন যদি কবজা করতে পারে, তাহলে এটা চীনকে পৃথিবীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তির তকমা পাইয়ে দেবে। কীভাবে চীন একচ্ছত্র পরাশক্তি হবে, সেটা বোঝার জন্য বর্তমান এবং আগামী পৃথিবীর কিছু অতি গুরত্বপূর্ণ পণ্য সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যাক।

সর্বোপরি তাইওয়ানকে খুব সহজে কবজা করে ফেলতে পারা পৃথিবীর আর সব দেশের সামনে এই বার্তা স্পষ্ট করবে, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা চীনের কাছে পরাজিত হয়েছে। দুর্বল বা মাঝারি শক্তির দেশগুলোকে তখন চীনের কবজায় যেতেই হবে। চীন যদি একচেটিয়াভাবে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে, তার ফল কি আমরা বুঝি?

রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস নামের অস্ত্র

দক্ষিণ চীন সাগরের সমুদ্রসীমা আর স্থলসীমা একত্রে হিসাব করলে চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ আছে মোট ১৭টি দেশের। আছে জাপানের সঙ্গেও। জাপানের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থান মনুষ্যবসতিহীন সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের। জাপানের নিয়ন্ত্রণাধীন এসব দ্বীপের মালিকানায় অবশ্য চীনেরও জোর দাবি আছে (চীনের ভাষায় ডাউইউ দ্বীপপুঞ্জ)। জেনে রাখা ভালো, জাপানের সর্বদক্ষিণ প্রান্ত ইশিগাকি দ্বীপ থেকে এর দূরত্ব ১৭০ কিলোমিটার, আর মেইনল্যান্ড চীন থেকে এর দূরত্ব ৩৩০ কিলোমিটার। মনুষ্যবসতি না থাকলেও এই দ্বীপপুঞ্জ যে দেশের অধিকারে যাবে, সে দেশ যে সমুদ্রসীমার অধিকারী হবে, সেটা মৎস্য এবং খনিজসম্পদে খুবই সমৃদ্ধ। এটাই এই দ্বীপ নিয়ে পাল্টাপাল্টি দাবির নেপথ্যে। এ ছাড়া একেবারে তুচ্ছ, অব্যবহারযোগ্য, অপ্রয়োজনীয় ভূমিও ছেড়ে দেয় না কোনো পরাশক্তি; এতে তাদের ইগো বা অহং আহত হয়।

২০১০ সালে এই সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের জলসীমায় প্রবেশ করা চীনা মাছ ধরার জাহাজ (এগুলোতে আসলে ছদ্মবেশে চীনা মিলিশিয়া বাহিনী থাকে) আটক করে জাপানি নৌবাহিনী। এরপর চীন এমন এক পদক্ষেপ নেয়, যাতে জাপান একেবারে নত হয়ে চীনা জাহাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। চীন থেকে জাপানে রপ্তানি হতে যাওয়া এক জাহাজভর্তি ‘রেয়ার আর্থ এলিম্যান্টস’ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় চীন। এতেই জাপানকে নত হতে হয়।

রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস কী

নিওডিমিয়াম, ইউরোপিয়াম, প্রমিথিয়াম, স্ক্যান্ডিয়ামসহ মোট ১৭টি মৌলিক পদার্থকে একসঙ্গে বলে ‘রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট’। আমাদের হাতে থাকা মুঠোফোন থেকে শুরু করে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান পর্যন্ত অতি উচ্চপ্রযুক্তির সব পণ্যে এই মৌলগুলোর মধ্যে কয়েকটি কিংবা অন্তত একটি পাওয়া যাবেই। বর্তমান ও আগামী বিশ্ব এসব মৌল ছাড়া কোনোভাবেই কল্পনা করা যায় না এবং এর চাহিদা বাড়ছে অতি দ্রুত।

রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট মানে এই না যে এগুলো পৃথিবীতে খুব কম আছে। এগুলো যেসব জায়গায় পাওয়া যায়, সেখানে থাকে খুব কম ঘনত্বে। আমাদের জানা প্রথাগত খনির মতো একসঙ্গে অনেক বেশি পাওয়া যায় না। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ভারত, ভিয়েতনামসহ আরও কিছু দেশে এই মৌলগুলো পাওয়া গেলেও এর এক-তৃতীয়াংশের বেশি খনি আছে চীনে। এর চেয়েও বড় কথা খনি থেকে সংগৃহীত মৃত্তিকা থেকে মৌলগুলো নিষ্কাশনের ব্যবস্থা একচ্ছত্রভাবে চীনের হাতে।

বছর দশেক আগেও রেয়ার আর্থ এলিমেন্টসের ৯০ শতাংশের সরবরাহ ছিল চীনের হাতে
ছবি : রয়টার্স

এসব মৌল নিষ্কাশনে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোসহ পরিবেশ দূষিত হয় ভয়ংকরভাবে। তাই উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় সব রকম কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করে এসব মৌল নিষ্কাশন করতে গিয়ে ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। তাই এমনকি খনি থেকে উত্তোলিত মাটি পরিশোধনের জন্য চীনে পাঠিয়ে দেয় অনেক দেশ। এদের মধ্যে আমেরিকাও আছে। বছর দশেক আগেও রেয়ার আর্থ এলিমেন্টসের ৯০ শতাংশের সরবরাহ ছিল চীনের হাতে। জাপানের সঙ্গে সংঘাতের সময় এগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা দেখে বিভিন্ন দেশ নিজেরাই এখন এগুলো নিষ্কাশন করতে শুরু করেছে। কিন্তু এখনো এসব পণ্যের ৬০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে চীন। চীনের অর্থনৈতিক সংস্কারের জনক দেং জিয়াও পিং–এর একটি উক্তি বিখ্যাত হয়ে আছে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টসের আলোচনায়। ১৯৯২ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের আছে পেট্রোলিয়াম আর আমাদের আছে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস।’

ইলেকট্রিক গাড়ি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ মানেই চীন

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত প্রভাব মোকাবিলায় সারা পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমানোর জন্য চাপ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো, যারা মাথাপিছু অনেক বেশি কার্বন নিঃসরণ করে, তাদের ওপরই চাপ অনেক বেশি। মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে সব রকম যাতায়াতের মাধ্যমের হিস্যা ২০ শতাংশের বেশি। আর পরিবহনের মধ্যে সড়কে চলাচলকারী গাড়ির হিস্যা ৭৫ শতাংশ। যাতায়াতের অন্য মাধ্যম, যেমন জাহাজ বা উড়োজাহাজকে বিদ্যুৎচালিত করতে এখনো অনেক সময় লাগবে। তাই সড়কপথে চলা গাড়ি বিদ্যুতে চালানোকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। আমাদের মতো দেশগুলোতে অতটা না হলেও বেশি কার্বন নিঃসরণকারী শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারকে খুব অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

লোহা ও অ্যালুমিনিয়াম বাদ দিলে একটি ইলেকট্রিক গাড়িতে সনাতন গাড়ির তুলনায় পরিমাণের দিক থেকে ছয় গুণের বেশি এবং ধরনের দিক থেকে তিন গুণ বেশি খনিজ পদার্থ ব্যবহৃত হয়। এগুলো হলো কপার, ম্যাঙ্গানিজ, লিথিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট, গ্রাফাইট ও বেশ কয়েকটি রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারের শুরুর দিকে ব্যাটারির সক্ষমতা এক বড় সমস্যা ছিল, যার কারণে একবার চার্জের পর গাড়ি বেশি দূর যেতে পারত না। ক্রমান্বয়ে অনেক বেশি সক্ষমতার ব্যাটারি বিদ্যুৎচালিত গাড়িকে সনাতন গাড়ির সঙ্গে তুলনীয় করে তুলেছে। ব্যাটারির এই বিপ্লবে প্রধান উপকরণ লিথিয়াম যেমন আছে, তেমনি বিরাট ভূমিকা আছে কোবাল্টের। ব্যাটারির চার্জ ধরে রাখা আর উত্তপ্ত হয়ে যাওয়া কমাতে এটি জাদু দেখিয়েছে।

পৃথিবীর এখন পর্যন্ত প্রমাণিত কোবাল্ট মজুতের ৭০ শতাংশ আছে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে (ডিআরসি, সাবেক জায়ারে)। আর এই দেশের প্রধান ১৯টি কোবাল্ট খনির ১৫টিই চীনের নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়া এখানকার পুরো কোবাল্ট প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং ব্যবসার চাবিকাঠি চীনের হাতে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৪০ সাল নাগাদ কিছু মৌলের চাহিদা বৃদ্ধির পূর্বাভাস এ রকম—লিথিয়াম ৪২ গুণ, গ্রাফাইট ২৫ গুণ, কোবাল্ট ২১ গুণ, নিকেল ১৯ গুণ, রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস ৭ গুণ। এসব খনিজ দ্রব্য সৌরশক্তিসহ আর যেকোনো ধরনের নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান এবং এসব পণ্যের বেশির ভাগের নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। তাই এ কথা বলাই যায়, পরিস্থিতির নাটকীয় কোনো পরিবর্তন না হলে এসবের জন্য বিশ্ব পুরোপুরি নির্ভর করবে চীনের ওপর।

ভবিষ্যৎ পৃথিবীর প্রযুক্তিতে চীনের প্রভাব

ভবিষ্যৎ পৃথিবী হতে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পৃথিবী। শিল্পের নানা খাতের বিকাশের সঙ্গে বিশেষ করে জনগণকে চরম নজরদারির মাধ্যমে একটি ‘সর্বাত্মক নজরদারির রাষ্ট্র’ কায়েম করতে গিয়ে চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটাতে পেরেছে।

ভবিষ্যৎ পৃথিবী হতে যাচ্ছে ইন্টারনেট অব থিংসেরও পৃথিবী। এখন যেমন আমরা একজন ব্যক্তি আরেকজন ব্যক্তির সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত হই, খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সেটা। একটি যন্ত্র আরেকটি যন্ত্রের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করবে। এটাই ইন্টারনেট অব থিংস। এর জন্য জরুরি হবে পঞ্চম প্রজন্মের (ফাইভ–জি) ইন্টারনেট যোগাযোগ। চীনের হুয়াওয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার কোম্পানিগুলোর চেয়ে এই প্রযুক্তিতে অনেকটা এগিয়ে আছে। বিভিন্ন দেশের পঞ্চম প্রজন্মের নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে চীনের হাত ধরে। এটা ইউরোপেও হয়েছিল কিন্তু হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই পরিস্থিতি পাল্টেছে।

সামনের পৃথিবীকে একেবারে পাল্টে দেওয়া আরেক প্রযুক্তি কোয়ান্টাম কম্পিউটার গবেষণায় চীন আমেরিকার সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

চীনের হাতে কী নেই

ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য জরুরি প্রায় প্রতিটা জিনিসের ওপর চীনের নিরঙ্কুশ অথবা খুব বড় নিয়ন্ত্রণ আছে। নেই শুধু একটা জিনিস, সেমিকন্ডাক্টর চিপ। যেসব ইলেকট্রনিক পণ্যের ওপর নির্ভর করে আজকের পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর মূল ভিত্তি হচ্ছে এসব চিপ।

সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরিতে একচ্ছত্র সক্ষমতা তাইওয়ানের। সর্বোচ্চ মানের অর্থাৎ ৭ ন্যানোমিটার বা তার চেয়ে কম আর্কিটেকচারের চিপ তৈরির প্রধান মার্কেট শেয়ার আছে তাইওয়ানের দুই কোম্পানি তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) আর ইউনাইটেড মাইক্রো ইলেকট্রনিকস কোম্পানির (ইউএমসি)। চীনের কোম্পানি সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন (এসএমআইসি) চিপ উৎপাদক কোম্পানি হিসেবে পৃথিবীতে পঞ্চম হলেও সর্বোচ্চ মানের চিপ উৎপাদনের আশপাশেও নেই।

চীন বিরাট বিনিয়োগ করছে সর্বোচ্চ মানের চিপ তৈরির জন্য, কিন্তু তাইওয়ানের বর্তমান পর্যায়ে তারা পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাইওয়ান তার প্রযুক্তিকে নিশ্চয়ই এগিয়ে নেবে আরও অনেক দূর। তাই তাইওয়ানকে ধরা চীনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।

আমরা বুঝতে পারছি, নিশ্চয়ই কোনো যুদ্ধ ছাড়া তাইওয়ান যদি চীনের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হয় অথবা খুব স্বল্প শক্তি প্রয়োগে তাইওয়ানকে যদি কবজা করে ফেলতে পারে চীন, তাহলে তাইওয়ানের হাতে থাকা এই অকল্পনীয় বড় কৌশলগত পণ্যের একচ্ছত্র অধিকার চীনের হাতে চলে যাবে। চীনের দখল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে তাইওয়ান নিজের চিপ কারখানা ধ্বংস করে দিলে অবশ্য ভিন্ন কথা।

চীনের অভাব আছে আরেকটি জিনিসের, সেটি হচ্ছে ডলারকে সরিয়ে নিজের ইউয়ানকে একচ্ছত্র আন্তর্জাতিক মুদ্রায় পরিণত করতে না পারা। সেই আলোচনা এই কলামের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়।

আরও পড়ুন

‘ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন’–এ ফাটল

উত্তর-পূর্বে রাশিয়ার কামচটকা প্রণালি থেকে দক্ষিণ–পশ্চিমে মালয় প্রণালি পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরের বিরাট জলরাশির মধ্যে একটির পর একটি দ্বীপপুঞ্জ আছে। এগুলো হলো—জাপান, জাপানের রিউকু দ্বীপপুঞ্জ, তাইওয়ান, উত্তর ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও। এই দ্বীপগুলোকেই বলে ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন।

কৌশলগত দিক থেকে এই দ্বীপগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে ঢুকতে এই দ্বীপগুলো চীনের নৌবাহিনীর জন্য প্রচণ্ড বাধা সৃষ্টি করে। এই চেইনের একেবারে মধ্যভাগে অবস্থিত তাইওয়ান চীনের হস্তগত হওয়া মানে প্রশান্ত মহাসাগর চীনের কাছে একেবারে নির্বিঘ্নে উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া। এটাও আরেক অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বিজয় হবে চীনের।

সর্বোপরি তাইওয়ানকে খুব সহজে কবজা করে ফেলতে পারা পৃথিবীর আর সব দেশের সামনে এই বার্তা স্পষ্ট করবে, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা চীনের কাছে পরাজিত হয়েছে। দুর্বল বা মাঝারি শক্তির দেশগুলোকে তখন চীনের কবজায় যেতেই হবে। চীন যদি একচেটিয়াভাবে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে, তার ফল কি আমরা বুঝি?

ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষক