সম্মেলন চট্টগ্রামে, কমিটি ঢাকায়

সম্মেলনের সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি বা ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হবে কমিটি ঘোষণা করতে না পারা
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগর যুবলীগের সম্মেলন সম্পন্ন হলো সম্প্রতি। পরপর তিন দিনের এ আয়োজনকে এককথায় বলা চলে অভূতপূর্ব। কারণ, সম্মেলনকে কেন্দ্র করে অন্তত পক্ষকালব্যাপী নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যে উত্সাহ-উদ্দীপনা, যে পরিমাণ ব্যানার-তোরণ-ফেস্টুনের সমাহার, বিপুল কর্মী-সমর্থকের সমাবেশ ও ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতি—এ রকম উত্সবের আমেজ বহুদিন কোনো রাজনৈতিক সম্মেলনকে ঘিরে দেখা যায়নি। এর কারণ আছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনটির চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগর শাখার সম্মেলন হয়নি যথাক্রমে ১৯, ৪৫ ও ১৯ বছর। এর ফাঁকে মাঝেমধ্যে কমিটির রদবদল হয়েছে বটে, সম্মেলন বা কাউন্সিল করা হয়ে ওঠেনি। কেন হয়ে ওঠেনি, সেটা সহজেই অনুমেয়। পদ–পদবিপ্রত্যাশী ও তাঁদের সমর্থকেরা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে, এটাই ছিল প্রধান দুশ্চিন্তা।

এবারের সম্মেলনে জনসমাগমের কারণে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম নগরে যানজট, হাসপাতালগামী রোগীদের যাতায়াত সমস্যাসহ নানাবিধ ভোগান্তির শিকার হয়েছে মানুষ। জনবহুল দেশের নাগরিককে এটুকু কায়ক্লেশ তো স্বীকার করতেই হবে। সুতরাং সম্মেলনকে ঘিরে সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে ‘উলুখাগড়ার প্রাণ’ যে যায়নি, সেটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তি।

সেই দিক থেকে বলতে গেলে এ সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের কপাল থেকে দুশ্চিন্তার রেখা কিছু কমল। তাঁরা নির্ভার হয়ে মঞ্চে উঠে নিজেদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনের কথা বললেন এবং প্রতিপক্ষকে (এ ক্ষেত্রে বিএনপি ও তথাকথিত সুশীল সমাজ) যথারীতি তুলাধোনা করলেন।

এ সম্মেলন থেকে যুবলীগ নেতা-কর্মী-সমর্থকদের প্রাপ্তি কী? মোটাদাগে বলতে গেলে, পদপ্রত্যাশীদের বিভিন্ন উপদলের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে কোনো এলাকা রণক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি। পদপ্রত্যাশীরা বক্তৃতায়-বিবৃতিতে যেমন পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করেননি, তেমনি তাঁরা যাঁদের আশীর্বাদপুষ্ট, সেই নেতারাও ছিলেন সহিষ্ণু ও মিতবাক। কর্মী-সমর্থকদের একটি বিরাট অংশকে দেখা গেছে বিভিন্ন পদের প্রার্থীর প্রতিকৃতি সংবলিত টি-শার্ট পরে মিছিলে-শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েছেন। তাঁদের উচ্ছ্বসিত দেখা গেলেও উত্তেজিত ছিলেন না। বরং একই পদের দুই পক্ষের সমর্থককে ভিন্ন রঙের টি-শাট৴ পরে দলবদ্ধ হয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেলেও তাঁদের পরস্পরকে উত্ত্যক্ত করতে বা উসকানি দিতে দেখা যায়নি। এটুকু শৃঙ্খলা একটি বড় দলের জন্য অর্জন বা প্রাপ্তি হিসেবেই গ্রহণ করা যায়।

কিন্তু সম্মেলনের সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি বা ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হবে কমিটি ঘোষণা করতে না পারা। উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগর চট্টগ্রামের তিনটি সম্মেলন শেষে কেন্দ্রীয় নেতারা ফিরে গেলেন ঢাকায়, কাউন্সিলররাও ফিরলেন যে যাঁর বাড়িতে। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে সাধারণত সম্মেলন হয়, সেই কমিটি ঘোষণার কাজটিই সম্পন্ন হলো না। দেশের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দলের দাবিদার আওয়ামী লীগ যখন তার জেলা পর্যায়ের একটি কমিটিও কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচন করতে পারে না, তখন বাকি সব আয়োজনকে অহেতুক আড়ম্বর ছাড়া আর কীই–বা মনে করা যায়?

এবার পদপদবিপ্রত্যাশীদের কেন্দ্রে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে বলা হয়েছিল। শুধু নগর কমিটিতেই স্থান পাওয়ার আশায় জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছিলেন ১০৮ জন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৫ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত সভাপতি পদে ২৮ ও সাধারণ সম্পাদক পদে ৬৫ জন প্রার্থী হিসেবে অনড় ছিলেন। এত বেশিসংখ্যক নেতা-কর্মী যখন একটি সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নিজেকে যোগ্য মনে করেন, তখন আসলে সংগঠনে সে রকম প্রকৃত নেতার অভাবটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে দু-একজনের প্রতি সংগঠনের সবার আস্থা ও আনুগত্য আছে। শুধু চট্টগ্রাম নগর শাখা যুবলীগ নয়, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা শাখায়ও শীর্ষ পদে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা প্রায় অস্বাভাবিক। সফল সম্মেলন শেষ করে যুবলীগের কেন্দ্রীয় যে নেতারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন, তাঁদের বুঝতে হবে, সংগঠনের এত অধিকসংখ্যক কর্মী যেখানে নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতায় শামিল, সেখানে নিশ্চয় কোথাও গলদ আছে।

আসলে দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে বলে এসব অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ হয়নি। দলের দুর্দিনেই তো ‘মৌমাছি’দের ভিড় এড়িয়ে প্রকৃত নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে।

কারা প্রার্থী হয়েছেন? সেই তালিকায় চোখ বোলালে একটি বড় অংশকে দেখা যাবে, যাঁরা বিভিন্ন মামলার আসামি। তাঁদের মধ্যে জোড়া খুনের আসামি, প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছাত্রকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত বা টেন্ডার–সন্ত্রাসের জন্য চিহ্নিত যুবকেরাও আছেন। তাঁরা পদপদবি পাবেন না, এ নিশ্চয়তা দেবে কে? এর আগে নগরের চকবাজার এলাকায় যুবলীগের এমন একজনকে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখেছি, যিনি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভোটারদের অনীহার সেই নির্বাচনে জামানত হারিয়েও নির্বাচিত হওয়ার এক হাস্যকর রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন সেই যুবলীগ নেতা।

আসলে দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে বলে এসব অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ হয়নি। দলের দুর্দিনেই তো ‘মৌমাছি’দের ভিড় এড়িয়ে প্রকৃত নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি যথার্থই বলেছেন, ‘আজ যারা যুবলীগের কর্মী বা সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, তারা আওয়ামী লীগের কৃষ্ণপক্ষ দেখেনি, সুযোগ হয়নি...তারা শুধু আওয়ামী লীগের শুক্লপক্ষ দেখেছে।’

‘শুক্লপক্ষে’র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া কর্মীদের শৃঙ্খলায় আনা কতটা কঠিন, পরপর তিন দিনের তিনটি সম্মেলনের একটিতেও কমিটি ঘোষণা করতে না পারা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

আরও পড়ুন

চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো যে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের পক্ষে-বিপক্ষে দ্বিধাবিভক্ত, এ কথা সবাই জানেন। যুবলীগের সম্মেলনেও প্রসঙ্গটি উঠেছে। যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান এই দুই নেতাকে ‘ঐক্যের রাজনীতি’র প্রমাণ দিতে বলেছেন। আ জ ম নাছির উদ্দীন তাঁর বক্তৃতায় অবশ্য বলেছেন, ‘আমরা জাতে মাতাল তালে ঠিক। যে সময় দরকার পড়বে আমরা ঐক্যবদ্ধ হব। সব চক্রান্ত ষড়যন্ত্র অতীতের মতো সামনের দিনগুলোতেও প্রতিহত করব।’

এ রকম বক্তব্য হয়তো নেতা-কর্মীদের তাৎক্ষণিক সান্ত্বনা জোগানোর প্রয়াস; কিন্তু চট্টগ্রামের সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকায় দুপক্ষের হানাহানিতে যে ক্ষয়ক্ষতি, জীবনের যে অপচয়, তাকে জায়েজ করবেন কোন যুক্তিতে?

যুবলীগের সম্মেলনে উৎসবের আমেজ ছিল, কিন্তু নতুন কমিটি ভবিষ্যতে কর্মী-সমর্থকদের উপদলীয় কোন্দল থেকে বিরত রাখতে পারবে, এমন কোনো বার্তা পাওয়া গেল না।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক

[email protected]