শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষেদের পরে কী হবে

পদত্যাগের দাবিতে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের বাড়ির সামনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভছবি: এএফপি

শ্রীলঙ্কা এখন ঋণখেলাপি রাষ্ট্রগুলোর তালিকায় যুক্ত। এর তাৎক্ষণিক একটা ফল হলো দেশটির সিংহলি সমাজে রাজাপক্ষেদের মনস্তাত্ত্বিক আধিপত্য শেষ হওয়া। ইতিমধ্যে এই পরিবারের দুই ভাই বাসিল ও চমল এবং দুই নাতি নমল ও শচীন্দ্র সরকার ছেড়েছেন। অপর দুই ভাই প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকেও যেতে হবে। অন্তত একজনকে অবশ্যই। জনতা চাইছে সমগ্র রাজাপক্ষে পরিবারই শাসনক্ষমতা থেকে বিদায় হোক। প্রশ্ন উঠেছে, এরপর কে? শ্রীলঙ্কা বর্তমান দুরবস্থা থেকে উদ্ধার পাবে কীভাবে?

হাতে মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার

দেশে-বিদেশে প্রায় সবাই নিশ্চিত, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির তাৎক্ষণিক কোনো রোগমুক্তি নেই। যদিও দেশটি নিজেদের এখনো দেউলিয়া ঘোষণা করেনি, কিন্তু অবস্থা ও রকমই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার। ইতিমধ্যে তারা বৈদেশিক দেনা পরিশোধ বন্ধ রেখেছে ঘোষণা দিয়ে। আমদানি পণ্য ক্রমে দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে। তবে সমস্যাটা ডলার–সংকট নয়। সেটা হলো সমস্যার ফল। অনেক দিন থেকে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করে যাচ্ছিল দেশটি। সম্পদ পাচার হয়েছে লাগামহীনভাবে। সরকারি সিদ্ধান্তে কোনো জবাবদিহি ছিল না। এসবেরই মিলিত ফল ভোগ শুরু হয়েছে এখন।

বিক্ষোভকারীরা অধৈর্য হয়ে পড়ছে

৫১ বিলিয়ন বৈদেশিক দেনা নিয়ে শ্রীলঙ্কার এ মুহূর্তে প্রধান ভরসা আইএমএফ। এপ্রিলে শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ওয়াশিংটনে আইএমএফের চার দিনের বৈঠক হয়েছে। বৈঠক শেষে মূল বার্তা ছিল দেশটিতে আগে চলতি রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হতে হবে। তারপর আইএমএফ অর্থনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে। নিশ্চিতভাবে সেই হস্তক্ষেপের বড় উপাদান হবে সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার, উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে আনা এবং করের হার ও আওতা বাড়ানো। বোঝা যাচ্ছে, রাজাপক্ষেদের ভুলের মাশুল দিতে হবে দেশটির নাগরিকদেরই। দীর্ঘ সময়ের জন্য আরেক ঋণের বোঝায় ঢুকতে হবে শ্রীলঙ্কাকে নতুন করে।

আইএমএফ বছরে তিন থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দেবে না আপাতত। তারা চাইছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন ও ভারতের কাছেও হাত পাতুক শ্রীলঙ্কা। এসব দেশের সঙ্গে পুরোনো ঋণ পরিশোধের নতুন সময়সূচি ঠিক করে নতুন করে আরও ঋণ নিক। এ রকম সব পক্ষের সহায়তা পেতে সিংহলিদের এখন এমন কিছু রাজনৈতিক সংস্কার করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক অসন্তোষ কমে, তামিলদের সন্তুষ্টি আসে এবং দেশের আন্তর্জাতিক ইমেজ পাল্টায়। কিন্তু শিগগির এসব হয়ে যাবে না। যদিও বিক্ষোভস্থলগুলো অধৈর্য হয়ে পড়ছে, কারণ সমস্যার শিকার প্রতিটি রান্নাঘর। মুদ্রাস্ফীতিতে বিশ্বে শ্রীলঙ্কা ওপর থেকে ৩ নম্বরে আছে; জিম্বাবুয়ে ও লেবাননের পরেই তার অবস্থান। অনেক হাসপাতাল ওষুধের জন্য গণসহায়তা চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

নয়াদিল্লি বর্তমান সংকটের মধ্যেই রাজাপক্ষেদের সঙ্গে দর-কষাকষি করে দেশটিতে তার প্রভাব বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। গত মার্চে তারা জাফনা উপকূলের তিনটি দ্বীপে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট করার অনুমতি পেয়েছে সরকারের কাছ থেকে। এক বছর আগে এসব প্রকল্প চীনকে দেওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু চলতি রাজনৈতিক সংকট রাজাপক্ষেদের ভূরাজনৈতিক অবস্থান সংশোধন করতে বাধ্য করছে, যার বিনিময়ে তারা ভারত থেকে অন্তত দুই বিলিয়ন ডলার ঋণের আশ্বাস পেল।

শাসক দলে মতভিন্নতা

সরকারের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভের এক মাস পূর্ণ হবে আগামী ৩ মে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় শাসক দল এসএলপিপি এ মুহূর্তে দ্বিধাবিভক্ত। গোতাবায়া ও মাহিন্দা কোনো একজনকে রেখে অপরজনকে বিসর্জন দিতে চাইছে তারা। অন্তত একজন রাজাপক্ষেকে রাখতে চায় তারা। এই দলের শক্তির ভিত যে উগ্র জাতীয়তাবাদ, তা রাজাপক্ষেদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপটে আছে। ফলে পুরো বংশকে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে দলটি ছিন্নভিন্ন হওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইছে না। কিন্তু শাসকদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা যত হচ্ছে, দেশটির সংকট প্রলম্বিত হচ্ছে ততই। ছাত্ররা ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগের চূড়ান্ত বার্তা দিয়েছে। আইএমএফ বলছে, অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করতে হলে রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীলতা লাগবে আগে।

অর্থাৎ নতুন একটা সরকার গড়তে হবে শ্রীলঙ্কাবাসীকে। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে, এ বিষয়ে আপাতত কোনো ঐকমত্য নেই। শাসক দলের ৪০ জন এমপি ক্ষোভের উত্তাপ থেকে বাঁচতে পার্লামেন্টে আলাদা অবস্থান নিয়ে আছেন। এসএলপিপির মিত্র দলগুলোও দূরত্ব বাড়াচ্ছে রাজাপক্ষেদের থেকে। বিরোধী দল চেষ্টা করছে এদের সমর্থন নিয়ে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে পাকিস্তান স্টাইলে সরকার সরাতে। কিন্তু তাতে জনগণ সন্তুষ্ট নয়। তারা প্রেসিডেন্টেরও বিদায় চায়। জনতার বিরূপ মনোভাব দেখে রাজাপক্ষে পরিবারের কেউ কেউ নীরবে দেশ ছাড়ছে। অনেকেই পাচারের মাধ্যমে ইতিমধ্যে বিদেশে বিস্তর সম্পদের সমাবেশ ঘটিয়েছে বলে দেশবাসী মিছিল-মিটিংয়ে অভিযোগ করছে। গত বছর অক্টোবরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের এক আন্তর্জাতিক জোট প্যান্ডোরা পেপারস নামে বৈশ্বিক লুটপাটের যে দলিল প্রকাশ করে, তাতে রাজাপক্ষে পরিবারের সদস্য নিরুপমার বেআইনিভাবে সম্পদশালী হওয়ার বিপুল বিবরণ ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ছেলে চমলের বিরুদ্ধেও ২০১৬ সালে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের ছোট ভাই বাসিল রাজাপক্ষে আর্থিক দুর্নীতির জন্য বহুবারই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। খোদ মাহিন্দা রাজাপক্ষের দুবাইয়ে থাকা সম্পদের বিস্তারিত বিবরণ ছেপেছিল একদা ব্রিটেনের গার্ডিয়ান (২০ মার্চ ২০১৫)। বলা বাহুল্য, এসব খবরাখবর ক্রমে ধামাচাপা পড়েছে এই পরিবার রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার পার্শ্বফল হিসেবে।

অর্থনৈতিক ‘বেইল আউট’-এর জন্য কেয়ারটেকার সরকার?

অর্থনৈতিক ‘বেইল আউট’-এর জন্য শ্রীলঙ্কায় এই মুহূর্তে আইএমএফের পছন্দ নির্মোহ ও দক্ষ পেশাজীবীদের কেয়ারটেকার সরকার। তারা মনে করে, রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে বেদনাময় অর্থনৈতিক সংস্কার চালিয়ে নেওয়া কঠিন। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা তা মানবেন কেন? কেয়ারটেকার সরকার তাঁদের পেশাগত স্বার্থের সঙ্গে যায় না সচরাচর।

প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে দুজন আমলাকে বসিয়েছেন। চলতি সংকটের সমাধান হিসেবে তিনি চাইছেন, বড় ভাই মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিন। সর্বদলীয় একটা সরকার হোক। গোতাবায়ার পেছনে সামরিক আমলাতন্ত্রের সমর্থন আছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাঁর হাতে। মাহিন্দাকে বলি দিয়ে এরা এ যাত্রা গোষ্ঠী শাসন রক্ষা করতে চাইছে।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা মনে করছেন, সংকট তৈরি হয়েছে গোতাবায়ার কারণে। সুতরাং তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হোক। প্রধান বিরোধী দলও বলছে, সংকটের শুরু যেহেতু প্রেসিডেন্টের সর্বময় ক্ষমতার লাগামহীন চর্চার মধ্য দিয়ে, সুতরাং সংবিধান সংশোধন করে এই পদের ক্ষমতা কমাতে হবে সবকিছুর আগে। তবে রাজাপক্ষেদেরও পদত্যাগ করতে হবে। বিক্ষুব্ধ জনতাও চাইছে সব রাজাপক্ষের বিদায়। তাদের ক্ষোভের মাত্রা ইঙ্গিত দিচ্ছে সংকট দীর্ঘায়িত হলে মানুষ সহিংস হয়ে উঠতে পারে; যদিও এখন পর্যন্ত বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ। কিন্তু তাতে নেই শক্তিশালী নেতৃত্ব। আন্দোলনকারীরা বিরোধী রাজনীতিবিদদের খুব বেশি দেখতে আগ্রহী নয় তাদের সমাবেশগুলোয়। তাদের ওপরও জনতার আস্থা কম। অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার এই আন্দোলনকে তুলনা করছেন ‘আরব বসন্ত’-এর সঙ্গে। যে ‘বসন্ত’ শেষ হয়েছে রীতিমতো তুষারপাতের মধ্য দিয়ে!

আরও পড়ুন

শ্রীলঙ্কার চলতি আন্দোলনের আরেক বৈশিষ্ট্য এতে মূলত মধ্যবিত্তরা শামিল হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটে যদিও কৃষিসমাজ ও শহুরে দরিদ্র গোষ্ঠী সবচেয়ে দুর্দশায় পড়েছে, কিন্তু তাদের কাঠামোগতভাবে এ আন্দোলনে শামিল হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। বামপন্থী ধারার রাজনৈতিক দলগুলো দেশটিতে দুর্বল। সিংহলি মধ্যবিত্তের র‍্যাডিক্যাল অংশ এতটা শক্তিশালী নয় যে দেশজুড়ে কোনো গণ-অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। তামিলদের দাবিদাওয়ার প্রশ্নেও এদের উদারনৈতিক কোনো অবস্থান নেই। ফলে তামিলরাও রাজাপক্ষদের চরম বিরোধী হয়েও সর্বশক্তিতে নামছে না মাঠে। তাদের এই ইতস্তত ভঙ্গির সঙ্গে ভারতের শ্রীলঙ্কানীতিরও কিছু সামঞ্জস্য আছে।

নয়াদিল্লি বর্তমান সংকটের মধ্যেই রাজাপক্ষেদের সঙ্গে দর-কষাকষি করে দেশটিতে তার প্রভাব বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। গত মার্চে তারা জাফনা উপকূলের তিনটি দ্বীপে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট করার অনুমতি পেয়েছে সরকারের কাছ থেকে। এক বছর আগে এসব প্রকল্প চীনকে দেওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু চলতি রাজনৈতিক সংকট রাজাপক্ষেদের ভূরাজনৈতিক অবস্থান সংশোধন করতে বাধ্য করছে, যার বিনিময়ে তারা ভারত থেকে অন্তত দুই বিলিয়ন ডলার ঋণের আশ্বাস পেল। ভারতের অর্থমন্ত্রী এমনকি ওয়াশিংটনে আইএমএফকেও সুপারিশ করেছেন শ্রীলঙ্কাকে প্রত্যাশিত বেইল আউটের জন্য। দেশটির অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে আইএমএফের আধিপত্য নিশ্চিতভাবেই চীনের জন্য শুভসংবাদ নয়।

আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক