পাহাড়ধস: কেন, কী করণীয়

১৮ জুন ২০১৭, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘পাহাড়ধস: কেন, কী করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

আলোচনায় সুপারিশ
* পাহাড়ের বিন্যাসকে মাথায় রেখে রাস্তা বানানো উচিত। পাহাড়ের কোনো রাস্তাই যেন ভূতাত্ত্বিকদের পরামর্শ ছাড়া না বানানো হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে

*   পাহাড়কে আমরা এখনো ভোগের সামগ্রী বলেই মনে করি। এখানে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা প্রয়োজন

*   পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় জরিপের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তাগুলো িচহ্নিত করা প্রয়োজন এবং যত দ্রুত সম্ভব এ রাস্তাগুলো ঝুঁকিমুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে

*   পাহাড় রক্ষার জন্য এমন একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, যেন পাহাড়ের কোনো গাছ কাটা না হয় এবং এখানকার জমি লিজ দেওয়া না হয়

আলোচনা 

মতিউর রহমান: মানুষের যেকোনো ধরনের সমস্যা, কষ্ট, দুর্ভোগ, বিপর্যয়ে আমরা পাশে থাকার চেষ্টা করি। আমাদের প্রথম আলো ট্রাস্ট ও বন্ধুসভার মাধ্যমে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াই।

সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড়ধসের ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। ওখানকার পরিস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে পত্রিকায় প্রকাশ করছি। প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে গত চার দিন প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা তাদের কাছে সাহায্য নিয়ে গেছেন। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় এ পর্যন্ত ১৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। এখানকার মানুষের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক কাজ করছে। যেকোনো সময় আবারও ভারী বৃষ্টি হতে পারে। আবারও এ ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে? এটা কি শুধুই বৃষ্টিপাতের ফলাফল, নাকি অন্য কারণ আছে। আমাদের প্রতিবেদনগুলোতেও ইতিমধ্যে কিছু বিষয় এসেছে।

আমরা মনে করি, এটা শুধু ভারী বৃষ্টির জন্যই হয়নি। কয়েক দশক ধরে বন-পাহাড় ধ্বংস করা, মাটি কাটা, বসতি স্থাপন করা, প্রাকৃতিক গঠনকে বিবেচনায় না নিয়ে রাস্তাঘাট তৈরি করা—এ সবকিছু মিলিয়ে এ ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

কী জন্য এমন ঘটনা ঘটছে, এ বিষয়ে আপনাদের কাছ থেকেও আমরা জানতে চাই। সে জন্যই আজকের এ গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা। এখন এ িবষয়ে আলোচনা করবেন হুমায়ুন আখতার।

হুমায়ুন আখতার
হুমায়ুন আখতার

হুমায়ুন আখতার

যেখানে পাহাড় আছে, সাধারণত সেখানে ভূমিধস হবে। সেটা আগ্নেয় শিলা, রূপান্তর শিলা বা পাললিক শিলা, যেটাই হোক না কেন, সব ক্ষেত্রেই পাহাড়ধস হবে।

 আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও ভূমিধস হচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ পাহাড় পাললিক শিলা দিয়ে গঠিত। এখানে ভূমিধস বেশি হবে। কয়েক দশক আগেও ভূমিধস হতো। কিন্তু তখন এভাবে মানুষের মৃত্যু হতো না বলে মানুষ এ বিষয়টি জানতে পারত না। বর্তমানে পাহাড়ধস আগের থেকে বেড়ে গেছে। সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত পাহাড়ের বিন্যাস হলো উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। আমাদের দেশের পূর্বে ভারতের মণিপুর, মিজোরাম, এরও পূর্বে মিয়ানমারের পাহাড়গুলো একই রকম। এর মধ্যে কিছু পাহাড় উচ্চতা ও কিছু পাহাড় ভ্যালি তৈরি করে। 

পাহাড়গুলোর মধ্যে তিন ধরনের ভূতাত্ত্বিক গঠন রয়েছে। এগুলো হলো বালুপ্রধান, স্যান্ডশেল অল্টারনেশনস (বালু–মাটির স্তরবিশিষ্ট) ও কাদাপ্রধান পাহাড়। স্যান্ডশেল অল্টারনেশনস পাহাড়গুলো ভূমিধসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

অন্য পাহাড়েও ভূমিধস হতে পারে। আমাদের পাহাড়গুলোর পূর্বে ও পশ্চিমে ঢাল রয়েছে। যেসব পাহাড়ের ঢাল ও এর ভেতরের ভূতাত্ত্বিক স্তর যখন একই দিকে থাকবে, সে পাহাড়গুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আবার যেসব পাহাড়ের ঢাল ও এর ভূতাত্ত্বিক স্তর বিপরীতমুখী, সেগুলো কম ঝুঁকিপূর্ণ।

আমাদের ছাত্রজীবনে ঘন বনায়নের জন্য এসব পাহাড়ে ঢুকতে পারতাম না। এখন সে অবস্থা নেই। বৃষ্টিপাত যে এখন বেশি হচ্ছে, তা নয়। আগেও ভারী বৃষ্টিপাত হতো। কিন্তু তখন ঘন বনায়নের জন্য বৃষ্টিপাত পাহাড়ের শিলাস্তরে ঢুকতে পারত না। বৃষ্টির পানি পাহাড়ের ওপর দিয়ে গড়িয়ে নিচে চলে আসত। এ জন্য পাহাড়ের ভেতরের মাটির গঠন ঠিক থাকত।

এখন পাহাড় ন্যাড়া হয়ে গেছে। পাহাড়ে ঘন বনায়ন নেই। এ জন্য বৃষ্টির পানি সরাসরি পাহাড়ের শিলাস্তরে প্রবেশ করে পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। শুধু ভারী বৃষ্টির জন্যই পাহাড়ধস হচ্ছে না। আরও অনেক কারণ রয়েছে। 

ভূমিকম্প, পাহাড় কাটা, বন উজাড় করা, প্রতিনিয়ত ভারী যানবাহনের ঝাঁকুনি—এমন বিভিন্ন কারণে পাহাড়ধস হতে পারে। এবার পাহাড়ধসে বেশি মানুষ মৃত্যুর জন্য এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ভবিষ্যতে হয়তো মৃত্যু কমে যাবে। কিন্তু পাহাড়ধসের প্রকৃত কারণ যদি চিহ্নিত করতে না পারি, তাহলে এ ধরনের মৃত্যু হতে থাকবে। 

পাহাড়ধস একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড পাহাড়ধসকে ত্বরান্বিত করেছে। এখানে যেকোনো ধরনের নির্মাণের জন্য ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনায় রাখা জরুরি। তা না হলে একটি সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা কীভাবে মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক পাহাড়ধস এর উদাহরণ।

এ অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো ভেঙে যোগাযোগব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। ফলে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে। আমার মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় একটা জরিপ হওয়া উচিত, কোন কোন রাস্তাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এ জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি দুই ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

স্বল্প মেয়াদে রিটেনশন ওয়াল দিয়ে রাস্তাগুলোকে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে বন বিভাগ, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন—সবাইকে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।

খায়রুল ইসলাম
খায়রুল ইসলাম

খায়রুল ইসলাম

পাহাড়ি জনপদের অনেক বিচিত্র নাম আছে। ছড়ি, ছড়া, ঝিরি ইত্যাদি। এ থেকে বোঝা যায়, পাহাড়ি ঝরনার পাশ দিয়ে বসতি গড়ে উঠেছে। আমি পানি নিয়ে কাজ করি। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের পানির কষ্ট অনেক বেশি।

২০০৭ সালে এ এলাকায় আসি। এখানকার ১১টা উপজেলায় ঝরনার গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করলাম। তখন ঝরনাগুলোর খুব খারাপ অবস্থা দেখলাম। ২০১৬ সালে আবার ওখানে গেলাম। অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করলাম এসব ঝরনার অবস্থা কী। আমার কাছে ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে তোলা পার্বত্য অঞ্চলের ছবি আছে। 

১৯৮৯ সালে তোলা ছবিতে দেখা যায়, পার্বত্য অঞ্চল ছিল গভীর বনভূমি। ২০০৩ সালে তোলা ছবিতে দেখা যায়, এ অঞ্চলে আগের মতো গাঢ় বন নেই। এটা অনেকটা হালকা বনে পরিণত হয়েছে। ২০১৫ সালে ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে তোলা পার্বত্য অঞ্চলের চিত্রে ভয়ংকর রূপ দেখা যায়। কিছু জায়গা ছাড়া পুরো বনভূমি কেটে কৃষিজমিতে রূপান্তর করা হয়েছে।

আম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, রাবার বাগান ইত্যাদি করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ইমেজে একে আর বন বলার সুযোগ থাকছে না। বন ধ্বংসের সঙ্গে ভূমিধসের সম্পর্ক আছে কি না, এটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

১৯৬৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমরা বৃষ্টির নমুনা দেখেছি। সাম্প্রতিক সময়ে বৃষ্টির পরিমাণ কমেনি। আগে পাহাড়ে অনেক বেশি প্রাকৃতিক বন ও লতাগুল্ম ছিল, এ জন্য সহজে পানি নিচে গড়িয়ে যেতে পারত। এখন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হওয়ার কারণে সেটা হতে পারছে না। ফলে বৃষ্টির পানি পাহাড়ের মাটির ভেতর প্রবেশ করে ভূমিধসের কারণ সৃষ্টি করছে।

ঝরনার স্বচ্ছ পানিকে কাদাপানিতে পরিণত করছে। পাহাড় ভালো অবস্থায় আছে না খারাপ অবস্থায় আছে, এটা বোঝার জন্য দেখতে হবে ঝরনার অবস্থা কেমন। ঝরনা যদি ভালো অবস্থায় থাকে, তাহলে বুঝতে হবে পাহাড়ও ভালো আছে। ঝরনার অবস্থা খারাপ মানে পাহাড়ের অবস্থা খারাপ। বন ধ্বংস করে আমরা পাহাড়কে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছি। এর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। বন কেটে আড়াআড়ি রাস্তা, বসতি স্থাপন, বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি—এসব পাহাড়ধসের কারণ বলে মনে করি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর তোলা মোটেই উচিত নয়। এটা পাহাড়কে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে।

আমেরিকার ২৩তম প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন হ্যারিসনকে একটা কারণে মানুষ মনে রেখেছে। তিনি আমেরিকার সব বন সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কেউ বনের কোনো গাছ কাটতে পারে না। এর সুফল এখন আমেরিকা ভোগ করছে। আমাদেরও এমন একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যেন বনের কোনো গাছ কাটা না হয়। লিজ দেওয়া না হয়।

পাহাড় রক্ষার অনেক ধরনের উদ্যোগ আছে। আমি মনে করি, পাহাড়ে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য, ঝরনাগুলো সচল রাখার জন্য ও পাহাড় নিরাপদ রাখার জন্য পাহাড়ের গাছ যেন কাটা না হয় এমন একটা উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

ইউনুস আলী
ইউনুস আলী

ইউনুস আলী

পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার। দেশে মোট পাহাড়ি বনের ৯ শতাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে। ১৯৬৪-৬৫ সালের এ অঞ্চলের একটা গবেষণা ছিল। এ গবেষণামতে, ৭৭ দশমিক ৩ শতাংশ হলো পাহাড়। ১৯ শতাংশ টিলাভূমি। ৩ দশমিক ৩ শতাংশ সমভূমি।

একটা পাহাড়ে কমপক্ষে তিন ধরনের গাছের স্তর থাকে। মাটির সঙ্গে থাকে লতাগুল্ম। এগুলো না থাকলে পাহাড়ের গঠন ঠিক থাকে না। গাছের শিকড়ের জন্য পাহাড়ের গঠন ঠিক থাকে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে ৯ লাখ একর হলো সংরক্ষিত বন। প্রাকৃতিক বন বা সংরক্ষিত নয় এমন এলাকার পরিমাণ ১৭ লাখ একর। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এসব এলাকার ৫ থেকে ১০ একর পর্যন্ত বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। এই প্রাকৃতিক বন বন্দোবস্ত দেওয়ার ফলে অনেকে এগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করেছে।

ব্যক্তি সব সময় মুনাফার বিষয় গুরুত্ব দেয়। তারা এখানে বাণিজ্যিক বনায়ন করেছে। ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত এখানে মূলত ছিল সেগুন, গামারি, কদম ইত্যাদি গাছ। পরবর্তী সময়ে হর্টিকালচার চাষ হয়েছে।

১৯৭৬ সালে আবার চিটাগং হিলট্রাক্ট ডেভেলপমেন্ট বোর্ড হয়। এর মাধ্যমে অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন শুরু হয়। এ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা এখনো আছে। এখানে সড়ক যোগাযোগ, টেলিকমিউনিকেশন, বিদ্যুৎ–সংযোগ ইত্যাদি হয়েছে। উন্নয়নের ফলে এ অঞ্চলে মানুষের চাপ বেড়েছে। 

১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২ দশমিক ৫ শতাংশ বাঙালি ছিল। ১৯৯১ সালে বেড়ে হয়েছে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এলাকায় ৪ লাখ পাহাড়ি ছিল। আর ৪ লাখ বাঙালিকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। পাহাড়ি ও বাঙালিদের জীবনাচরণের মধ্যে যে পার্থক্য, সেটা পরিবেশকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ক্রমাগতভাবে এ অঞ্চলে জনসংখ্যা বাড়ছে। এদের জীবনধারণের ব্যবস্থা কী? এরা মূলত গাছ কাটে, মাছ ধরে।

রাজনৈতিকভাবে বনকে কীভাবে দেখা হবে, সেটা একটা বিষয়। আগের থেকে জুম সাইকেল কমে গেছে। আগে জুম সাইকেল ছিল ১০ বছর। একজন ব্রাজিলিয়ান বিশেষজ্ঞ বলেছেন, জুম সাইকেল হবে ১৫ বছর। এখন এটা কমে এসেছে দুই থেকে তিন বছরে। জুম সাইকেলের ফলে ব্যাপকভাবে মাটির উপরিভাগ ধ্বংস হয়ে যায়। নিচের দিকে খালে চলে যায়। জুমচাষ একটা বড় সমস্যা।

এখন এ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ফসলের চাষ হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করা প্রয়োজন। প্রচুর গাছ পাচার হয়। অসংখ্য আসবাবের দোকান। আসবাব মানেই বন ধ্বংস। পাহাড়ি-বাঙালি সবাই এটা করছি। এ এলাকা থেকে প্রতি মাসে কমপক্ষে দুই লাখ সিএফটি ফার্নিচার চলে যায়।

 ফার্নিচারের ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। এটা ভীষণ রকমের অনিয়ম। আমার সময় খাগড়াছড়িতে ফার্নিচারের ব্যবসা বন্ধ করেছিলাম। কিন্তু রাঙামাটি ও বান্দরবানে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

পাহাড় রক্ষায় একটা কর্তৃপক্ষ তৈরি করতে হবে। যাদের সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে। এ এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন বন্ধ করতে হবে। এত কিছুর পরও খুব আশাবাদী হতে পারছি না যে এসব বন্ধ হবে।

ফিলিপ গাইন
ফিলিপ গাইন

ফিলিপ গাইন

এখন রাঙামাটিতে একটা শহর দেখি। আগে এই শহর ছিল না। পাহাড়ের চূড়ায় এই শহর গড়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন, এমন একটা জায়গায় শহর হতে পারে কি না। পাহাড়ি এলাকায় শহর সাধারণত হয় উপত্যকায়। কাঠমান্ডুর মতো শহরগুলো উপত্যকায়। ওখানে পাহাড়েও কিছু ঘরবাড়ি আছে, কিন্তু সেগুলোর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আমাদের পাহাড়গুলো বালু-মাটির পাহাড়।

রাঙামাটি থেকে খাগড়াছড়ি কিংবা বান্দরবান পর্যন্ত নতুন গ্রাম গড়ে উঠছে। এসব এলাকার আরও অনেক ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে। এখন একটা ভূমিধস হয়েছে। অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। িকন্তু ভূমিধসের প্রকৃত কারণ সামনে আসছে না।

জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে আমরা কতটুকু বিদ্যুৎ পাই? বছরের কত সময় এই বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকে? পত্রপত্রিকায় দেখি, অধিকাংশ সময় ওখান থেকে কোনো বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। ওটার বোধ হয় মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। এখন ভাববার বিষয়, ওখানে আরেকটা বিপর্যয় হবে কি না। 

বন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কুড়ি বছর ধরে আমরা ওখানে যাতায়াত করি। লক্ষ করেছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা জায়গায় খুব বড় সর্বনাশ হচ্ছে বাঁশ উজাড় করা। বাঁশ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবন কল্পনাই করা যায় না। বাঁশ কিন্তু শেষ হয়ে গেছে।

বাঁশ শেষ হওয়ার পর এখানে বিশাল এলাকা নিয়ে পাল্পউড প্ল্যান্টেশন হচ্ছে। এটার ব্যাপারে কেউ কিন্তু তেমন কথা বলেন না। এর কোথাও কোথাও আবার সেনা ক্যাম্প রয়েছে। এখানে মানুষের জীবন ভীষণ কষ্টকর। বিএফআইডিসির (বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন) ওয়েবসাইটে প্রাকৃতিক বনকে বলা হয়েছে বুশ। তাদের ভাবভঙ্গি হলো এগুলো কেটে ফেলতে হবে। এসব কেটে কিছু প্ল্যান্টেশন তারা করেছে। এটা আসলে কিছুটা পাল্পউডের সঙ্গে রিলেটেড।

সংরক্ষিত বন আর নেই। বান্দরবানের বাইশারিতে চারটা চাকগ্রাম ছিল। ৮-১০ বছর আগে ওই চাকগ্রাম থেকে একটানা ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত হেঁটেছি চামুয়াঝিরির একটা মুরং গ্রামে যাওয়ার জন্য। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে বাইশারি থেকে শুরু করে বাদুড়ঝুরি পর্যন্ত প্রচুর রাবার ও তামাকের চাষ করা হয়েছে। এ জন্য উজাড় করা হয়েছে প্রাকৃতিক বন–জঙ্গল। এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার।

ব্রিটিশ আমল থেকে এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি কী? শান্তি চুক্তি হয়েছে, এর বাস্তবায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভূমি চুক্তির বাস্তবায়ন করা। এ জন্য পাঁচটি ভূমি কমিশন হয়েছে। সেই কমিশনগুলো দৃশ্যত কিছুই করেনি। এখন একটা বিপর্যয় হয়েছে। সপ্তাহখানেক পরে হয়তো আলোচনাও শেষ হয়ে যাবে। এখানে গণমাধ্যম একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যেন এ ধরনের ভূমিধস আর না হয়। আশা করি এ বিষয়ে সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। 

প্রশান্ত ত্রিপুরা
প্রশান্ত ত্রিপুরা

প্রশান্ত ত্রিপুরা

রাঙামাটিতে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এই কদিনের পত্রপত্রিকায় যা দেখছি, শুনছি—এভাবেই কিছুটা ধারণা হয়েছে। আজকের সকালবেলা পত্রিকায় কিছু শিশুর নাম দেখলাম। এরা পাহাড়ধসে মারা গেছে। নুরি আকতার, বন্যা চাকমা, জুমজুমি চাকমা, বৃষ্টি। বৃষ্টি বাঙালি না চাকমা এর কোনো উল্লেখ নেই। এত বড় একটা ঘটনা, অথচ একে তেমন একটা মানবিকভাবে দেখা হয়নি। কিন্তু এটা একটা মানবিক বিপর্যয়। আমি বিবিসিসহ বিভিন্ন খবর শুনে থাকি। গতকাল ভাবলাম বাংলাদেশ বেতার কী বলে শুনি। বিবিসি গুরুত্বের সঙ্গে বলেছে, ‘রাঙামাটি এখনো বিচ্ছিন্ন।’ কিন্তু বাংলাদেশ বেতার রাঙামাটির কোনো খবরই দিল না।

বাংলাদেশ বেতারে রাজনীতিকদের খবর তো আছে। জাপান সাগরে মার্কিন নৌসেনা নিখোঁজ, তাদের খোঁজা হচ্ছে। গ্রেনফেলে সর্বশেষ মৃতের সংখ্যা কত, ওভালে আজ ক্রিকেট খেলা হবে—এমন বিভিন্ন সংবাদ আছে। বিস্মিত হলাম, রাঙামাটির কোনো খবর নেই। যেকোনো বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র মানুষেরা। এদের মধ্যে নারী, বয়স্ক ও শিশুরা ঝুঁকির মধ্যে থাকে সবচেয়ে বেশি।

প্রশাসনসহ কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজন বড় রকমের রাজনৈতিক নেতৃত্বের। কোনো কোনো পত্রিকায় কতজন বাঙালি ও কতজন পাহাড়ি মারা গেল, সেটা উল্লেখ করে খবর প্রকাশ করছে। এখানে পাহাড়ি-বাঙালি কারা মারা গেল, সেটা কোনো বিষয়ই না। শেষ পর্যন্ত মানুষ মরেছে এটাই প্রধান।

জুমচাষে হয়তো পাহাড়ের ক্ষতি হয়। এই ক্ষতি অন্যান্য ক্ষতির তুলনায় খুবই কম। কিন্তু ঘুরেফিরে একেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে পাহাড়ধসের প্রকৃত কারণ সব সময় আড়ালে থেকে যায়। পাহাড়িদের মধ্যেও যারা প্রান্তিক, তারা জুম চাষ করে। অথচ আমরা দেখে থাকি, রাস্তা যেখান দিয়ে গেছে, যেখানে শহর—এসব জায়গায় বেশি ভূমিধস হচ্ছে।

আলোচনায় ভূমিধসের আরও অনেক কারণ এসেছে। একসময় আমরা সবকিছু ভুলে যাই। প্রতিটি ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে হবে। সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে পাহাড়ধস থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে হবে।

গওহর নঈম
গওহর নঈম

গওহর নঈম

বছরের শুরু থেকে যে দুর্যোগগুলো আমরা দেখছি, এর সব কটির পেছনেই দায়ী হলো আমাদের শাসনকার্যের ব্যর্থতা, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা।

বলা হচ্ছে, ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ে এ রকম বিপর্যয় হতে পারে। ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হবেই, কোনো সময় এর চেয়ে বেশি হবে। আবার কোনো কোনো সময় কম হবে। কিন্তু এই ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টির পাশাপাশি যে আমরা পাহাড়ের অবস্থাকে নাজুক করে রেখেছি, সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলছে না। তামাক চাষ প্রথমে আমাদের দেশের রংপুর থেকে শুরু হয়েছিল। রংপুরের বন ধ্বংস করতে করতে কুষ্টিয়া হয়ে এটা এখন পাহাড়ে পৌঁছে গেছে। কারণ ওখানে এখনো অনেক গাছ, যা কেটে তামাক চাষ করা যায়। যেখানে কাটার মতো গাছ নেই, সেখানে তামাকের চাষ হচ্ছে না। তামাক ব্যবসায়ীরা আমাদের চোখের ওপর দিয়ে কাজগুলো করে যাচ্ছেন, আমরা কিছু বলতে পারছি না।

শুধু গাছ ধ্বংস না, এটার সঙ্গে তামাক চাষে যে বিষক্রিয়া ছড়ানো হচ্ছে, তা আমাদের ভূমির সঙ্গে এবং আমাদের পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

আমাদের পাহাড়ের এই সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রযুক্তিগত সমাধান এবং রাজনৈতিক সমাধান দুটিই পাশাপাশি চালাতে হবে। এখন যদি বলা হয় যে পাহাড়ের গাছ তো সব ধ্বংস করে ফেলেছি, এখন পাহাড়কে কীভাবে রক্ষা করব? এখনো উপায় আছে।

রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী পশ্চিমপাড়ায় পাহাড়ধসে নিহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে কাজ করছেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ সেনাবাহিনীর সদস্যরা
রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী পশ্চিমপাড়ায় পাহাড়ধসে নিহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে কাজ করছেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ সেনাবাহিনীর সদস্যরা

একটা ভালো প্রস্তাব এসেছে যে পুরো পাহাড়ি অঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করে গাছ কাটা বন্ধ করা। পাহাড় পাহাড়িরা ভালো চেনে। বাঙালিরা পাহাড় ততটা ভালো চিনবে না বা পাহাড়ের সঙ্গে বসবাস করতে পারবে না।

এ কারণেই হয়তো যারা বাইরে থেকে গিয়ে পাহাড়ে বসবাস করছে, তারা পাহাড়ের মাটিকে সমতলের মাটি হিসেবেই ভাবে। আর সে কারণেই দুর্যোগের সময় তাদের ক্ষতিটাও বেশি হয়ে থাকে। পাহাড়ধসের পর যখন উদ্ধারকাজ চলছিল, তখন দেখে খারাপ লেগেছে যে উদ্ধারকর্মীরা কোদাল আর বেলচা দিয়ে মাটি সরাচ্ছে। অথচ আমরা আমাদের ফায়ার ব্রিগেডকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো উন্নত করতে পারতাম। তাহলে হয়তো অনেক মানুষকে আমরা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারতাম, যেটা আমরা পারিনি।

আরেকটা সমাধান হলো, পাহাড়ে যখন প্রকৌশলীরা রাস্তা বানাচ্ছেন, তখন আমাদের ভূতাত্ত্বিকদের সঙ্গে সমন্বয় করে পাহাড়ের বিন্যাসকে মাথায় রেখে রাস্তা বানানো উচিত। পাহাড়ের কোনো রাস্তাই যেন ভূতাত্ত্বিকদের পরামর্শ ছাড়া না বানানো হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

যোগাযোগবিচ্ছিন্ন রাঙামাটি। জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছে শহরে। তেল কিনতে পেট্রলপাম্পে স্থানীয় বাসিন্দাদের দীর্ঘ সারি
যোগাযোগবিচ্ছিন্ন রাঙামাটি। জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছে শহরে। তেল কিনতে পেট্রলপাম্পে স্থানীয় বাসিন্দাদের দীর্ঘ সারি

এবার যতগুলো স্থানে ধস নেমেছে, সবই ছিল পাহাড়ের উত্তর-দক্ষিণমুখী রাস্তার পাশে। এটা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে পাহাড়ের কোথায় সমস্যা আছে। এই পাহাড়ের সমস্যা না বুঝতে পারলে পাহাড় ডিঙানো যাবে না, যেটা আমরা করতে যাচ্ছি।

১৭টা আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় আড়াই হাজারের মতো মানুষ রয়েছে। এরা খুবই গরিব মানুষ। এদের হয়তো প্রশাসন আরও দুদিন রাখতে পারবে, কিন্তু যখন এদের কথা সংবাদপত্র থেকে উধাও হয়ে যাবে, তখন এরা কোথায় যাবে? এরা যেখানে ছিল, সেখানে তো আর ফিরে যেতে পারবে না। বিশেষ করে যারা শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদের কথা ভাবতে হবে। তারা তো আসার সময় তাদের বই-খাতাও নিয়ে আসতে পারেনি। 

আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমরা ১৬ কোটি মানুষ যেন এই আড়াই হাজার মানুষের কথা ভুলে না যাই। আরেকটি বিষয় হলো, পাহাড়কে আমরা এখনো ভোগের সামগ্রী বলেই মনে করি। এখানে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে।

মতিউর রহমন: পাহাড়ধসের বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হলো। পার্বত্য অঞ্চলে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ভূতাত্ত্বিক জরিপ হওয়া প্রয়োজন। পাহাড়ের গাছ কাটা, সড়ক তৈরি, বসতি তৈরি—এমন অনেক কর্মকাণ্ডের ফলে পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দেওয়া প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

যাঁরা অংশ নিলেন 

হুমায়ুন আখতার : অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রশান্ত ত্রিপুরা : নৃবিজ্ঞানী, খণ্ডকালীন শিক্ষক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

ইউনুস আলী : সাবেক প্রধান বনরক্ষক

খায়রুল ইসলাম : কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়াটারএইড, বাংলাদেশ

ফিলিপ গাইন : িনর্বাহী পরিচালক, সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড িহউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড)

গওহর নঈম : জলবায়ু ও দুর্যোগ বিভাগের পরিচালক, ব্র্যাক

সঞ্চালক

মতিউর রহমান  :  সম্পাদক, প্রথম আলো