নির্বাচন ও তরুণ ভোটারদের ভূমিকা

নির্বাচন গণতন্ত্রের একমাত্র উপাদান না হলেও নির্বাচনই গণতন্ত্রের ভিত রচনা করে। নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের যাত্রাই হয় না। কারণ, গণতন্ত্রের মূল হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ। জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত হন তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে থাকেন এবং দেশের ভোটাররাই এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কাজেই যেকোনো নির্বাচন, বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপকসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিই কাম্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।
বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে গণতন্ত্র এখনো উন্নত দেশের গণতন্ত্রের মতো শক্ত ভিত পায়নি, সেখানে গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করতে হলে ধারাবাহিকভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যকীয়। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন তখনই সম্ভব, যখন ভোটারদের উপস্থিতি ও তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত হয়। যদিও সুষ্ঠুভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব প্রধানত নির্বাচন কমিশনের, তবে সরকারের সহযোগিতা অবশ্যই হতে হবে ইতিবাচক। সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা শুধু পরিবেশ তৈরির দায়িত্বে থাকা সংস্থার ওপরই সীমাবদ্ধ নয়, ভোটারদের দায়িত্বও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের সময় ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি সুষ্ঠু ভোটের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ব্যাপক হারে ভোটার উপস্থিতি শুধু পরিবেশই নয়, জাল ভোট প্রদানের প্রবণতাকেও ঠেকাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
যেকোনো নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের উপস্থিতি অন্য ভোটারদেরও উৎসাহ জোগায়। তরুণ ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি অন্য ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা পালন করে; বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, যেখানে মোট ভোটার সংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশই তরুণ ভোটার। যদিও তরুণ ভোটারের কোনো সংজ্ঞা নেই, তবে ১৮ থেকে ৩৯ বছর বয়সের ভোটারদেরই তরুণ ভোটার বলে বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশ সংজ্ঞায়িত করে থাকে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে ধারণা করা হয় যে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি ভোটারের মধ্যে ৬০ শতাংশ তরুণের সংজ্ঞায় পড়ে। বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক একজন ব্যক্তিকে ভোটার হতে হলে ন্যূনপক্ষে ১৮ বছরের হতে হয়; অবশ্য বিশ্বের অনেক দেশে ১৬ ও ১৭ বছর ন্যূনতম বয়স ধার্য করা আছে।
আগেই আলোচনা হয়েছে যে একটি দেশের
প্রায় ৬০ শতাংশ তরুণ ভোটার হলে তাঁদের সরব উপস্থিতি ও ভোট প্রদান একটি অর্থবহ ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এসব তরুণ ভোটারই পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। কাজেই তরুণ ভোটারদের ভোট প্রদানে যেমন উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন, তেমনি তাঁদের ব্যাপক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নির্বাচনী পরিবেশকে আরও উন্নত করার প্রয়োজন রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭০ শতাংশ
জনগোষ্ঠী ১৫ থেকে ৩৯-এর কোঠায় এবং প্রায় ৬০ শতাংশের ঊর্ধ্বে তরুণ ভোটার এবং যাঁদের মধ্যে প্রথমবারের ভোটার ৫০ থেকে ৬০ লাখ। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীদের প্রাধান্যই বেশি এবং এরই প্রতিফলন রয়েছে ভোটার তালিকায়; যেখানে নারী ভোটারদের আধিক্য বেশি।
বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে সার্ক (SAARC) দেশগুলোয় তরুণ ভোটারদের ভোট প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে একটি বিশেষ দিনকে ‘ভোটার ডে’ হিসেবে পালন করা হয়। যেমন ভারতে ২৫ জানুয়ারি। নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে দেশব্যাপী নানা উদ্যোগ নেওয়া হয় দিনটি উদ্‌যাপন করতে। বাংলাদেশেও বর্তমান সরকার তরুণ ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে ১ মার্চকে জাতীয় ভোটার দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করার ব্যাপারে গত এপ্রিল মাসে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজেই নির্বাচন কমিশনকে পরিকল্পনা নিতে হবে কোন পদ্ধতিতে দিনটি উদ্‌যাপন করবে। ভোটার দিবস উদ্‌যাপনের সরকারি সিদ্ধান্তটি ভোটারদের দায়িত্বসচেতন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করি।
বিশ্বের বহু দেশে, যেমন অস্ট্রেলিয়ায় ভোট প্রদান বাধ্যতামূলক; যা এই অঞ্চলের কোনো দেশেই নেই। বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে ভোট প্রদান ঐচ্ছিক বিষয়। কাজেই ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে যেমন বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, তেমনি তরুণ ভোটারদের বুঝতে হবে যে এ দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে আরও গ্রহণযোগ্য করতে হলে তাঁদের ভোট প্রদান অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণে তরুণ ভোটারদের ভোট দেওয়ার বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয়। এক. তরুণদের উপলব্ধি করতে হবে যে তাঁরা দেশের রাজনীতির অত্যন্ত শক্তিশালী উপাদান—যেকোনো রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে তাঁদের দায়িত্ব রয়েছে। দুই. মনে রাখতে হবে, প্রতিটি ভোট হিসাবে নিয়ে জয়-পরাজয় নিশ্চিত করে। তিন. ভোট প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় তাঁদের অংশগ্রহণ হয় এবং সরকার ও সাংসদদের সঙ্গে একাত্মতা থাকে। চার. তরুণ ভোটাররা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে আসা, তাই দেশের রাজনীতিতে একটি স্বচ্ছ পরিবেশ তৈরিতে সরকারকে বাধ্য করা যায়। পাঁচ. ভোট প্রদানের মাধ্যমে দেশের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ছয়. ভোটারদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষিত, তাঁদের অনেকে সরাসরি রাজনীতিতে এলে গুণগত মানের পরিবর্তন হবেই। সাত. এখন ভোট না দিলে আগামী পাঁচ বছর তাঁরা আর ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন না এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তাতে তঁাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আট. ভোট প্রদানের মাধ্যমে সরাসরি রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশের পথ পরিষ্কার হতে পারে। সংসদে তরুণদের উপস্থিতি পুরোনো ধ্যানধারণায় পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখতে পারে।
তরুণদের ভোট প্রদানের অনীহার কারণেও রাজনীতিতে নতুন মুখ দৃশ্যমান হচ্ছে না। অনেক দেশে ভোট প্রদানের বয়সেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ থাকার কারণে সংসদে অনেক তরুণ রাজনীতিবিদের সংযোজন হচ্ছে। আমাদের দেশের সংবিধানের ৬৬(১)তে সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে ২৫ বছর বয়সের উল্লেখ রয়েছে; তাতে তরুণদের অংশগ্রহণ অনেকটা সীমিত করে। সংসদে তরুণ মুখের সমাবেশ ঘটাতে হলে এই বয়স কমিয়ে
আনার চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। তরুণেরা রাজনীতিতে যোগদান করলে তরুণ ভোটাররা উজ্জীবিত হবেন। প্রার্থী হওয়ার বয়সসীমা ২৫ থেকে নামিয়ে ২১ করা যায় কি না, সে বিষয় নিয়ে
আলোচনা হতে পারে।
যা হোক, তরুণ ভোটারদের ভোটদানে উৎসাহ প্রদান শুধু নির্বাচন কমিশনের হাতে ছেড়ে দিলে হবে না; বরং রাজনৈতিক দলগুলোও দেশের তরুণদের উৎসাহ প্রদানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের তরুণদের বর্তমান ও আগামীর চাহিদার দিকে বিশেষ নজর
দিতে হবে।
ইদানীং বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে সাধারণ আলোচনায় মনে হয়েছে যে তরুণেরা ক্রমেই একদিকে যেমন ভোট প্রদানে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন, তেমনি দেশের রাজনীতির বিষয়ে বেশ উদাসীন। এমনটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক নয়। এ ধরনের মনোভাব সাধারণত শহুরে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে দৃশ্যমান। ‘না ভোটের’ উদ্দেশ্যই ছিল সব ভোটারকে; বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের তাঁদের মৌলিক অধিকারকে নিশ্চিত করার প্রয়াসে একটি ‘অপশন’ দেওয়া। অনেক শিক্ষিত তরুণ ভোটার মনে করেন, যেহেতু পার্টির নমিনেশন দলের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তেই হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে অনেক প্রার্থীই তরুণ ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্য হন না এবং সাধারণ ভোটার হিসেবে প্রার্থী নির্বাচনে তাঁরা কোনো ভূমিকা রাখেন না।
একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে অনেক ভোটার, বিশেষ করে তরুণেরা ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হন, কারণ মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে তাঁদের আদর্শিক ব্যক্তি খুঁজে পান না। তাঁরা মনে করেন, প্রার্থীদের চাপিয়ে দেওয়া হয়। তরুণ ভোটাররা প্রার্থীদের মধ্যে ন্যূনতম আদর্শ খোঁজেন। কাজেই রাজনৈতিক দলের প্রার্থী বাছাই তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। তরুণদের আকৃষ্ট করতে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজটি ভোটের মাধ্যমে করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে, তরুণ ভোটারদের ভোট প্রদানে উৎসাহিত এবং নিরাপত্তা ও পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব সরকার এবং কমিশন ছাড়াও গোটা সমাজের।

এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক
hhintlbd@yahoo.com