পরিবহননেতা-মালিকদের কেন এই ‘উপহার’?

অঘোষিত ধর্মঘটে জিম্মি হওয়ায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানানোর সুযোগও থাকে না মানুষের
ছবি: প্রথম আলো

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স নিয়ে সবাই যখন ক্ষুব্ধ, বিমর্ষ এবং নানা সমালোচনায় মুখর, তেমন মুহূর্তে এমন এক ‘গেম’-এ জনগণ কুপোকাত, যার হিসাব বুঝতেই এখনো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে অনেকের। সরকার রাতারাতি ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে ফেলল। সেটাকে ঢাল করে পরিবহননেতা–মালিকেরা তিন দিনের অঘোষিত ধর্মঘটে বাসভাড়াও বাড়িয়ে নিল ২৭–২৮ শতাংশ। এর ফলে দুই পক্ষই ‘উইন-উইন’ থাকল। আর দর্শক হিসেবে হতবুদ্ধ হয়ে থাকল জনগণ।

এমন গেমকে ‘পাতানো খেলা’ বলে আখ্যায়িত করাই যায়। বিএনপিও তেমনটি মন্তব্য করেছে। তবে খেলা শেষে। বিষয়টা বুঝতে তাদের দেরি হয়ে গেছে বলতে গেলে। পরিবহনমালিকদের ‘স্নেহ-উপহার এনে দিতে চাই, কী যে দেব তাই ভাবনা’–ই করছিল সরকার। এর জন্য একটা যথাযথ ‘চাল’ দরকার ছিল, মূলত সেটিই দেখলাম আমরা।

সরকার ও পরিবহনমালিকেরা একযোগে যে ‘গেম’ খেলল, এককথায় নজিরবিহীন। কিন্তু কেন এর দরকার ছিল, সেটি জানার আগে যে প্রশ্নটা সামনে আসে—হঠাৎ কেন জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিল সরকার? এভাবে জ্বালানি তেলের দর বাড়ানোর ইতিহাস আমরা দেখি না। এর মধ্যে গত সাত বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জ্বালানি তেল আমদানি করে ৪৩ হাজার কোটির বেশি টাকা লাভ করেছে। এ সাত বছরে বেশির ভাগ সময় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমই ছিল। এমনকি গত বছর একবার তা শূন্যেও নেমে এসেছিল। ফলে সরকার জনগণের কাছে তেল বিক্রি করে ‘লাভের মধু’ খেয়েছে বলা যায়। এরপরও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়নি। এ নিয়ে নানা সমালোচনার মুখে পড়লে ২০১৬ সালে সামান্য দাম কমিয়ে জনগণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল সরকার। যেমন ডিজেল ও কেরোসিনে দাম কমেছিল লিটারে মাত্র ৩ টাকা।

এই দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় লোকসান ও ভারতে পাচার রোধ। তেল পাচারের দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেয়ে বালখিল্য আর কিছু হতে পারে না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে বিপিসি গত পাঁচ মাসে লোকসান করেছে ১ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। মানে প্রতি মাসে গড়ে ২২৯ কোটি টাকা লোকসান। এখন আগে লাভ করা ৪৩ হাজার কোটি হিসাব করলে সেই টাকা দিয়ে অন্তত এক যুগ লোকসান পুষিয়ে নেওয়া যাবে। ফলে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কোনো প্রয়োজনই পড়ে না। তবে আমরা জানতে পারছি, বিপিসির তহবিল থেকে লাভের বিপুল অর্থ সরকার নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এ টাকা তো জনগণেরই টাকা। করোনাকালীন জনজীবনের এমন বিপর্যস্ততার মধ্যে সরকার কেন বিপিসিকে সেই টাকা ফেরত দিতে পারবে না কিংবা আপাত-পরিস্থিতি সামাল দিতে এ খাতে ভর্তুকি দিতে পারবে না? মহামারির এমন কঠিন মুহূর্তে সেটিই যদি না পারে, তাহলে সরকারের মন্ত্রীরা কয় দিন পরপর ‘উপচে পড়া রেমিট্যান্সের’ গপ্পো কেন শোনান?

এছাড়াও জ্বালানি তেল আমদানিতে বিভিন্ন ধরনের কর-শুল্ক কমিয়েও দাম সমন্বয় করতে পারত। চিন্তা করেন, তেলের আমদানি মূল্যের প্রায় ৩৪ শতাংশের সমপরিমাণই চলে যায় এই কর–শুল্কে। এক লিটার ডিজেল আমদানিতে সেটি হচ্ছে ১৯ টাকার মতো। সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে সেসব তুলে নিলেও তো জনগণের মাথার ওপর এত বড় বাড়ি পড়ে না, যে বাড়ির ক্ষত তাকে আজীবন বইতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের অভিজ্ঞতাকেও আমরা কাজে লাগাতে পারতাম।

বিপিসির তহবিল থেকে লাভের বিপুল অর্থ সরকার নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এ টাকা তো জনগণেরই টাকা। করোনাকালীন জনজীবনের এমন বিপর্যস্ততার মধ্যে সরকার কেন বিপিসিকে সেই টাকা ফেরত দিতে পারবে না কিংবা আপাত-পরিস্থিতি সামাল দিতে এ খাতে ভর্তুকি দিতে পারবে না? মহামারির এমন কঠিন মুহূর্তে সেটিই যদি না পারে, তাহলে সরকারের মন্ত্রীরা কয় দিন পরপর ‘উপচে পড়া রেমিট্যান্সের’ গপ্পো কেন শোনান?

বিপিসির কর্মকর্তারাই বলছেন, দাম না বাড়ালেও বছর শেষে বিপিসির লোকসান কিছুতেই আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি হতো না। এ পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিয়ে বা কর ছাড় দিয়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এড়ানোর সুযোগ ছিল। সরকার চাইলেই সেটি পারত।

মোটকথা, জ্বালানির দাম না বাড়ানোর কম উপায় ছিল না। একেবারেই অপারগ হলে একলাফে নজিরবিহীনভাবে এত দাম বাড়ানোরও দরকার ছিল না। কেন সেটি হলো না? তাহলে তো এ ‘পাতানো খেলাটা’ হতো না। জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে সামনের দিনগুলোতে জনগণ যে বড় ‘গ্যাঁড়াকলে’ পড়তে যাচ্ছে, সেটি যেমন তাদের বুঝতে দেওয়া যাবে না, আবার অন্য দিকে ঠিকঠাকভাবে পরিবহনমালিকদেরও ‘পাওনা’ বুঝিয়ে দিতে হবে ঠিকঠাক। এর জন্য দরকার ছিল অঘোষিত এই ধর্মঘটের। জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাবে, নিত্যপণ্যের দামও আরেক দফা বাড়বে, সামনে বোরো চাষের খরচ বেড়ে যাবে। একটার ধাক্কায় আরেকটা ধাক্কা খেতে খেতে দিন শেষে বেড়ে যাবে ঘরভাড়া পর্যন্ত।

সেসব ভাবনায় আসার আগেই গোটা দেশকে ধর্মঘটের নামে অচল করে দেওয়া হলো। এমন জুলুমের কারাগারে মানুষকে ফেলে দেওয়া হলো, সেখান থেকে বের হতে হাঁসফাঁস করতে করতে তখন বলতে লাগল—‘ভাড়া যত ইচ্ছা বাড়াও, আল্লাহর ওয়াস্তে গাড়ি ছেড়ে দাও।’ এর ফাঁকে সুকৌশলে বাড়িয়ে দেওয়া হলো এলপি গ্যাসের দামটাও। ব্যস, হয়ে গেল! আগে যেখানে জ্বালানি তেলের দাম মাত্র কয়েক টাকা বাড়াতেই নানা বিক্ষোভ ও মিছিল করতে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো মাঠে নামত, তারাও এ খেলায় হতবুদ্ধ হয়ে গেল। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, নাকি ধর্মঘটের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে, সে হিসাব কষতে কষতে সরকার ও পরিবহনমালিকদের এ খেলায় দুই পক্ষই জিতে গেল।

কোনো ঘোষণা ছাড়া এভাবে ধর্মঘট ডাকা বেআইনি হলেও সেটি করার সুযোগ করে দিল সরকার। ধর্মঘটের বিরুদ্ধে তারাও কোনো ব্যবস্থা নিল না। পরিবহননেতা–মালিকেরা সরকারি দলের নেতা হওয়ার পরও তাঁদের ডেকে সমঝোতার বদলে দল থেকেও এই বেআইনি ধর্মঘটের পক্ষে একপ্রকার ‘মৌন সমর্থন’ দেওয়া হলো।

তাহলে আমাদের এ সিদ্ধান্তে আসাটা অমূলক হবে না যে পরিবহনভাড়া বাড়াতেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি জরুরি ছিল। নয়তো এর বাইরে পরিবহনমালিকদের আবদার রক্ষা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। সর্বশেষ ২০১৩ সালে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর দূরপাল্লার বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল কিলোমিটার প্রতি মাত্র দশ পয়সা। বাসমালিকেরা ২০১৬ সাল থেকেই ভাড়া বাড়ানোর জন্য দেনদরবার করে আসছিলেন। জ্বালানি তেলের দাম না বাড়লেও তাঁদের যুক্তি ছিল, যন্ত্রাংশ ও ইঞ্জিন অয়েলের দাম বেড়েছে। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিবহনমালিকদের ভাড়া বাড়ানোর দাবিকে আড়ালে ফেলে।

কিন্তু পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের ‘পাওনা’ বুঝিয়ে দেওয়ার তো সময় হয়ে এসেছে। নির্বাচন যেহেতু ঘনিয়ে এসেছে, আর তো দেরি করা যায় না। এ সরকার ক্ষমতায় আসতে বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা কোন ধরনের ভূমিকা রেখেছে, সে আলাপে না যাই। তবে সরকারের ক্ষমতার পাটাতন শক্ত রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া অন্যান্যরা যার যার জায়গা থেকে তাদের পাওনা বুঝে পেলেও, বাকি ছিল শুধু পরিবহননেতা–মালিকেরা। ক্ষমতার পালাবদলের সময় বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় মাঠে শক্তি প্রদর্শনের বড় নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁরা।

২০১৫ সালে বিএনপির দেশব্যাপী যে জ্বালাও–পোড়াও আন্দোলন চলেছিল, সেটি মাঠে মারা যায় মূলত এ পরিবহননেতা–মালিকদের কারণে। ব্যাপক সহিংসতার মধ্যেও রাস্তায় গাড়ি ও শ্রমিক নামিয়ে বিরোধী দলের শক্ত এ আন্দোলন মোকাবিলা করেছিল তারা। ২০১৪ সালে নিবার্চনের আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বিরোধী দলের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি কীভাবে সরকার ভন্ডুল করে দিয়েছিল, সেটি কারও ভুলে যাওয়ার কথা না। সেই কর্মসূচির দুইদিন আগ থেকে সম্ভব-অসম্ভব সব উপায়ে ঢাকামুখী চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছিল। সড়ক, নৌ ও রেলপথের কোনোটিই যাতে বিরোধী দলের সমর্থকেরা ব্যবহার করতে না পারে, তার জন্য দেওয়া হয় ‘সরকারি অবরোধ’। বিরোধী দলের সেই কর্মসূচি সফলভাবে মোকাবিলা করার পেছনে মূল কারিগর ছিলেন পরিবহননেতা–মালিকেরা। শ্রমিক নামিয়ে বিরোধী দলের কর্মসূচি নস্যাৎ করে দেওয়ার বিচ্ছিন্ন আরও অনেক উদাহরণ বিগত এক দশকে ঘটেছে। ফলে সরকারেরও দায়িত্ব ছিল পরিবহননেতা–মালিকদের জন্য কিছু করা।

এখন সামনের নির্বাচন নিয়ে সরকারি দল প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। গত নির্বাচন নিয়ে সমালোচনায় ‘রাতের ভোট’ বলে একটি প্রবাদ বাক্যেও প্রচলিত হয়ে গেছে। যেখানে আদতে জনগণের কোনো ভূমিকা ছিল না, তার ভোটাধিকারের বিষয়টিও ছিল গৌণ। ফলে জনগণের ভোট যখন মূল্যহীন, তাদের ওপর জীবন–জীবিকার বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেওয়াই যায়!

যেখানে নির্বাচনে জনগণের কোনো অংশীদারত্ব নেই, সেখানে যাদের ছাড়া চলবে না তাদের গুরুত্বই বেশি থাকবে সরকারের কাছে। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চয়ই কোনো না কোনো শক্ত কর্মসূচি দেওয়ার চেষ্টা করবে। সেটিকে মোকাবিলা করতে পরিবহন মালিকদের আগের মতো জুরুরত পড়তে পারে। তার আগেই, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি ও ধর্মঘটের এ ‘গেম’ এর মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে বিগত ভূমিকার জন্য পরিবহননেতা–মালিকদের ‘উপহার’ বুঝিয়ে দেওয়া হলো।

রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক