সাংবাদিকতায় একটি অনন্য নাম

কাজী নজরুল ইসলাম এর সঙ্গে মকবুল হোসেন চৌধুরী।
কাজী নজরুল ইসলাম এর সঙ্গে মকবুল হোসেন চৌধুরী।

মকবুল হোসেন চৌধুরী। বাংলা সাংবাদিকতায় একটি অনন্য নাম। যত দিন বাংলা সাংবাদিকতা থাকবে, তত দিন তাঁর নাম উচ্চারিত হবে। মুসলিম মনীষীরা নানাভাবেই তাঁকে মূল্যায়ন করে গেছেন। বাংলা সাংবাদিকতার ইতিহাস লিখতে গিয়ে অনেকেই বলেছেন, প্রয়াত চৌধুরী ছিলেন এক সাহসী যোদ্ধা। আমার বিবেচনায়, তিনি ছিলেন এই উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণের এক কারিগর। পিছিয়ে থাকা মুসলিম সমাজকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য যে কজন মানুষ নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন, তিনি তাঁদের একজন।
আমি মাত্র প্রাথমিক স্কুলে যেতে শুরু করেছি। এর মধ্যেই মকবুল হোসেন চৌধুরী দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আমার জানার কথাও নয়। সাংবাদিকতা বিষয়টিও আমার কাছে সম্পূর্ণ অজানা। ঘটনাচক্রে যখন সাংবাদিকতা পেশায় এলাম, তখন মকবুল হোসেন চৌধুরীর নাম প্রায়ই আলোচনায় আসত। বিশেষ করে তাঁর দুই সুযোগ্য পুত্রের সঙ্গে আমার সাংবাদিকতা করার সুযোগ হয়েছিল। আমি নিজেকে এ জন্য সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। হোসেন তওফিক চৌধুরী ও হাসান শাহরিয়ার চৌধুরী—দুজনই স্বনামখ্যাত সাংবাদিক। হাসান শাহরিয়ার কোনো দিন নামের শেষে চৌধুরী লিখতেন না। কেন, তা অবশ্য কোনো দিনই জিজ্ঞাসা করা হয়নি।

সে যা-ই হোক, হোসেন তওফিক চৌধুরীর সঙ্গে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় কাজ করেছি অনেক দিন। অত্যন্ত মেধাবী, সৎ ও নির্ভীক এক সাংবাদিক। লবণের সংকট হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। সে সংকট আর নেপথ্যের খবর নিয়ে এক বিস্তারিত রিপোর্ট লিখেছিলেন হোসেন তওফিক চৌধুরী। শাসক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় এই রিপোর্ট প্রকাশের পর। সম্পাদক এহতেশাম হায়দার চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় গণভবনে। চাকরিচ্যুত করতে বলা হয় সাংবাদিককে। সে আমলে কথায় কথায় সাংবাদিকদের চাকরি চলে যেত। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করতে গেল। সেই ঘেরাওয়ের খবর লিখতে গিয়ে দৈনিক বাংলার বাণী থেকে চাকরি হারিয়েছিলাম। একই ঘটনা ঘটেছিল আমার বেলায়ও। সম্পাদক ফজলুল হক মণিকে ডেকে বলা হয়েছিল, ‘এই ব্যাটা সাংবাদিক জাসদের লোক। এখনই তার চাকরি খেতে হবে।’ দুই ঘণ্টার মধ্যেই আমি লাল চিঠি পেয়েছিলাম। হোসেন তওফিক চৌধুরীর মনের অবস্থা সেদিন কী ছিল, তা লিখে বোঝাতে পারব না। আমাদের মন খারাপ হলেও তাঁর মনোবল ছিল অটুট। ভেঙে পড়েননি।

পরে তিনি এই পেশাই ছেড়ে দেন। সুনামগঞ্জে চলে যান। শুরু করেন ওকালতি পেশা। এখনো তিনি এই পেশাতেই আছেন, অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে। হাসান শাহরিয়ারের সঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করেছি প্রায় এক যুগ। তাঁকে নিয়ে গর্ব করার মতো অনেক কিছু রয়েছে। ধীরস্থির, অত্যন্ত স্বাধীনচেতা একজন সাংবাদিক। উপমহাদেশজুড়েই তাঁর নাম জারি রয়েছে সাংবাদিকতা অঙ্গনে। যখনই বিদেশে কেনো ফেলোশিপ বা সম্মেলনে যোগ দিয়েছি, তখন অন্য এক হাসান শাহরিয়ারের নাম শুনেছি। জেনেছি অনেক কিছু। বিশেষ করে পাকিস্তানি সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় হলেই তাঁরা প্রথমে যে তিন-চারজন ঢাকার সাংবাদিকের নাম উচ্চারণ করেন, তখন হাসান শাহরিয়ারের নাম এসে যায়। তাঁকে আমি ‘ওস্তাদ’ বলেই ডেকেছি বরাবর।

প্রয়াত মকবুল হোসেন চৌধুরীর সাফল্য হচ্ছে তিনি বংশের মধ্যে সাংবাদিকতার বীজ রোপণ করে গিয়েছিলেন। ছেলেরা সাংবাদিকতায় আসবে, এটা তিনি চেয়েছিলেন কি না জানা নেই। তবে রক্তের টানে দুই সন্তান সাংবাদিকতায় এসে বাংলা সাংবাদিকতার প্রসার ও সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। এটা বলা চলে নিঃসন্দেহে।

মকবুল হোসেন চৌধুরী
মকবুল হোসেন চৌধুরী


স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বই ‘ইতিহাসের প্রান্তে’ লিখতে গিয়ে মকবুল হোসেন চৌধুরীর অনেক অজানা তথ্য জেনেছি। প্রায় পাঁচ বছর লেগেছিল বইটি লিখতে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী কথা উঠলেই বলতেন, ‘একজন মকবুল হোসেনের ছবি আঁকুন লেখায়, বলায়। মুসলিম সমাজ যখন ঘরে বন্দী, কোণঠাসা নানা কারণে, তখন মকবুল সাহেবরা কলম ধরেছেন। লক্ষ্য ছিল তখন একটিই—আর পিছিয়ে থাকা নয়, এবার সামনে আসতে হবে। প্রতিযোগিতায় নামতে হবে।’
ব্রিটিশ শাসনকালে সাংবাদিকতা পেশা কম ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না। আজও ঝুঁকি রয়েছে। তবে সে আমলের ঝুঁকি ব্যক্তিকে নিয়ে নয়, গোটা সমাজকে নিয়েই। দৈনিক সোলতান বলুন, কিংবা সাপ্তাহিক যুগবাণী বা যুগভেরী বলুন, মকবুল হোসেন চৌধুরী যোগ্যতার ছাপ রেখে গেছেন। যুগভেরী আজও আছে। প্রথম সম্পাদক হিসেবে মকবুল হোসেন চৌধুরীর নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। আমিনুর রশীদ চৌধুরীর কাছে যখনই কেউ সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করতেন বা চাকরির জন্য যেতেন, তখন তিনি বলতেন, মকবুল হোসেন চৌধুরীর মতো হতে পারবেন তো?
আসলে মকবুল হোসেন চৌধুরী ছিলেন এক আদর্শ। সিলেট থেকে কলকাতা—সে তো অনেক পথ। বলতে গেলে সিলেট একটি মফস্বল শহর। সেই শহর থেকে কলকাতা পর্যন্ত মকবুল হোসেন চৌধুরীর নাম মশহুর হয়ে পড়েছিল তাঁর স্বাধীনচেতা লেখনীর মাধ্যমে। আমার মনে আছে, ১৯৮০-র দশকে আমি যখন কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার ঢাকা সংবাদদাতা নিযুক্ত হই, কলকাতার স্বনামখ্যাত সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হতেই বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ মিয়া, তুমি তো দেখি মকবুল ভাইয়ের দেশের লোক। জানো, আমিও কিন্তু শ্রীহট্টের সন্তান।’ সিলেট নয়, সব সময় তিনি শ্রীহট্ট বলতেন। দীর্ঘ সময় তাঁর সঙ্গে কাজ করে মনে হয়েছে, তিনি আগে সিলেটি, এরপর অন্য কিছু।

মতিউর রহমান চৌধুরী: দৈনিক মানবজমিনের সম্পাদক।