বিপর্যয় রোধে জাতীয় ভাষানীতি প্রয়োজন

ভাষা-পরিস্থিতি সতত পরিবর্তনশীল। কোনো নির্দিষ্ট দেশের ভাষা-পরিস্থিতি কখনো স্থির থাকে না। কিন্তু ভাষা-পরিস্থিতিতে যে পরিবর্তন ঘটে, তা সে দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির অনুকূলেও ঘটতে পারে, আবার প্রতিকূলেও ঘটতে পারে। অনুকূলে ঘটলে তা গ্রহণযোগ্য হয়; আর যদি প্রতিকূলে ঘটলে হয় অগ্রহণযোগ্য। কারণ, কোনো দেশের ভাষা–পরিস্থিতিতে নেতিবাচক পরিবর্তন সে দেশে দীর্ঘমেয়াদি ভাষা-রাজনৈতিক অস্থিরতা বয়ে আনে।

বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তনের ছাপ সমাজ ও সংস্কৃতিতে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। তবে ইদানীং তা ঘটছে সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিকূলে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ভাষা–সংশ্লিষ্ট নানা সমস্যা, যাকে বলা যেতে পারে ভাষিক সমস্যা। এসব ভাষিক সমস্যার কোনো কোনোটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রধানত বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি প্রতিসম রাষ্ট্র হওয়ায়, দেশের ভাষা-পরিস্থিতির পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত ভাষিক সমস্যাগুলো প্রকটভাবে প্রতিভাত হচ্ছে না। সে জন্য জাতীয় নেতৃত্ব ভাষা-পরিস্থিতিগত সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে আমলে নিচ্ছে না। বর্তমান বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতির নেতিবাচক পরিবর্তনের ধারায় যেসব ভাষিক সমস্যা পরিদৃষ্ট হচ্ছে, তা নিম্নরূপ:
‌‌
১. ভাষিক আধিপত্যবাদের কবলে পড়ে বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি নেতিবাচক দিকে পরিবর্তিত হচ্ছে। ভাষিক আধিপত্যবাদ হলো ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক অনুবর্তী জাতির ভাষাকে দুর্বল করে দেওয়ার কৌশল বিশেষ। বস্তুত ইংরেজি, আরবি ও হিন্দি আধিপত্যবাদের কবলে নিপতিত হয়ে বাংলা ভাষা তার মর্যাদা ও কার্যকারিতা হারাচ্ছে।

২. ইংরেজি ও নানা আঞ্চলিক উপাদানে দুষ্ট হয়ে বাংলা ভাষা উচ্চারণ, ব্যাকরণ ও বাগর্থিক মাপকাঠিতে তার সৌষ্ঠব হারাচ্ছে। তা ছাড়া বাংলা ভাষা ইংরেজি (ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরবি) ভাষার তুলনায় মর্যাদা হারাচ্ছে। শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষাকে আর মর্যাদার চোখে দেখা হচ্ছে না।

৩. বাংলা মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কওমি মাদ্রাসাগুলোয় যথাক্রমে বাংলা, ইংরেজি ও আরবি মাধ্যমে শিক্ষা পরিচালিত হলেও ভাষা শিক্ষার অব্যবস্থাপনার ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যথাক্রমে বাংলা, ইংরেজি ও আরবিতে দক্ষতার অবনমন ঘটে চলেছে।

৪. শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ব্যবহারের ব্যাপকতা বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাকে গ্রাস করে চলেছে। ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় ইংরেজি দক্ষতা অর্জনের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে পুরো জনগোষ্ঠীকে সাংজ্ঞাপনিক ইংরেজি (communicative English)-তে দক্ষ করার সরকারি ও ধনিক শ্রেণির উদ্যোগ নানা নেতিবাচক সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপসর্গের জন্ম দিচ্ছে। এক গবেষণা থেকে যেসব উপসর্গ চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো হলো ক. দেশে একটি বাংলা বিমুখ নতুন প্রজন্মের সৃজন ঘটছে, খ. ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইংরেজিকরণ ঘটছে এবং ইংরেজি মাধ্যমে অফিস-আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। গ. বাংলা ও ইংরেজির ভাষা সংসর্গজাত মিশেল ভাষার (বাংলিশ) বিস্তার ঘটছে এবং ঘ) দৃশ্যমান ও শ্রাব্য উভয় প্রকার ভাষিক বিশৃঙ্খলা পরিদৃষ্ট হচ্ছে।

৫. বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সুবিধা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ও পালি ইত্যাদি ভাষাগুলোকে কেবল ধর্মচর্চার মাধ্যম হিসেবে আটকে রাখা হয়েছে। ধর্মচর্চায় ব্যবহৃত এ ভাষাগুলোর শিক্ষায় ও প্রয়োগে প্রচুর জাতীয় বাজেট জড়িত। কিন্তু এগুলো জ্ঞানচর্চা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির নিয়ামক হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেসব উদ্দেশ্যে ব্যবহারে ব্যর্থতার কারণে দেশ বিশ্বায়নের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

৬. বাংলাদেশের বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া দরকার বিশ্বায়ন আদর্শভিত্তিক। কিন্তু বিশ্বায়ন নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে ভাষানীতি সমর্থিত একটি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি না করে অপরিকল্পিতভাবে বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে এবং তা বিশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। সে কারণে দেশে এখন মেরুদণ্ডহীন বিশৃঙ্খল বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

একটি জাতীয়তাবাদী ভাষানীতি প্রণীত ও বাস্তবায়িত হলে সরকার ভাষা–পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসনিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে এবং তা বাস্তবায়নের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে

৭. অপরিকল্পিত ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার ফলে শিক্ষা খাতে অপচয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনো নীতি বা পরিকল্পনা বিবেচনায় না নিয়ে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে বনিয়াদি শিক্ষা হিসেবে প্রচলন করা হয়েছে। অন্যদিকে ভাষাগত দক্ষতা মূল্যায়নের বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে, সে কারণে ইংরেজি শিক্ষায় ব্যাপৃত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতার বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে রয়েছে। ফলে দেশে ভাষা-শিক্ষায় ব্যয়িত অর্থের সমপরিমাণ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

৮. ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর ভাষাকে তার গঠন, মর্যাদা ও প্রায়োগিকতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন না করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতি মাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, আবার কখনো কখনো অবহেলা করা হচ্ছে। সরকারি প্রশাসনের আওতায় পরিচালিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নামক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ও বাজেট দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করা হচ্ছে অথচ বাংলা ভাষা উন্নয়নের লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না।

এই আলোচনা থেকে যে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে তা হলো, বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি নেতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং ফলে নানা ভাষিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। উল্লেখ্য, পৃথিবীর দেশে দেশে ভাষা-পরিস্থিতির নেতিবাচক পরিবর্তনজনিত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা থেকে দেশকে সুরক্ষার লক্ষ্যে ভাষানীতি প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিপর্যস্ত ভাষা-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটি ভাষানীতি প্রয়োজন।

কারণ, একটি জাতীয়তাবাদী ভাষানীতি প্রণীত ও বাস্তবায়িত হলে সরকার ভাষা–পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসনিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে এবং তা বাস্তবায়নের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে এবং তা বাস্তবায়ন সম্ভব হলে বাংলাদেশ ভাষিক সমস্যাজনিত রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে নিষ্কৃতি পাবে।

এ বি এম রেজাউল করিম ফকির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব অতিথি শিক্ষক।