শিক্ষার হার বাড়ল, মান কমল কেন

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, এত দিন আমরা শিক্ষার হার বাড়িয়েছি। এখন মানের দিকে নজর দিচ্ছি। এর মাধ্যমে তঁারা স্বীকার করে নিলেন, শিক্ষার মানের বিষয়টি উপেক্ষিতই ছিল। কিন্তু তাঁরা সম্ভবত ভুলে যান যে শিক্ষা মানেই মানসম্পন্ন শিক্ষা। এখানে ফাঁকিবাজির কোনো সুযোগ নেই। ফাঁকিবাজি শিক্ষা দিয়ে সনদ সংগ্রহ করা যায়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার হারও বাড়ানো যায়। যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক গড়া যায় না।

যে শিক্ষা সময়ের চাহিদা পূরণে অক্ষম কিংবা যার কোনো উপযোগিতা নেই, তাকে শিক্ষা বলা যায় না। বলা হয়, ব্রিটিশরা এক দল কেরানি তৈরি করতে এ দেশে ‘আধুনিক শিক্ষা’ চালু করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, স্বাধীন দেশে এখন যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তাতে যোগ্য কেরানিও তৈরি হচ্ছে না।

আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছি বলে দাবি করি। উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থাটি রয়ে গেছে সেকেলে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি নেওয়া আমাদের তরুণেরা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন উচ্চ বেতন-ভাতা দিয়ে বিদেশ থেকে হাজার হাজার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মী আনা হচ্ছে। ২০১৪ সালে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। গত ছয় বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এর কারণ, সরকার নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে সনদ দিতে পারলেও প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারেনি। নতুন নতুন বিভাগ খুলেছে, যারা কোনো উপযোগিতা নেই। আবার যেসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে, সেসব ক্ষেত্রে শিক্ষা সংকোচন করা হচ্ছে।

যুগোপযোগী শিক্ষার জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী নীতি এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় সব সরকারই এক বা একাধিক শিক্ষা কমিশন করেছে। কোনোটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তার আগেই তারা ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বেলায় সে কথা খাটে না। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষিত হওয়ার পরও সরকার ৯ বছর সময় পেয়েছে এবং সামনে আরও সময় তারা পাচ্ছে। সরকারের দাবি, ১৯৭৪ সালের ড. কুদরাত-এ–খুদা কমিশনের সুপারিশের আলোকে এ শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। এখন দেখা যাক সেই কমিশনের সুপারিশ কী ছিল। খুদা কমিশন প্রাথমিক শিক্ষাকে একমুখী, অবৈতনিক ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার কথা বলেছিল। তারা মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছিল। সরকার এর কোনোটাই বাস্তবায়ন করেনি। বরং শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, অষ্টম শ্রেণি সমাপনী তো এখন পাবলিক পরীক্ষা হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা এখন পরীক্ষামুখী, পাঠমুখী নয়। বর্তমানে দেশে চার ধারার প্রাথমিক শিক্ষা আছে। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন এবং মাদ্রাসাশিক্ষা।

কুদরাত–এ–খুদা শিক্ষা কমিশনের দ্বিতীয় সুপারিশ ছিল মাধ্যমিক শিক্ষা হবে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা। সরকারের উচিত ছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া। সেটি না করে তারা একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো কিংবা যোগ্য শিক্ষক কোনোটাই নেই। পত্রিকায় দেখলাম, কোনো কোনো নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চলছে প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক দিয়ে। কোনো অধ্যাপক, এমনকি সহযোগী অধ্যাপকও নেই। এ অবস্থায় মানসম্পন্ন শিক্ষা অাশা করা যায় কীভাবে?

সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে এখন বলা হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষায় অভিন্ন পাঠ্যক্রম থাকবে। বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কলা এ বিভাজন থাকবে না। এর অর্থ নতুন করে পাঠ্যবই প্রণয়ন করতে হবে। সরকারের এ উদ্যোগে নতুনত্ব নেই। বিএনপি সরকারও মাধ্যমিকে অভিন্ন শিক্ষাক্রম চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন শিক্ষাবিদেরা বিজ্ঞানবিরোধী প্রয়াস বলে এর প্রতিবাদ করেছিলেন। ফলে সেই উদ্যোগ বাতিল হয়ে যায়। এখনো যদি তঁারা প্রতিবাদ করেন, তাহলে সরকার কী করবে?

কয়েক দিন আগে প্রথম আলোয় শিক্ষাক্রমে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে বলে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়াতে পাঠ্যবই বা শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে পাঠ্যবই ৩৩টি, মাধ্যমিকে ৭১টি। এসব পাঠ্যবই পরিবর্তন মানে বিপুল কর্মযজ্ঞ। বিপুল অর্থ বরাদ্দ। ২০১২ সালেও প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হয়েছিল। সেই পরিবর্তনের মাজেজা এমন ছিল যে ছাগলকে পর্যন্ত গাছে চড়ানো হয়েছিল। পরে প্রতিবাদের মুখে কিছু কিছু সংশোধন করা হয়েছিল। কিন্তু এসব পাঠ্যক্রম বদলে শিক্ষায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। বিজ্ঞানমনস্কতারও কোনো ছাপ নেই। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শিক্ষানীতি ও পাঠক্রম দুটোই হেফাজতের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

যেকোনো নীতি বাস্তবায়নের জন্য আইন অপরিহার্য। আইন না থাকলে আইনভঙ্গকারীকে শাস্তি দেওয়া যায় না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, গত ১০ বছরে সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি আইন তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো না কোনো স্বার্থান্বেষী মহল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আইনের সর্বশেষ যে খসড়া তৈরি করেছে, তাতে নোটবই ও গাইড বই বাতিল করার কথা বলা হলেও কোচিং সেন্টার থাকবে বলে জানানো হয়েছে। তারা শর্ত দিয়েছে দিনের বেলায় কোচিং চলতে পারবে না; রাতে চলবে এবং স্কুলের শিক্ষকেরাও সেখানে পড়াতে পারবেন। যেখানে স্কুল পর্যায়ের পুরো িশক্ষাটি কোচিংনির্ভর হয়ে পড়েছে, সেখানে কোচিং সেন্টার রেখে শিক্ষার্থীদের ফের স্কুলমুখী করার চিন্তা অবাস্তব। গতকাল মিরপুর থেকে এক অভিভাবক তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বললেন, তাঁর মেয়ে যে স্কুলে পড়ে, সেই স্কুলের দুজন শিক্ষকের কাছে তাকে কোচিং করতে হয়। কোচিং না করলে শিক্ষকেরা ফেল করিয়ে দেন। সে ক্ষেত্রে কোনো অভিভাবক শিক্ষকের নামে অভিযোগ আনতেও সাহস পাবেন না।

শিক্ষাঙ্গনে এসব নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে, প্রশংসনীয়। এতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমবে। প্রতিবছর ভর্তির সময় দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটাছুটি করছে। কাছাকাছি সময়ে পরীক্ষা হওয়ার কারণে অনেকের পক্ষে কাঙ্ক্ষিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দেওয়াও সম্ভব হয় না।

প্রথমে ইউজিসি চেষ্টা করেছিল কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার। এখন পাঁচটি ভাগে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি।

দেশে মোট ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম চালু আছে। এর মধ্যে ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার বাইরে থাকছে। এর মধ্যে আছে চারটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া দেশের শীর্ষ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজ নিজ পদ্ধতি অনুসারে ভর্তি পরীক্ষা নেবে। এগুলো হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

ইউজিসি কয়েক বছর ধরেই অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু শীর্ষ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রাজি না হওয়ায় সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। এবার সেসব বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াই গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হতে যাচ্ছে। দেখা যাক ইউজিসি সফল হয় কি না।

সাম্প্রতিক কালে শিক্ষা বিভাগে কিছুটা ওলট–পালট শুরু হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও শিক্ষার মান বাড়ানোর কথা বলছে। িকন্তু এসব তৎপরতা লোকদেখানো না আন্তরিক, তা কাজেই প্রমাণ পাওয়া যাবে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]