নেইমারের কান্না, মেসির কান্না

আজ নেইমারকে কাঁদতে দেখা গেল। আশি হাজার দর্শক দেখলেন গ্যালারিতে, কোটি চোখ টেলিভিশনের পর্দায়। টাইব্রেকার। জার্মানি আগে শুট করছে। ব্রাজিল পরে। ৪-৪ হয়ে গেল। জার্মানির পঞ্চম শটটা ব্রাজিলের গোলরক্ষক ঠেকিয়ে দিলেন। এবার ব্রাজিলের পক্ষ থেকে শুট করতে এগিয়ে গেলেন নেইমার। অধিনায়ক। এই বলটা জালে জড়াতে পারলেই ব্রাজিল ফুটবলে সোনা জিতবে। ইতিহাসে প্রথম। যা পারেননি রোনালদো, রোনালদিনহো, রোমারিও। নেইমার কি তা পারবেন? শট নিতে ছুটে গিয়ে থামলেন। জার্মানির গোলরক্ষক অবিচলিত। নেইমার মারলেন। বল স্পর্শ করল জাল। নেইমার মাটিতে শুয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। বসে পড়ে কাঁদলেন। উঠে দাঁড়িয়ে কাঁদলেন। তাঁর কান্না আর থামে না।

এর আগে, মাত্র কিছুদিন আগে কোপা আমেরিকার ফাইনালে আমরা মেসিকে কাঁদতে দেখেছি। মেসি কেঁদেছিলেন পেনাল্টি মিস করে। ফাইনালে হেরে গিয়ে।
ব্রাজিলিয়ানরা কান্নায় ওস্তাদ। লিখেছেন উৎপল শুভ্র। ২১ আগস্ট প্রথম আলোয়। গত বিশ্বকাপে ব্রাজিলের অধিনায়ক থিয়েগো সিলভা কাঁদতেন জাতীয় সংগীত বাজার সময়। পরে সমালোচনা হয়েছিল, যে অধিনায়ক খেলা শুরুর আগেই কাঁদে, তাঁর দল কি আর ম্যাচ জিততে পারে!

বিশ্বকাপের ওই খেলায় তো নেইমার ছিলেন না। আগের ম্যাচে কোমর ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। তবু নেইমার ছিলেন গ্যালারিজুড়ে। নেইমারের মুখের ছবির কাটআউট ছিল সবার হাতে হাতে। ওই ভুতুড়ে খেলার হাজারো ব্যাখ্যা আছে। একটা ব্যাখ্যা হলো, নেইমারের না থাকাটাই ভূতের আছর হয়ে চেপে বসেছিল ব্রাজিলিয়ানদের ওপরে।


নেইমার ব্রাজিল ফুটবলের পোস্টার বালক। নেইমার মেসি নন, নেইমার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নন। কিন্তু নেইমার নেইমার। নেইমারের যে জিনিসটা সবচেয়ে ভালো লাগার মতো, তা হলো তাঁর দুষ্টুমি। গত বিশ্বকাপ দেখতে ব্রাজিল গিয়েছিলাম। মাঠে খেলা দেখার একটাই বাড়তি লাভ, খেলোয়াড়েরা খেলা শুরুর ঘণ্টা আধেক আগে নেমে ওয়ার্মআপ করেন। সেইটা কাছ থেকে দেখা যায়। ব্রাজিল একটা খেলার আগে এই রকম নেমেছে। নেমেছেন নেইমারও। উৎপল শুভ্র আমাকে ফোন করলেন। তিনি সাংবাদিক গ্যালারিতে। আমি অসাংবাদিক গ্যালারিতে। বললেন, নেইমারের কাণ্ড দেখো। কাণ্ড মানে কাণ্ডকারখানা। শুধুই দুষ্টুমি করছেন। খেলা যেন তাঁর কাছে এক অপার আনন্দের বিষয়। খেলা যেন তাঁর কাছে একটা ভীষণ আমুদে ব্যাপার। এর পিঠে বল মারছেন, ওকে পেছন থেকে টোকা দিচ্ছেন, হাসছেন, গড়িয়ে পড়ছেন। ফেসবুকে আমি নেইমারের ফলোয়ার। যা পোস্ট তিনি দেন, তার মধ্যে নিছক দুষ্টুমি থাকে অনেকগুলো। চোখ টিপছেন, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন, এই সব।


ড. মযহারুল ইসলাম একবার একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘কবিতায় দুষ্টুমি’। সুনীলের কবিতায় যে দুষ্টুমি থাকে, সেটাও যে মূল্যবান, তা ছিল সেই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য। আমি নেইমারের কাণ্ডকীর্তি দেখি। আর ভাবি, তাঁকে নিয়েও প্রবন্ধ লেখা যায়—ফুটবলে দুষ্টুমি। এই দুষ্টুমি কিন্তু ইতিবাচক অর্থে। নেইমারই তাই বলতে পারেন, বার্সেলোনায় আমরা নামি মেসির জন্য। মেসি খেলতে নামেন, বাকিরা তাঁর সঙ্গী হন।


নেইমারের এই মজার দুষ্টুমি তাঁর খেলাটাকে দর্শকদের জন্যও মজার করে তোলে। দক্ষতা বা স্কিল যে তাঁর আছে, সেটা সবাই জানে। বল নিয়ে তিনিও সার্কাস করতে জানেন। একবার যে পেছনের বল দু’পা দিয়ে তুলে সামনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা ভীষণ সমালোচিত হয়েছিল, কারণ এটা নাকি প্রতিপক্ষকে তাচ্ছিল্য করার ইঙ্গিত।
নেইমার কিন্তু ফ্রি কিকে গোল দেওয়ার ব্যাপারে আরেকটা কিংবদন্তি হয়ে যাচ্ছেন। বেন্ড ইট লাইক বেকহাম—প্রবাদ আছে। মেসি পারেন, ক্রিস্টিয়ানো পারেন, রবার্তো কার্লোস পারতেন। এটা নেইমারও পারেন। বাতাসে বাঁক খেয়ে বল গোলে ঢুকে যায়, এবারের অলিম্পিকেই তিনি সেটা করে দেখিয়েছেন। তবে ২০ আগস্ট ২০১৬ রিও অলিম্পিকে ফুটবলের ফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে নেইমার ফ্রি কিকে যে গোলটা করলেন, সেটা থেকে প্রবাদ হতে পারে, নেইল ইট লাইক নেইমার। রংধনুর মতো বল উঠে গেল, গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে বারে পড়ে ঢুকে গেল জালে। দুষ্টু ছেলেটা আরেকটা দুষ্টুমি করল। অমন যে নেইমার, তিনি জার্মানির গোলে টাইব্রেকারের পঞ্চম বলটি পাঠিয়ে, দেশের জন্য সোনা জিতে নিয়ে ছেলেমানুষের মতো হাউমাউ করে কাঁদলেন।


মেসিও কেঁদেছিলেন। সেও দেশের জন্যই। নেইমারও কাঁদলেন। সেও দেশের জন্যই। একজন অল্পের জন্য না পেরে, আরেকজন অধিনায়ক হিসেবে নিজের পায়ে জয় ছিনিয়ে এনে।


চোখের জল মূল্যবান। মেসি পেনাল্টি মিস করে প্রমাণ করেছিলেন, তিনিও এই মর্ত্যেরই মানুষ। নেইমার কেঁদে বোঝালেন, সাফল্য তাঁকে আমাদের মতোই স্পর্শ করে। আর সেই ভূতের আছরটাও নামল। সেই যে তার অনুপস্থিতি যা চাপিয়ে দিয়েছিল জার্মানির সঙ্গে খেলার দিন, ব্রাজিল বিশ্বকাপে।


নেইমার বলছেন, তিনি আর জাতীয় দলের অধিনায়ক থাকতে চান না। প্রজাপতির মতো নির্ভার মাঠজুড়ে উড়ে বেড়ানো ছেলেটির জন্য বোধ হয় সেটাই ভালো। তাঁকে দেখলে মনে হয় না, দায়িত্ব কথাটা তাঁর সঙ্গে যায়। বরং মনে হয়, তিনি শিল্পী, তাঁর কাজ আনন্দ দেওয়া। আনন্দের জন্য খেলা। খেলার মূল উদ্দেশ্য তো তাই ছিল।


এমন একজন দুষ্টু-মিষ্টি-আমুদে শিল্পী ফুটবলারকে ভালো না বেসে পারা যায়!