
আলবদর বাহিনীর প্রধান ও পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির (প্রেসিডেন্ট বা প্রধান) মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া দেখে বিস্মিত না হলেও বড় দুঃখ পেয়েছি। কারণ, দেশটির এত বছরেও বোধোদয় হলো না। পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি ঘোর প্রতিক্রিয়াশীল হলেও দেশটির জনগণের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ মনোভাব নেই। জনগণের চেতনার স্তর এখনো বেশ নিচু রয়ে গেছে বলেই সে দেশে চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল এবং সেনাবাহিনী রাজত্ব করে চলেছে। এখন সে দেশে সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকলেও আসলে পেছন থেকে সেনা আমলাতন্ত্র ক্ষমতার চাবিকাঠি ধরে রেখেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি তৈরির মূলে যে প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শ কাজ করছিল, তার থেকে এখনো দেশটি বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাই সেই দেশের জনগণের জন্য বড় দুঃখ হয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে বাংলাদেশের জনগণের কাছে পরাজিত হয়েছিল, সেই স্মৃতি বোধ হয় এখনো তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। তারা যে ধরনের বর্বর আচরণ, গণহত্যা ও গণধর্ষণ করছিল, সে জন্য কোনো অপরাধবোধ তৈরি হয়নি। এমন কাজটি করেছিল তাদের পূর্বসূরিরা। অথচ বর্তমানের শাসকবর্গ ও সেনাবাহিনী কেন সেটা স্বীকার করে না, সেটা আমার কাছে কিছুটা বিস্ময়ের মনে হয়। তার মানে চার দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও দেশটির শাসক ও সেনাবাহিনীর চরিত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে ধরনের গণহত্যা ও গণধর্ষণ করেছিল, তার সঙ্গে হিটলার, মুসোলিনি, নাদির শাহর তুলনা চলে। এমনকি হিটলার মুসোলিনির চেয়েও অধিক বর্বর ও নিষ্ঠুর ছিলেন বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সেটা কখনোই মেনে নিতে চায় না। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সেই দেশের মিডিয়া ও সুশীল সমাজেরও বক্তব্য ও আচরণ একই রকম। অন্যথায় আমরা আমাদের দেশে যুদ্ধাপরাধের জন্য যে বিচার করছি, সে ব্যাপারে তাদের এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে কেন?
মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তানের সরকার, মিডিয়া ও পার্লামেন্ট যে ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তা প্রমাণ করে যে সাড়ে চার দশক অতিক্রান্ত হলেও ওদের পরিবর্তন হয়নি। যেমন ছিল, তেমনি রয়ে গেছে। পাকিস্তানের পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে নিজামীর জন্য সমবেদনা জানিয়েছে এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাকিস্তান সরকার অবশ্য কাদের মোল্লা থেকে শুরু করে প্রতিটি দণ্ডাদেশের ক্ষেত্রেই একই ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এসেছে, যা তারা নৈতিকভাবে ও কূটনৈতিকভাবেও করতে পারে না। কূটনৈতিকভাবে পারে না, কারণ এটি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, যেখানে নাক গলানোর অধিকার তাদের নেই। নৈতিকভাবে পারে না। কারণ, ১৯৭১ সালে তাদের পূর্বসূরিরা যে ঘৃণ্যতম অপরাধ করেছিল, সেটাকে একভাবে অনুমোদন দেওয়া হবে, যা যেকোনো বিবেচনায় অনৈতিক বলেই গণ্য করা হবে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করছে যে নিজামীর বিচার নাকি ছিল ত্রুটিপূর্ণ এবং তা নাকি বিরোধীদের দমন করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে। কোনো কোনো বিদেশি রাষ্ট্র এবং বিদেশি সংস্থা ও মিডিয়াও একই অভিযোগ করে আসছে। পাকিস্তানের মন্ত্রণালয় বলছে যে নিজামীর অপরাধ ছিল তিনি ‘পাকিস্তানের সংবিধান সমুন্নত রাখতে চেয়েছেন।’ হ্যাঁ, আমরাও তা-ই বলি। (অবশ্য অপরাধ আরও বেশি, গণহত্যায় অংশ নেওয়া ইত্যাদি)।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পর থেকে, পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থাৎ বাংলাদেশকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করা নিশ্চিতভাবেই অপরাধ। তাকে আমাদের বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেশদ্রোহিতা বলতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর (যদিও প্রবাসী সরকার) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে দখলদার ও শত্রু বলে গণ্য করতে হবে। তখন যারাই পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে, তারাই বাংলাদেশের শত্রু। দেশের শত্রু। সেই জন্য নিজামী প্রমুখের বিচার করলেও আপত্তির কিছু ছিল না। কিন্তু নিজামীদের বিচার সে কারণে হচ্ছে না। নানা বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু সেদিন পাকিস্তানের পক্ষে দালালি করার জন্য যে অপরাধ, সেই অপরাধের বিচার অগ্রসর না করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। বিপ্লবে বিজয়ী হওয়ার পর ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারও মার্কিনের দালালদের বিচার করেনি।
কিন্তু যারা গণহত্যা, ধর্ষণ এই ধরনের অপরাধ করেছে বা এই জঘন্য কাজে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছে, তাদের বিচার হবে। হত্যাকারী, ধর্ষণকারীদের ক্ষমা করার কোনো অধিকার কোনো সরকারেরই থাকতে পারে না। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও সেই ধরনের অপরাধের জন্য কয়েক হাজার বন্দী কারাগারে ছিল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সেই অশুভ শক্তির সঙ্গে আপস করার উদ্দেশ্যে তাঁদের সবাইকে মুক্তিদান করেছিলেন। এখন শেখ হাসিনার সরকার যে বিচারের ব্যবস্থা করেছে, তা পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মতো রাজনৈতিক অপরাধের বিচার নয়। এটা হচ্ছে খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি ধরনের কাজে লিপ্ত থাকা অথবা সহযোগিতা করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধের বিচার না করাটাই তো যেকোনো সরকারের জন্য অপরাধের বিষয়। দুঃখজনক যে সেই কাঙ্ক্ষিত বিচার শুরু হলো কত বছর পর।
আমি ধন্যবাদ জানাই শেখ হাসিনাকে, অনেক বিলম্বে হলেও তিনি মানবতার বিরুদ্ধে এই অপরাধের বিচার শুরু করেছেন এবং বিচার–প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কয়েকজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। আমার ধারণা, অন্য কেউ সরকারপ্রধান হলে সম্ভবত এই বিচারকার্য সম্পন্ন, এমনকি শুরুই করা যেত না। কারণ, দেশি ও বিদেশি চাপ ছিল প্রবল।
শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে সেই চাপকে উপেক্ষা করে দৃঢ় থাকা। অন্যদিকে বিএনপি এই প্রশ্নে কার্যত বিচার–প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ছিল। বিএনপি এবারও নিজামীর মৃত্যুদণ্ডে অর্থপূর্ণ নীরবতা পালন করেছে। অবশ্য স্বদলীয় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বেলায় প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তারা দাবি করে, বিচার হতে হবে স্বচ্ছ, আইনানুগ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এমন কথার অর্থ হলো বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। জোটসঙ্গী জামায়াতের স্বার্থেই তাদের এ কথা বলতে হয়েছে। বিচারের স্বচ্ছতা ইত্যাদি প্রশ্নে পাশ্চাত্যের কোনো কোনো মহলও আপত্তি জানিয়ে এসেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একই কথা বলল।
বস্তুত, এর চেয়ে স্বচ্ছ, আইনানুগ এবং আসামিদের প্রতি এতটা উদার কোনো আন্তর্জাতিক বিচার কখনোই হয়নি। নু্যরেমবার্গ ট্রায়াল, টোকিও ট্রায়াল বা সম্প্রতি হেগে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের বিচার যা হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছ ছিল আমাদের এই বিচার–প্রক্রিয়া। টোকিও ট্রায়ালে ৯০০ ব্যক্তিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। জাপানের প্রধানমন্ত্রীও অন্তর্ভুক্ত। বিচারের অন্যতম জুরি বিচারপতি রাধা বিনোদপাল (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিনি বাঙালি) এভাবে মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরোধিতা করে ভিন্ন রায় দিয়েছিলেন এবং তিনি বিচার–প্রক্রিয়াকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। মার্কিন ও ইংরেজরা সে কথায় সামান্যতম মূল্য দেয়নি। আজকাল বলা হয়, ইংল্যান্ডে মৃত্যুদণ্ড নেই। কেউ কেউ মৃত্যুদণ্ডাদেশ উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। সেই প্রশ্ন স্বতন্ত্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এখনো প্রাণদণ্ড কার্যকর হয়। আর যে ইংরেজ এখন প্রাণদণ্ডের বিরুদ্ধে, তারা যে আমাদের দেশে কত দেশপ্রেমিক যুবককে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল, সে জন্য কি আত্মসমালোচনা করেছে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে যে অপরাধ করেছে তার জন্য আজও ক্ষমা চায়নি। ব্রিটেন ভারতবর্ষে ২০০ বছর ধরে যে হত্যা ও নির্যাতন চালিয়েছিল, সে জন্যও তাদের কোনো অনুশোচনা দেখা যায় না। অতএব তাদের কথা দ্বারা আমাদের প্রভাবিত হওয়ার কারণ নেই। তবে অন্য রকম উদাহরণও আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের জনগণের ওপর নানা ধরনের অপরাধের জন্য জাপান চীনের জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। একদা চীনের দখলে ছিল ভিয়েতনাম। সে জন্য চীন ভিয়েতনামের কাছে ক্ষমা চেয়েছে।
পাকিস্তান সরকার প্রায়ই ১৯৭৪ সালের দিল্লি সম্মেলনের কথা তোলে। কী ছিল সেই দিল্লি সম্মেলনে? ১৯৭৪ সালের ৫ থেকে ৯ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের যে সম্মেলন হয়, সেটাকেই বলা হচ্ছে দিল্লি সম্মেলন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরণ সিং ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমদ নিজ নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এর আগে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং একই সঙ্গে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতিও প্রদান করে।
এরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোও ঢাকায় এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু খুব সম্ভবত নতুন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তাই দেখি দিল্লি সম্মেলনের ঘোষণায় (৯ এপ্রিল) বঙ্গবন্ধুর বরাত দিয়ে ‘ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ’ কথাটি যুক্ত হয়েছিল। ড. কামাল হোসেন এতে স্বাক্ষর করেছিলেন। একই সঙ্গে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্যকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তান কথা দিয়েছিল তারা নিজ দেশে (অর্থাৎ পাকিস্তানে) বিচার করবে। কিন্তু সেই বিচার তারা আর করেনি। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বাংলাদেশ তার নিজ দেশের নাগরিকদের বিচার করবে না, এমন কথা কখনো দেয়নি। দিতে পারেও না। পাকিস্তান দিল্লি সম্মেলনের ভুল ব্যাখ্যা করছে। বরং তারাই ১৯৫ জন সেনাসদস্যের বিচার না করে দিল্লি ঘোষণার বরখেলাপ করছে।
আমরা আশা করেছিলাম পাকিস্তানের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরির অপরাধ সম্পর্কে সোচ্চার হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
যুদ্ধাপরাধের বিচার–প্রক্রিয়ায় আরও একটি জিনিস বেরিয়ে এসেছে যে দল হিসেবেও জামায়াত অপরাধী। অতএব জামায়াতকেও নিষিদ্ধ করা জরুরি। তবে আমি অন্য কথা বলব। ১৯৭২ সালের সংবিধানে সব ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানকে পুনর্জীবিত করলে জামায়াত, মুসলিম লীগ—সবই আবার নিষিদ্ধ হবে। নতুন করে, নতুন নামেও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল থাকবে না। জামায়াতও থাকবে না। এবং সেটাই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সবচেয়ে সংগতিপূর্ণ পদক্ষেপ।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।